বিগত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার আমলে বেশ কয়জন খ্যাতিমান শিল্পী গানের জগত থেকে কেউ একেবারে আড়াল হয়ে গেছেন, কেউ মৃদু আলোর মতো ধিকিধিকি জ্বলছিলেন। সেই নব্বই দশকে আসা একদল গানের পাখি কেন আর শ্রোতাদের কানকে প্রাণিত করছে না তার উত্তর দিতে গেলে অনেক কথা।
নব্বই দশকের জনপ্রিয় শিল্পী বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা, রিজিয়া পারভীন, ডলি সায়ন্তনী, শাকিলা জাফর, আলম আরা মিনু, রুক্সী, কানিজ সুবর্ণা ও মেহরীন। পুরুষ শিল্পীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে সঙ্গীতাঙ্গনে তারাসহ আরও কয়েকজন নিজের জায়গা শক্ত করেন। সিনেমা ও অডিও দুই মাধ্যমেই তাদের গানে শ্রোতারা মুগ্ধ হতেন। বিশেষ করে সিনেমার গানে বেবী নাজনীন, কনকচাঁপা, রিজিয়া পারভীন, ডলি সায়ন্তনীর ব্যস্ততা ছিল প্রতিদিন। একইসঙ্গে তারা অডিও অঙ্গনেও দাঁপিয়ে বেড়াতেন।
এখনো শ্রোতাদের মুখে মুখে তাদের গান শোনা যায়। টেলিভিশন কিংবা স্টেজে নতুন প্রজন্মের শিল্পীরা তাদের গাওয়া গানেই শ্রোতাদের মাতিয়ে তোলেন। তবে গেল কয়েক বছর ধরে নব্বইয়ের এ শিল্পীদের অনেকেই নতুন গান প্রকাশ করা থেকে দূরে ছিলেন। অডিও কিংবা সিনেমার কোথাও তাদের আগের মতো পাওয়া যায়নি। আবার কেউ কেউ দীর্ঘ সময় ধরে দেশের বাইরেও বাস করছেন। মাঝে মধ্যে চুপেচাপে দেশে ফিরলেও গান করেননি। ফলে নতুন প্রজন্মের গীতিকার-সুরকারদের সঙ্গেও তাদের বেশ দূরত্ব তৈরি হয়ে যায়। বিভিন্ন সময় সোশ্যাল মিডয়াসহ নানা মাধ্যমে দীর্ঘদিন ধরে প্রশ্ন উঠতে থাকে বাংলার গানের পাখিরা গেল কোথায়, সেই গানের পাখিরা নেই কেন? কী এক খা খা শূন্যতা অনুভব করতেন সুর বুভুক্ষু শ্রোতারা। তারা যে ছিলেন এতদিন শেখ হাসিনার কালো তালিকায়। তাই তারা গাইতে পারেননি।
এ কারণেই দীর্ঘদিন ধরে কনকচাঁপার কোনো গান নেই সিনেমাতে। অথচ একটা সময় প্রায় প্রতিটি সিনেমার গানেই তাকে পাওয়া যেত। সেই অবর্ণনীয় দুঃখের কথা কনকচাঁপা নিজেই জানিয়েছেন কী করে বিগত স্বৈরাচার হাসিনা সরকার ৭টি বছর যাবৎ বোবা করে রেখেছিল। তার কণ্ঠকে চাপা দিয়ে রেখেছিল সেই সরকার।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন শেষে নতুন অন্তর্র্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর মুখ খুলতে শুরু করেছেন এতদিন কালো তালিকায় থাকা দেশের অনেক গুণীশিল্পী। মুগ্ধ করেনি যাদের পেস্ন-ব্যাক।
নন্দিত কণ্ঠশিল্পী কনকচাঁপা জানিয়েছেন বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে তাকে পোহাতে হয়েছে অনেক ভোগান্তি। তিনি বলেন, হাসিনা সরকারের সময় প্রায় অর্ধযুগেরও বেশি সময় ধরে তাকে গান গাওয়া থেকে বিরত রাখা হয়েছিল।
এ প্রসঙ্গে কনকচাঁপা বলেন, 'আমি বিগত সাতটি বছর বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হয়েছি, তাতে মোটেই ভেঙে পড়িনি। আমি সবসময় হাসিখুশি থেকেছি। কখনো কাঁদিনি। কখনো হতাশ হইনি। যত সমস্যা এসেছে, কারো কাছে অভিযোগও করিনি।'
কনকচাঁপা আরও বলেন, 'আমাকে ৭ বছর যেভাবে বোবা করে রাখা হয়েছে তা বর্ণনাতীত। এমনকি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও কোনো কিছু লিখতে পারতাম না। শুধু তাই নয়, আমি গান গাইতে পারিনি। একজন শিল্পী যদি গান গাইতে না পারেন তবে বোবা হয়ে যাওয়াই ভালো।'
'গত ৭ বছরে আমার কোনো গান বেতার কিংবা বিটিভিতে প্রচার হয়নি। শিল্পকলা একাডেমিতে ডাকা হয়নি। নতুন শিল্পীদেরও গাইতে দেওয়া হয়নি আমার গান। আর সরকারি অনুষ্ঠানে তো আমি বস্ন্যাক লিস্টেডই ছিলাম।'
