ঢাকাই ও ললিউড সিনেমার কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম। তবে চলচ্চিত্রে তার সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময়টা কেটেছে পাকিস্তানেই। সেখানে ছিলেন অত্যন্ত জনপ্রিয় তারকা। দীর্ঘদিন ধরে রুপালি পর্দা থেকে দূরে রয়েছেন তিনি। সম্প্রতি চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডে থাকার প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন শবনম। যেখানে এমন স্থানে থাকার ইচ্ছা পোষণ করেন সবাই, তদবিরও করেন অনেকে, সেখানে প্রস্তাব পেয়েও ফিরিয়ে দিলেন এই অভিনেত্রী। দিনকয়েক আগেই ১৫ সদস্য নিয়ে পুনর্গঠিত হয়েছিল 'চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড'-এর কমিটি। কিন্তু তুমুল সমালোচনার মুখে সেন্সর বোর্ডের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় 'চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ড।' এরই মধ্যে বোর্ড গঠন করে প্রজ্ঞাপনও জারি করা হয়েছে। জানা গেছে, চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের সদস্যরাই নবগঠিত সার্টিফিকেশন বোর্ডে দায়িত্ব পালন করবেন। এ বিষয়েও প্রজ্ঞাপনও জারি করেছিল তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। তবে ওই কমিটির দুজন সদস্য সরে দাঁড়ানোয় তৈরি হয় শূন্যতা। পরে সেই স্থানে আসার জন্য প্রস্তাব করা হয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনমকে। ১৯ সেপ্টেম্বর মুঠোফোনে কল করে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডে থাকার প্রস্তাব দেওয়া হলে প্রথমে প্রস্তাবটি নিয়ে ভাবার দুইদিন সময় চেয়ে পরে আবার সেই প্রস্তাব সবিনয়ে ফিরিয়ে দেন শবনম। জানিয়েছেন নিজের অপারগতা ও অনাগ্রহের কথা। বলেছেন, প্রায়ই শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকার বিষয়টি। গত শনিবার বিষয়টি নিজেই নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে অভিনেত্রী বলেন, মুঠোফোনে মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা আমাকে চলচ্চিত্র সার্টিফিকেশন বোর্ডে থাকার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু এ মুহূর্তে আমার শরীর অনেক কিছুই পারমিট করে না। প্রতিদিন ডাক্তারের কাছে যাচ্ছি। এসব নিয়ে ভাবার সময়ও পাই না। তবে মন্ত্রণালয়কে ধন্যবাদ, তারা আমার কথা মনে করেছেন বলে। কারণ তারা আমাকে না-ও ভাবতে পারতেন। শবনম আরও বলেন, শরীর অসুস্থ থাকলে আসলে কিছুই ভালো লাগে না। আমার অবস্থা এখন তা-ই। বোর্ডে থাকলে ভালো লাগত। আমি সব সময় একটু ঘরকুনো টাইপের মানুষ। কিছুদিন আগে পাকিস্তান ফিল্ম ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যানের পদে অফার করেছিল তারা। এর জন্য মোটা অঙ্কের অনারিয়ামও দিতে রাজি ছিল। কিন্তু এ বয়সে এই গুরুভার নেওয়ার মতো ফিটনেস আমার নেই। তাছাড়া দেশ ছেড়ে কোথাও আর যেতে চাই না। যে কয়েকটা দিন বাঁচি, মাতৃভূমিতেই সবার সঙ্গে হেসে-খেলে কাটিয়ে বিদায় নিতে চাই। কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম