আবুল হায়াত অভিনয়জগতের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র। দীর্ঘ সময় ধরে তিনি অভিনয় করছেন দেশের নাটক-চলচ্চিত্রে। তার দীর্ঘ ক্যারিয়ারে নেই
কোনো বিতর্কের দাগ, নেই কোনো ব্যর্থতা। প্রাপ্তির ঝুলিতে রয়েছে প্রশংসা আর
দর্শকদের ভালোবাসা।
আজ ৭ সেপ্টেম্বর এই বরেণ্য অভিনেতার জন্মদিন। নন্দিত এই অভিনেতা জন্মসূত্রে পশ্চিমবঙ্গের। ১৯৪৪ সালে সেখানকার মুর্শিদাবাদে তার জন্ম। তবে বাবার চাকরির সুবাদে বেড়ে উঠেছেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা বর্তমান বাংলাদেশের চট্টগ্রামে। পড়াশোনা করেছেন চট্টগ্রাম কলেজিয়েট ও রেলওয়ে উচ্চ বিদ্যালয়ে। সেখান থেকেই ম্যাট্রিক পাস। অতঃপর চট্টগ্রাম কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করে ঢাকায় পাড়ি জমান আবুল হায়াত। ভর্তি হন দেশের সেরা বিদ্যাপীঠ বুয়েটে। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ওপর স্নাতক সম্পন্ন করেন ১৯৬৭ সালে।
তারপরের বছরই চাকরিতে যোগ দেন। ঢাকা ওয়াসার প্রকৌশলী পদে চাকরি জীবন শুরু করেন। তার এক বছর পর ১৯৬৯ সালে অভিনয়ে নাম লেখান। 'ইডিপাস' নামের একটি নাটক দিয়ে তার অভিষেক হয় টিভি পর্দায়। ৬৯-এর গণ-অভু্যত্থানের সময় থেকে আজ অব্দি নিয়মিত অভিনয় করে চলেছেন আবুল হায়াত। অভিনীত নাটকের সংখ্যা ৫০০ ছাড়িয়ে। সিনেমা আর বিজ্ঞাপনেও তার উপস্থিতি সমানভাবে উলেস্নখযোগ্য।
বাংলা নাটক ও সিনেমার ইতিহাসে সবচেয়ে স্মরণীয় কিছু কাজ করেছে আবুল হায়াত। তার মধ্যে রয়েছে- 'আজ রবিবার', 'বহুব্রীহি', 'অয়োময়' ইত্যাদি। এসব নাটকে তার অভিনয় এখনো দর্শকদের মনে দাগ কেটে আছে। এছাড়া নন্দিত কথাসাহিত্যিক ও নির্মাতা হুমায়ূন আহমেদের বিখ্যাত চরিত্র 'মিসির আলি' রূপে অভিনয় করেও সুনাম কুড়িয়েছেন।
চলচ্চিত্রে আবুল হায়াতের উপস্থিতি স্মরণীয়। তার অভিনীত সিনেমাগুলোর মধ্যে রয়েছে- 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী', 'তিতাস একটি নদীর নাম', 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত', 'স্বপ্নের ঠিকানা', 'আগুনের পরশমণি', 'জয়যাত্রা', 'দারুচিনি দ্বীপ', 'থার্ড পারসন সিঙ্গুলার নাম্বার', 'গহীনে শব্দ' ও 'অজ্ঞাতনামা' ইত্যাদি। নির্মাতা হিসেবেও সফল তিনি। তার নির্মিত বহু নাটক দর্শকপ্রিয় হয়েছে। 'জোছনার ফুল', 'দেওয়ান গাজীর কিসসা' বিখ্যাত নাটকগুলো তারই পরিচালিত।
