দেশের যেকোনো খারাপ পরিস্থিতিতে এগিয়ে আসতে দেখা যায় জনপ্রিয় অভিনেতা সিয়াম আহমেদকে। শিক্ষাদীক্ষায় নিজে ল' ইয়ার। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে শুরু করে দেশে চলমান বন্যায় মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন এ অভিনেতা। শুরু থেকেই বাংলাদেশের বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে রাজপথ থেকে শুরু করে ফেসবুক সব জায়গাতেই ছিলেন। স্বৈরাচারবিরোধী শাসনব্যবস্থার প্রতিবাদ করেছেন। বক্তৃতা, বিবৃতি দিয়েছেন তিনি।
দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়ে ওঠেনি, যার কারণে শুটিংয়ে ফিরতে পারছেন না এখনই। অপেক্ষা করছেন সঠিক সময়ের। এখন আবার শিল্পীদের মাঝে তৈরি হয়েছে নতুন টানাপড়েন। কারণ বিগত স্বৈরাচার সরকারের হয়ে কাজ করেছেন অনেক শিল্পী-কলাকুশলী। তাদের সঙ্গে কাজ করা বা না করা নিয়েও ব্যাপার-স্যাপার আছে। এরকমই যেমন দেখা গিয়েছে শিল্পীদের মাঝে বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে। অনেকেই কাজ পেতেন না। তবে এবারের আন্দোলন যেহেতু ছাত্র-জনতার বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন, কাজেই এবারের হিসাবটি গতবারের হিসাবের থেকে ভিন্ন। কুকুর কামড় দিলে তাকেও কামড় দিতে হবে এমন হিসাবের নয়। এক্ষেত্রে চলতি সময়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কারের কথা বলছেন অভিনেতা সিয়াম আহমেদ।
এ বিষয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের যে সংগঠনগুলো অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে কাজ করে, তারা যেন কোনো রাজনৈতিক দলের না হয়। রাজনৈতিক দলের হলে সে কখনো তার অভিনয়শিল্পীদের দাবিগুলো নিরপেক্ষভাবে তুলে ধরতে পারবেন না।'
এটা দেখা গেছে বিগত স্বৈরাচার সরকারের সময়ে। শিল্পীরা দল করছেন। রাজনীতি করছেন। বক্তৃতাও দিচ্ছেন। এই শিল্পীরা দেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে কলুষিত করেছেন। রোকেয়া প্রাচী, শমী কায়সার, ফেরদৌস আহমেদ প্রমুখ শিল্পীরাও ন্যক্কারজনকভাবে শিল্প-সংস্কৃত অঙ্গনকে কলুষিত করছেন।
সেন্সর বোর্ড নিয়েও ছিল রাজনীতি। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা হতো একটি সিনেমাকে। রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেই কোনো কোনো ছবিকে আনকাট সেন্সর ছাড়পত্র দেওয়া হতো, কোনোটিতে অনেক কাটাছেঁড়া হতো। কোনোটিকে মুক্তিই দেওয়া হতো না। এই সেন্সর বোর্ডের কারণে 'রানাপস্নাজা', 'শনিবারের বিকেল', 'মেকআপ', 'বাংলার ফাটাকেষ্ট', 'ধাবমান', 'মর থেঙ্গারি', 'নমুনা', 'হরিবোল'র মতো অনেক ছবি মুক্তিই দেওয়া হয়নি বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে।