নামে পরিচিত হলেও তার নাম ছিল ঝর্ণা বসাক। তার জন্ম ১৯৪১ সালের ১৭ আগস্ট। তার বাবা ছিলেন ননী বসাক পেশায় স্কাউট প্রশিক্ষক ও ফুটবল রেফারি। কিংবদন্তি এই অভিনেত্রীর বিয়ে হয়েছিল ১৯৬৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর স্বনামধন্য সঙ্গীত পরিচালক রবিন ঘোষের সঙ্গে। একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবেও শবনম সুপরিচিতি লাভ করেন। তিনি শৈশবেই ললিতকলা অ্যাকাডেমি থেকে নাচ শিখেছিলেন। একটি নৃত্যের অনুষ্ঠান থেকেই এহতেশাম তার নাচ দেখে এদেশ তোমার আমার চলচ্চিত্রের নৃত্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। পাশাপাশি আরও কিছু সিনেমায় অভিনয়ের সুযোগ করে দেন। এহতেশামের পাশাপাশি নিজ অভিনয় দক্ষতায় পরিচালক মুস্তাফিজের নজর কাড়েন তিনি। শবনম ১৯৬১ সালে মুস্তাফিজ পরিচালিত 'হারানো দিন' সিনেমায় অভিনয়ের মধ্য দিয়েই নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। সেই সিনেমাতেই তিনি শবনম নাম ধারণ করেন। হারানো দিন সিনেমায় খ্যাতি অর্জনের পর তিনি ১৯৬২ সালে উর্দু চলচ্চিত্র চান্দা ছবির মাধ্যমে তৎকালীন সমগ্র পাকিস্তানে তারকাখ্যাতি অর্জন করেন। ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে শবনম পাকিস্তানের সর্বাপেক্ষা জনপ্রিয় অভিনেত্রী হিসেবে চিহ্নিত হন। ১৯৬৮ সালে তিনি পাকিস্তানের করাচিতে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন। এরপর সত্তরের দশকের শুরুতে শবনম ললিউড (লাহোর) পাকিস্তানের ইতিহাসে সবচেয়ে জনপ্রিয় নায়িকা হিসেবে নিজের স্থান করে নেন। আয়না সিনেমায় নাম-ভূমিকায় অভিনয় করেন শবনম এবং এই সিনেমা পাকিস্তানের সিনেমা হলগুলোতে দীর্ঘদিন চলার রেকর্ড করেন। একটা সময় পর শবনম বাংলাদেশে চলে আসেন। তিনি বাংলাদেশের 'সন্ধি', 'শর্ত', 'সহধর্মিণী', 'যোগাযোগ', 'জুলি', 'বশিরা', 'দিল'সহ অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। তার পরবর্তী সময় অর্থাৎ ১৯৯৯ সালের ২৫ জুন কাজী হায়াৎ পরিচালিত 'আম্মাজান' সিনেমাটি মুক্তির পর থেকে আজ অবধি দর্শক তাকে 'আম্মাজান' হিসেবে খুব সহজেই চেনেন। ১৯৮৮ সালে শবনম তার চরিত্র পরিবর্তন করেন এবং পুনরায় ঢাকা ও লাহোরের চলচ্চিত্রাঙ্গনে অভিনয় করতে থাকেন। ৪০ বছরের অধিক সময় ধরে অভিনয়ের ফলে তিনি প্রায় ১৮০টি চলচ্চিত্রের অনেকগুলোতে অবিস্মরণীয় হয়ে আছেন। শবনম অনেকবার সম্মানসূচক নিগার পুরস্কারের পাশাপাশি তিনবার পাকিস্তানের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন। কাজী হায়াতের পরিচালনায় ও ঢাকা প্রোডাকশনের ব্যানারে তিনি ১৯৯৯ সালে সর্বশেষ আম্মাজান চলচ্চিত্রের কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেন। পাকিস্তানের চলচ্চিত্র শিল্পে অসামান্য অবদান রাখায় তিনি সম্মানসূচক পুরস্কার হিসেবে মোট ১২ বার নিগার পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়া ২০১৯ সালের লাক্স স্টাইল অ্যাওয়ার্ড অনুষ্ঠানে তাকে আজীবন সম্মাননা প্রদান করা হয়।