বলা হয়, শেখ হাসিনা ছিলেন সংস্কৃতমনা। কিন্তু এটাই কি সংস্কৃতিমনার পরিচয়? আসলে যারা 'আয়না ঘরের' মতো ভয়াল কুখ্যাত কারাগার তৈরি করতে পারে তারা আর যাহোক কিছুতেই সংস্কৃতমনা হতে পারে না। ওটা তার বাইরের ছদ্ম আবরণ। আসল নয়। সেইজন্যই বিগত সরকারের সময়ে গানের পাখিদের কণ্ঠ কোনো গান গাইতে পারেনি।
একইভাবে এ রকম গানে নেই বেবী নাজনীন, রিজিয়া পারভীন, ডলি সায়ন্তনীর মতো শিল্পীও। অনেকে আবার গানে কেন নেই এর উত্তরে কালো তালিকায় থাকার কথা এড়িয়ে যান মানসম্মানের ভয়ে। তখন গানে না থাকার কথা বলতে গিয়ে প্রকৃত সত্যটি চেপে ভিন্ন কথা বলেন।
এ প্রসঙ্গে ডলি সায়ন্তনী বলেন, আমরা যারা সিনেমার গান নিয়ে নিয়মিত ছিলাম তারা কেউ এখন আর আগের মতো নেই এটি সত্যি। এর কারণ হলো আমাদের সিনেমা একটা সময় নির্মাণ কমে যায়। একইসঙ্গে ভালো গানও তেমন হতো না। বিশেষ করে আমি যে ধরনের গান করি সিনেমার পাশাপাশি তেমন গানের সংখ্যাও কমতে থাকে। একই সঙ্গে আমাদের অনেক নির্মাতা দেশের বাইরের শিল্পীদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। যার ফলে আমাদের শিল্পীদের গানের সংখ্যা কমতে থাকে। তারা কি কারণে বা কেন দেশের বাইরের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা শুরু করেন সেটি আমার জানা নেই।
এর মধ্যে জেনারেশন একটা গ্যাপ হয়ে পড়েছে। নতুন প্রজন্মের সিনেমার অনেক সঙ্গীতপরিচালক আমাদের সঙ্গে কাজ করতেও সংকোচ বোধ করে বলে জানি। আমি মনে করি আমাদের সিনিয়র শিল্পীদের দিয়েও এখনো ভালো গান করা সম্ভব।'
সিনেমার গানে না থাকলেও ডলি সায়ন্তনী অডিওতে আবার নিয়মিত হচ্ছেন। গেল দু'বছরে বেশ কয়েকটি গান প্রকাশ হয়েছে তার। নিজের ইউটিউব চ্যানেল নিয়েও কাজ করছেন বলে জানান। এদিকে অডিও অঙ্গনে সে সময় গানের পাশাপাশি কানিজ সুবর্ণা ও মেহরীন নতুন স্টাইল নিয়ে এসে শ্রোতাদের মধ্যে সে সময় দারুণ সাড়া ফেলেন। তরুণদের মধ্যে এ দুই কণ্ঠশিল্পী ভীষণ প্রিয় ছিলেন। অডিও-সিডির বিলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে তারাও আড়ালে চলে যান। তাদের দু'জনের মধ্যে মেহরীন বর্তমানে নিজের চ্যানেলে দুই একটি গান প্রকাশ করলেও তার বিপরীতমুখী কানিজ সুবর্ণা।
সঙ্গীতশিল্পীদের মতে, 'অডিও-সিডি যুগের পরিবর্তনের পর নব্বই দশকের অনেক শিল্পীই নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেননি। ইউটিউব যুগে এসে অন্যরা যেখানে এগিয়ে গেছেন সেখানে নব্বই দশকের শিল্পীরা পিছিয়ে পড়েন। এখন অনেকে কামব্যাক করার চেষ্টা করছেন। কিন্তু আগের মতো জ্বলে উঠতে পারছেন না।
এই গুণীশিল্পীদের মধ্যে আছেন বেবী নাজনীন, মনির খান, আসিফ আকবর, কনকচাঁপা, রিজিয়া পারভিন, নাজমুন মুনিরা ন্যান্সি, মৌসুমী প্রমুখ।
এদের মধ্যে বেবী নাজনীন দীর্ঘদিন ধরেই যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন। বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ততার কারণে বাংলাদেশে তার পেশাগত কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায় আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলের শুরু থেকেই। এরপরেই বাংলাদেশে জেলজুলুমের ভয়ে যুক্তরাষ্ট্রেই থিতু হন তিনি।
তবে দেশের বাইরে থাকলেও রাজনীতিতে এখনো সক্রিয় এই সঙ্গীতশিল্পী। গত জুন মাসে বেবী নাজনীনকে বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মনোনীত করা হয়। জানা গেছে, আগামী মাসেই দেশে ফিরবেন বেবী নাজনীন। ৩০ আগস্ট কানাডার টরন্টোতে অনুষ্ঠিত কনসার্ট শেষে ঢাকায় ফেরার কথা রয়েছে তার।