'বর্ডার' সিনেমাটিকে মুক্তি দেওয়ার শর্ত হিসেবে নাম বদলাতে নির্দেশ দেয় সেন্সর বোর্ড। পরে 'সুলতানপুর' নাম দিয়ে মুক্তি দেওয়া হয়। ফলাফল যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। ব্যবসায়িকভাবে চরম মার খেয়েছে। অথচ 'বর্ডার' সিনেমার ভারতেও হয়েছে। বর্ডার নামে সেখানে ছাড়পত্র পেলেও ভারতকে খুশি রাখতে বাংলাদেশে দেওয়া হয় না।
সেন্সর বোর্ড নিয়ে সিয়াম বলেন, 'সেন্সর নিয়ে তো অনেক প্রশ্ন আছেই। সেন্সরের কারণে অনেক ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়। সিনেমার গল্প বলার সময় বাধ্যবাধকতা থাকায় স্বাধীনভাবে নির্মাণ সম্ভব হয় না। সিনেমা তো একটা আর্ট। সিনেমা এগোবে গল্পের প্রয়োজনে। পরিচালক চাইলেও পর্দায় অনেক কিছু দেখাতে পারেন না। পরিচালক ও অভিনয়শিল্পীদের সে স্বাধীনতা দিতে হবে। সিনেমায় কাজের জন্য যদি কোর্টে যাওয়া লাগে বা লিগ্যাল নোটিশ দেওয়া হয়, সেগুলো তো একজন শিল্পীর জন্য খুব ভয়ংকর।'
বাংলা সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে এ অভিনেতা বলেন, 'এ মুহূর্তে আমাদের সংঘবদ্ধভাবে কাজ করতে হবে। সবাই এক হয়ে কাজ করলেই শুধু সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে জাগরণ তৈরি করা সম্ভব। এখানে অনেকেই আছেন, যাদের উপার্জন নির্ভর করে এ ইন্ডাস্ট্রির ওপর। যারা চাকরিজীবী, তারা দুদিন পরে তাদের কর্মক্ষেত্রে যোগ দিয়েছেন। এখন যদি সিনেমায় কাজ না হয়, তাহলে ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত মানুষের অর্থের জোগান হবে না। তারা তো চুরি-ডাকাতি করবেন না। তারা ক্রিয়েটিভ সেক্টরে কাজ করেন। তাদের সে কাজের জায়গা করে দিতে হবে। একটা প্রডাকশন যদি কাজ শুরু করতে না পারে, তাহলে আরো ২০০ জন মানুষ আয় করতে পারবে না। তাদের আয়ের রাস্তাটা বন্ধ হয়ে থাকবে।'
শিল্পীদের মধ্যে রয়েছে বিভাজন। সব শিল্পীর সংঘবদ্ধ হওয়ার ব্যাপারে সিয়াম বলেন, 'আমাদের শিল্পীদের মধ্যে বিভাজন তৈরি হয়ে গেছে। কিন্তু সত্যটা হলো বিভাজনের বিষয় নিয়ে কেউ একটা কথাও বলেনি। বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের আলাদা চিন্তা-চেতনা আছে। কিন্তু খেলার সময় তো তারা বাংলাদেশের জন্য খেলে। তারা যখন মাঠে খেলতে নামে, সেখানে তো কারও কোনো দ্বিমত নেই। তেমনি আমরা যখন একটা সিনেমায় কাজ করি, (আর্ট, ক্যামেরা, লাইট ও মিউজিক) সবাই একটা চিন্তা নিয়েই মাঠে নামি, ভালো সিনেমা নির্মাণ করা, যেন বাংলাদেশের দর্শক সিনেমা দেখে এবং পছন্দ করে। রাজনৈতিক পরিচয় দেয়ার সময় পার করে এসেছি, এখন সবাইকে এক উদ্দেশে কাজ করতে হবে। একজন আরেকজনের মধ্যে বিভাজন সারা জীবন থাকবে। কারও সাদা পছন্দ আবার কারও কালো। কিন্তু কাজের মধ্যে এসে বৈষম্য করা যাবে না। এ জায়গাগুলো সংস্কারে আমাদের ইন্ডাস্ট্রিতে যারা মুরুব্বি আছেন এবং শিল্পীদের নিয়ে কাজ করেন, এমন সংগঠনগুলোকেই পদক্ষেপ নিতে হবে। তারা অভিনয় শিল্পীদের দাবি, চাওয়া-পাওয়া তুলে ধরবে। ইন্ডাস্ট্রিতে একটা সিনেমা এলে আমরা যদি সাপোর্ট করতে না পারি, তাহলে আমরা শুধু পেছাতেই থাকব, কখনো এগোতে পারব না।