লেখক হিসেবেও আবুল হায়াত দারুণ দক্ষ। সেই নব্বই দশকের সূচনালগ্ন থেকে তার লেখা বই প্রকাশ হয়ে আসছে। প্রথম উপন্যাস 'আপস্নুত মরু' প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯১ সালের বইমেলায়। এরপর একে একে প্রকাশ হয় 'নির্ঝর সন্নিকট', 'এসো নীপ বনে', 'অচেনা তারা', 'জীবন খাতার ফুট নোট' ও 'জিম্মি' বইগুলো।
বরেণ্য এ অভিনেতা দীর্ঘদিন ধরেই তার আত্মজীবনী লিখছেন। সম্প্রতি তার এই লেখা শেষ হয়েছে। আত্মজীবনী লিখতে তার দশ বছর সময় লেগেছে। বইটির নাম দিয়েছেন 'রবি পথ'। বইটির নামকরণ প্রসঙ্গে আবুল হায়াত জানান, তার ডাকনাম রবি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সূত্রে তার বাবা আদর করে তাকে রবি ডাকতেন। সেখান থেকেই বইয়ের নাম 'রবি পথ' রাখা হয়েছে। এ গ্রন্থের মাধ্যমে উঠে এসেছে তার শৈশব থেকে আজকের আবুল হায়াত হওয়ার কথা। আবুল হায়াত জানান, বইটি লিখতে ১০ বছর সময় নিয়েছেন। যদিও বইটি হবে প্রায় ৩শ' পৃষ্ঠার। প্রকাশ করবে সুবর্ণ প্রকাশনী। এত সময় লাগার কারণ হিসেবে আবুল হায়াত বলেন, আমি আসলে খুবই অলস প্রকৃতির লোক। একটু লিখি, আবার ফেলে রাখি। দেখা গেল, কোনোদিন এক চ্যাপ্টার লিখেছি, কোনোদিন এক পৃষ্ঠা, তারপর বহুদিন লিখিইনি। মূলত বড় মেয়ে বিপাশার চাপে লেখাটা শেষ করতে হয়েছে। কারণ কিছুদিন পর পর ওর তাগাদা আর নিতে পারছিলাম না। এরমধ্যে ছোট মেয়ে নাতাশা প্রকাশনীও ঠিক করে রেখেছে। বলা যায়, ওদের দুজনের চাপে পড়েই লেখাটা ১০ বছরের মাথায় শেষ করতে পারলাম। তিনি জানান, তার দুই মেয়ের ইচ্ছে ছিল, আজ ৭ সেপ্টেম্বর তার ৮০তম জন্মদিন উপলক্ষে বইটি প্রকাশ করবেন। সেটি সম্ভব না হলেও, সেপ্টেম্বরেই গ্রন্থটি প্রকাশ করা হবে। তিনি জানান, আত্মজীবনীতে তার জন্ম থেকে এই পর্যন্ত যেগুলো আমার মনে হয়েছে বলা দরকার, সেগুলোই লিখেছি। আসলে লিখতে গেলে বোঝা যায়, কোনটা লেখা দরকার, আবার মনে হয়েছে অনেক কিছু না লিখলেই ভালো। আশা করছি, সবকিছু মিলিয়ে গ্রন্থটি থেকে আমার পুরো যাত্রাপথ জানা যাবে। গ্রন্থটির প্রচ্ছদ অলংকরণ করছেন তার মেয়ে অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী
\হবিপাশা হায়াত।
ব্যক্তিগত জীবনে আবুল হায়াত বিয়ে করেছেন মাহফুজা খাতুন শিরিনকে। তাদের প্রথম সন্তান বিপাশা হায়াত। তিনি দেশের একজন জনপ্রিয় অভিনেত্রী ও চিত্রশিল্পী। আবুল হায়াত-মাহফুজা খাতুন দম্পতির দ্বিতীয় সন্তান নাতাশা হায়াত।
অভিনয়শিল্পে অনন্য অবদান রাখলেও আবুল হায়াতের প্রাপ্তি কমই বলা চলে। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের খুব বেশি সম্মাননা তার ভাগ্যে জোটেনি। কেবল 'দারুচিনি দ্বীপ' সিনেমার জন্য সেরা পার্শ্বচরিত্রের অভিনেতা হিসেবে একবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন।