পর্দার জনপ্রিয় 'বাকের ভাই' বাস্তবে যেমন

প্রকাশ | ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
পর্দার জনপ্রিয় 'বাকের ভাই'কে (আসাদুজ্জামান নূর) যখন বাস্তবেও দেখা গেল আদালতের কাঠগড়ায়, তখন যেন সেখানে সেই জনপ্রিয়তার ছিটেফোঁটাও নেই। এর জন্য এই ভাগ্যের নির্মম পরিহাসের জন্য দায়ী বাংলাদেশে ধারাবাহিকভাবে হয়ে আসা নোংরা ও বীভৎস্য রাজনীতি। পর্দায় না হলেও আজ যেন বাস্তবে সত্যিই তিনি একজন খুনি। '৯০-এর দশকে তার পাশে সারা বাংলাদেশের মানুষ ছিল, ছিল সে সময়ের প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কিন্তু বাস্তবে আজ তার পাশে কেউ নেই। কারণ, তিনি যে সত্যিই একজন খুনি এবং স্বৈরাচার সরকারের সহযোগী। তবে সেই '৯০ দশকে করা বাকের ভাই চরিত্রে করা অভিনয়ের কারণে তুমুল জনপ্রিয় হয়েছিলেন সেই জনপ্রিয়তার কারণেই কিনা কে জানে, তবে আসামি আসাদুজ্জামান নূরকে অন্যদের মতো রিমান্ডের জন্য আবেদন জানানো হয় নি, সরাসরিই তাকে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। একজন খ্যাতিমান সংস্কৃতিকর্মীকে রিমান্ডের আবেদন না করে এভাবেই যেন সম্মান জানানো হলো। আর আদালত প্রাঙ্গণেও সালমান বা আনিসুলদের মতো কোনো অপ্রীতিকর ঘটনাও ঘটেনি। গ্রাম-গঞ্জের অনেক মানুষের কাছে আজও তিনি বাকের ভাই নামে পরিচিত। গত রোববার রাত ১১টার দিকে রাজধানীর বেইলি রোডের নওরতন কলোনি থেকে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর থানায় দায়ের করা একটি হত্যা মামলায় তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আসাদুজ্জামান নূর শুধু নাট্য অভিনেতা হিসেবেই নয়, একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং দীর্ঘদিনের জনপ্রতিনিধি হিসেবেও বাঙালির কাছে পরিচিত। ২০০১ সালে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে তিনি প্রথমবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০২৪ সাল পর্যন্ত তিনি নীলফামারী-২ আসনের পাঁচবার সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্বে ছিলেন। এরমধ্যে দু'বার ভোটের মাধ্যমে আর তিন বার ভোটহীন নির্বাচনের মাধ্যমে। ছাত্র-জনতার অভু্যত্থানের মুখে ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেন এবং দেশ ছাড়েন। এরপর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের ২৭ জন মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও শীর্ষ পর্যায়ের নেতাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, যাদের মধ্যে এবার যুক্ত হলেন 'বাকের ভাই' হিসেবে খ্যাত আসাদুজ্জামান নূর। প্রায় তিন দশক আগে আলোড়ন সৃষ্টকারী জনপ্রিয় বাংলা নাটক 'কোথাও কেউ নেই' রচনা করেছিলেন কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ। নাটকের মূল চরিত্র 'বাকের ভাই' আলোড়ন সৃষ্টি করেছিল দর্শকদের মনে। সেই চরিত্রে অভিনয়কারী সাবেক সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর গ্রেপ্তার হয়েছেন। গত ১২ সেপ্টেম্বর ১১৪ জনকে আসামি করে নিহত সিয়াম সরদারের পিতা মো. সোহাগ সরদার বাদী হয়ে মামলা করেন। মামলার এজাহারনামীয় ৮নং আসামি হলেন আসাদুজ্জামান নূর। মামলার অভিযোগে বলা হয়, গত ১৮ জুলাই রাত ১১টার দিকে মিরপুর-১০ এ আবু তালেব স্কুলের সামনে আওয়ামী লীগসহ তাদের অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আসাদুজ্জামান খান কামালের নির্দেশে নির্বিচারে গুলি করে। এ সময় সিয়াম সরদার হোটেলের কাজ শেষে বাসায় ফিরছিলেন। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। জানা গেছে, বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল তারিক আনাম খানের। নাট্যকার ও প্রযোজকের সিদ্ধান্তে পরে চূড়ান্ত হন আসাদুজ্জামান নূর। এ কারণে দীর্ঘদিন হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে কাজ করেননি তারিক আনাম খান। তবে সে সময়ে আসাদুজ্জামান নূরই সত্যিকারের বাকের ভাই হয়ে জায়গা করে নেন কোটি ভক্তের হৃদয়ে। ১৯৯৩ সালের ২১ সেপ্টেম্বর 'কোথাও কেউ নেই'-এর শেষ পর্ব সেসময় তুমুল আলোচনার বিষয় ছিল। অঘোষিত কারফিউ দেওয়া হয় ধারাবাহিকটির মূল চরিত্র বাকের ভাইয়ের ফাঁসি না দেওয়ার দাবিতে। মিথ্যা মামলায় তাকে ফাঁসানো হয়। আগের পর্বে বদি (অভিনেতা আবদুল কাদের) মিথ্যা সাক্ষী দিতে যায় আদালতে। বাকেরের এই সাগরেদ কুত্তাওয়ালির হুমকিতে ভয় পেয়ে এই কাজ করেছে। পত্র-পত্রিকায় আগেই সংবাদ প্রচারিত হয়েছিল, বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হবে। সেই খবরে রাস্তায় নেমেছিল দর্শক। তাদের হাতে ছিল ব্যানার, পোস্টার। সেখানে লেখা 'বাকের ভাইয়ের ফাঁসি হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে', 'বদির দুই গালে, জুতা মারো তালে তালে', 'বাকের ভাইয়ের ফাঁসি কেন, কুত্তাওয়ালি জবাব চাই।' কিন্তু কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ নিজের সিদ্ধান্তে অনড়, বাকের ভাইকে তিনি ফাঁসি দেবেনই। দর্শকদের দাবির মুখে নিজের পরিকল্পনা থেকে তিনি সরে আসবেন না। শোনা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া ফোন করে ধারাবাহিকটির প্রযোজক বরকতউলস্নাহকে বলেছিলেন, 'হুমায়ূন আহমেদকে বলুন, বাকের ভাইকে বাঁচিয়ে রাখা যায় কি না...।' হুমায়ূন আহমেদ তবু রাজি হননি। শেষ পর্বটি প্রচারিত হওয়ার কথা ছিল আগের সপ্তাহেই। উত্তেজিত দর্শক শুটিং সেটে হামলা চালাতে পারে, এই ভয়ে শুটিং পিছিয়ে দেওয়া হয়। তাই শেষ পর্বটি প্রচারিত হলো নির্ধারিত দিনের পরের সপ্তাহে। সেদিন সন্ধ্যা নামার পর পুরো ঢাকা শহরে নেমে আসে নীরবতা, যেন অঘোষিত কারফিউ। প্রভাব পড়েছিল দেশের অন্য শহর, এমনকি মফস্বলেও। শেষ দৃশ্যে বাকেরের ফাঁসি হওয়ার পর সেদিন টিভি সেটের সামনে থাকা অনেক দর্শক নিজেদের আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি। যেন বাস্তবের কোনো নায়ককে হারিয়ে ফেলেছে তারা। মুনারূপী সুবর্ণা মুস্তফার কান্না ছুঁয়ে গিয়েছিল দর্শকদের। ভোরে কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে মুনা। জেলার এসে জানতে চান, 'আপনি আসামির কী হন?' উত্তরে মুনা বলেন, 'আমি ওর কেউ না।' মুনার মুখের এই সংলাপ দর্শকের হৃদয়ে হাহাকার বাড়িয়ে দেয়। বাকের ভাই চরিত্রে অভিনয় করে অভাবনীয় জনপ্রিয়তা পান আসাদুজ্জামান নূর। নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের বেশির ভাগ নাটকেই তিনি অভিনয় করতেন। এই নাটকে বাকের ভাই চরিত্রে হুমায়ূন আহমেদই তাকে নির্বাচন করেন। আসাদুজ্জামান নূর বলেছিলেন, 'দীর্ঘদিন ধরে 'অয়োময়' নাটকে অভিনয় করার কারণে আমার কণ্ঠে একটা ভারিত্ব ভাব চলে এসেছিল, আমি ওই চরিত্র থেকে বেরিয়ে আসতে পারছিলাম না। তখন বরকতউলস্নাহ ভাই আমাকে এই চরিত্র করতে বলেন। বললেন, আপনার এটা ভাঙতে হবে।' ধারাবাহিকটিতে আসাদুজ্জামান নূর এছাড়া আরও অভিনয় করেন মুনা চরিত্রে সুবর্ণা মুস্তফা, বদি চরিত্রে আবদুল কাদের, মজনু চরিত্রে লুৎফর রহমান জর্জ, মতি চরিত্রে মাহফুজ আহমেদ, বকুল চরিত্রে আফসানা মিমি, উকিল চরিত্রে হুমায়ুন ফরিদীসহ আরও অনেকে। উলেস্নখ্য, আসাদুজ্জামান নূর ১৯৪৬ সালের ৩১ অক্টোবর জন্মগ্রহণ করেন। তিনি অভিনেতা ও রাজনীতিবিদ। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার তৃতীয় মন্ত্রিসভায় বাংলাদেশের সংস্কৃতিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০১ সাল থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নে নীলফামারী-২ আসনের সংসদ সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।