নজরুল কবি প্রতিভার সর্বত্তোম বিকাশ ঘটেছে তাঁর সঙ্গীত সৃষ্টিতে। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম যুগ-স্রষ্টা কবি, অনন্য সাধারণ গীতিকার, সূরকার ও সঙ্গীত স্রষ্টা কাজী নজরুল ইসলাম বাংলায় অসংখ্য গান রচনা করেছেন। তাঁর রচিত গানের সংখ্যা সঠিকভাবে নিরুপিত না হলেও এ পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী সে সংখ্যা প্রায় সাড়ে তিন হাজার।
নজরুল রচিত এ পর্যন্ত প্রাপ্ত সাড়ে তিন হাজার গানের মধ্যে উলেস্নখযোগ্য সংখ্যক গান হিন্দি ভাষায় এবং কিছু কিছু গান উর্দূ ও ফারসি ভাষায় রচিত। মূল হিন্দি ভাষার গান রচনা করা ছাড়াও নজরুল তার অনেক বাংলা গানের হিন্দি রূপান্তর করেছেন। তিনি যেমন অনেক হিন্দি গানের রচয়িতা তেমনি সূরকারও।
নজরুল আরবি, ফারসি, উর্দূ, হিন্দি, সংস্কৃত ইত্যাদি ভাষায় যে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ছিলেন, তিনি যে তার বহু কবিতা গান ও অন্যান্য রচনায় অসংখ্য আরবি, ফারসি, উর্দূ, হিন্দি, সংস্কৃত শব্দও শব্দ বন্ধ নৈপুণ্যের ব্যবহার করেছেন, তা সুবিদিত।
গবেষণায় জানতে পারা যায় নজরুল ৩টি হিন্দি ছায়া ছবিতে কাহিনী কার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন বলে অনুমান করা হয়। ছবি তিনটি হলো বিদ্যাপতি (১৯৩৮ খ্রি.), সাপেড়া (১৯৩৯ খ্রি.) ও চৌরঙ্গী (১৯৪২ খ্রি.)।
বিদ্যাপতি ছায়াছবি (হিন্দি) ১৯৩৮ সালের ৪ঠা ডিসেম্বর করাচি ও বম্বেতে একযোগে মুক্তিলাভ করে। এই হিন্দি বিদ্যাপতি ছবিতে নজরুলের লেখা গান ও সুর ব্যবহৃত হতে পারে বলে অনেকে অনুমান করেন। এই হিন্দি ছবিতে মোট ক'টা গান ছিল এবং সেগুলো সঠিক কার রচনা ছিল, কোন কোন শিল্পীর কন্ঠে গীত হয়েছিল এ তথ্য আজও পাওয়া সম্ভব হয়নি। তবে চলচ্চিত্রের সঙ্গীত পরিচালক রাইচাঁদ বড়ালের স্মৃতি চারণ থেকে জানা যায় নজরুল এই চলচ্চিত্রের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন এবং সঙ্গীতের ক্ষেত্রে ও তাঁর বেশ অবদান রয়েছে (তথ্য সূত্র : গানের কাগজ : কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি সংখ্যা, চতুর্থ বর্ষ, ষষ্ঠ সংখ্যা, নভেম্বর ১৯৭৬, প্রবন্ধ: কাজীদা' কে যতটুকু জানি)। এ ছবির মাধ্যমে নজরুলের সুনাম লাহোর, করাচি, মুম্বাই, কলকাতা, ঢাকা, সিলেট, বরিশাল, চট্টগ্রাম হয়ে সুদুর রেঙ্গুন পর্যন্ত পৌঁছায়।
\হনজরুলের সাপেড়া ছায়াছবি হিন্দি ১৯৩৯ সালের ২৪ জুন বোম্বে এবং করাচিতে ছবিটি মুক্তি লাভ করে। এই ছবির সঙ্গীত পরিচালক রাঁইচাদ বড়ালের স্মৃতি চারণের পরিপ্রেক্ষিতে জানা যায়। এই নজরুল হিন্দি চলচিত্রের সাথেও ওতপ্রোত ভাবেই জড়িত ছিলেন। এই ছবির কাহিনীকার, গীতিকার ও সুরকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। সব গানের সুরকার নয় শুধু তাঁর নিজের রচিত গানের সুরকার ছিলেন। সাপুড়ে ছবির গান (হিন্দি সাপেড়া) নজরুল কে চলচ্চিত্রে খ্যাতি এন দেয়। নজরুলের সর্বশেষ হিন্দি চৌরঙ্গী ছবিটি পরিচালনা করেন এস. ফজলি। ছবিতে গানের সংখ্যা মোট ১৩টি। এর মধ্যে ৭টি গানের গীতকার ও সুরকার ছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। নজরুলের ৭টি 'হিন্দী চৌরঙ্গীর' ছায়া ছবির গান ও সুর সে সময়ে যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়েছিল। চির কালের জন্য বাকরুূদ্ধ হয়ে যাওয়ার আগে কাজী নজরুল ইসলাম সিনেমার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন, ফজলী ব্রাদার্সের 'হিন্দী চৌরঙ্গী' ছবির সূত্রে। তাতে গীত রচনা এবং দূর্গা সেনের সঙ্গে যুগ্ম ভাবে সঙ্গীত পরিচালনা করেছিলেন নজরুল। কিন্তু ছবিটি মুক্তি পায় ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। বিদ্রোহী কবি বাকরুদ্ধ হয়ে যাবার দু'মাস পরে (নজরুল বাকরুূদ্ধ হন ১৯৪২ সালের ১০ জুলাই)। এরপর নজরুল আর সশীরের কোনো চলচিত্রের সাথে যুক্ত হতে পারেন নাই। এ' এক অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস।