বন্যার্তদের পাশে দাঁড়াল থিয়েটার

প্রকাশ | ২৭ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
বটতলা নাট্যদলের 'বন্যথেরিয়াম' নাটকের একটি দৃশ্য
বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে ঢাকার থিয়েটার গ্রম্নপগুলো। নাটকের প্রদর্শনী থেকে পাওয়া অর্থ দিয়ে বন্যার্তদের সহায়তার সিদ্ধান্ত নিয়েছে একাদিক নাট্যদল। এর মধ্যে অন্যতম এথিক, বটতলা ও অনুস্বর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের জেরে স্থবির হয়ে পড়েছিল নাট্যাঙ্গন। এক মাসের বেশি সময় ধরে বন্ধ ছিল মঞ্চনাটকের প্রদর্শনী। বিরতি কাটিয়ে গত শনিবার এথিক নাট্যদলের 'হাঁড়ি ফাটিবে' দিয়ে ঢাকার মঞ্চে ফিরেছে নাটক। বাংলাদেশ মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে সন্ধ্যা ৭টায় মঞ্চস্থ হয় নাটকটি। মিন্টু সরদারের নির্দেশিত এ নাটকের প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত অর্থ তুলে দেওয়া হবে বন্যার্তদের মধ্যে। এথিকের সভাপতি রেজানুর রহমান বলেন, 'দেশের মানুষের প্রতি আমাদের দায়বদ্ধতা রয়েছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই নাটকের টিকিট বিক্রির অর্থ বন্যার্তদের সাহায্যার্থে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।' অভিনয়ে রয়েছেন মনি কাঞ্চন, সুকর্ণ হাসান, মিন্টু সরদার, হাসান রিজভী, মনিরুল হক ঝলক, আজিম উদ্দীন, মাহফুজা আফনান অপ্সরা প্রমুখ। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বটতলা মঞ্চে আনছে তাদের দর্শকপ্রিয় নাটক 'বন্যথেরিয়াম'। ৩০ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টায় মহিলা সমিতিতে প্রদর্শিত হবে নাটকটি। এই নাটকের প্রদর্শনী থেকে প্রাপ্ত সব অর্থ বন্যাদুর্গত এলাকার শিশুদের জন্য ব্যয় করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে নাট্যদলটি। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বন্যথেরিয়াম নাটকের নির্দেশক ইভান রিয়াজ। তিনি বলেন, 'প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর এই বিশেষ প্রদর্শনীর টিকিট বিক্রির পুরো টাকা বন্যাদুর্গত এলাকার শিশুদের জন্য দেওয়া হবে। এদিন আমরা শিশুদের জন্য পোশাকও সংগ্রহ করব। জলপুতুল পাপেটসকে আমরা সেগুলো দিয়ে দেবো। তারা শিশুদের কাছে পৌঁছে দেবে। এ ছাড়া বিকেল ৪টা থেকে শিশুদের জন্য থাকছে 'ড্র উইদ কাটুন পিপল'। অভিভাবকদের আহ্বান করব, আপনার শিশুকে সঙ্গে নিয়ে চলে আসুন।' একই দিন পাইওনিয়ার রোড সেগুনবাগিচার অনুস্বর স্টুডিওতে বিকেল ৫টা ও সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রদর্শিত হবে অনুস্বরের দশম প্রযোজনা 'বিবিধ শোক অথবা সুখ'। এ নাটকের টিকিট বিক্রির অর্থ যাবে বন্যার্তদের তহবিলে। গতকাল বিষয়টি নিশ্চিত করে অনুস্বরের ফেসবুক পেজে লেখা হয়েছে, 'জীবনে সংকট থাকবেই। সবকিছুর পাশাপাশি আমাদের সাংস্কৃতিক জীবন শুরু হোক। প্রদর্শনীর টিকিট থেকে প্রাপ্ত অর্থ বন্যার্তদের তহবিলে দেওয়া হবে।' ব্রিটিশ নাট্যকার ডেভিড হেয়ারের 'দ্য ভার্টিক্যাল আওয়ার' নাটকটি 'প্রলম্বিত প্রহর' নামে ভাষান্তর করেছেন অধ্যাপক আবদুস সেলিম। তাঁর অনুমতি নিয়ে নাটকটি নিজের মতো করে সাইফ সুমন লিখেছেন বিবিধ শোক অথবা সুখ নামে। নির্দেশনাও দিয়েছেন তিনি। এছাড়া বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য তহবিল সংগ্রহে নাটক 'দুঃশাসন' মঞ্চায়ন করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) নাট্য সংসদ। গত রোববার সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় বিশ্ববিদ্যালয়ের থিয়েটার অ্যান্ড পারফরম্যান্স স্টাডিজ বিভাগে নাটকটি অনুষ্ঠিত হয়। নাটক থেকে অর্জিত সমস্ত অর্থ বন্যার্ত মানুষের ত্রাণ ও উদ্ধার কাজে ব্যয় করা হয়েছে। নাটকটির নির্দেশনায় ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নাট্য সংসদের সভাপতি প্রজ্ঞা চন্দ। নির্দেশনা সহকারী হিসেবে আছেন সুপ্রিয় ঘোষ ও মোশারফ খান, সঙ্গীত ভাবনা প্রণব বালা ও নাজমুল হোসেন, মঞ্চ পরিকল্পনায় তাপস সরকার রুদ্র। নাটকে অভিনয় করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাপস সরকার রুদ্র, মোশারফ খান, সুপ্রিয় ঘোষ, সায়র নিয়োগী, কাজী সাজ্জাদুর রহমান, এমদাদুল হক বাঁধন, জয়শ্রী চৌধুরী জয়া, বিশাখা আহমেদ ইরা, মারিয়া মালিকা, ইয়াসির আরাফাত, আশফাকুল ইসলাম, অর্ণব সোম, জিনিয়া জাফরিন খান জুঁই, ফুয়াদ হাসান প্রত্যয়, লাক মাহমুদ জাকারিয়া। নির্দেশক প্রজ্ঞা চন্দ বলেন, থিয়েটারের অন্যতম উদ্দেশ্য মানুষের কল্যাণের জন্য কাজ করা। দেশের এই সংকটকালে বন্যার্ত অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক কর্তব্য। কোটা সংস্কার আন্দোলন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে কারফিউ জারির পর শিল্পকলায় নাট্যকর্মীদের আনাগোনা একেবারেই কম ছিল। তা ছাড়া এমনিতেই স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশের থিয়েটার গ্রম্নপগুলোতে আওয়ামী ভাবাপন্ন কর্মীই বেশি দেখা যায়। তারা যতো নাটক মঞ্চস্থ করে বেশির ভাগই আওয়ামী ভাবাপন্ন। মুক্তিযুদ্ধ, রাজকার এই বুলি নিয়েই সাজানো হয়ে থাকে তাদের নাটকের সংলাপ। এগুলো সমাজের গভীর বিষয়গুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়। সমাজকে একতাবদ্ধ করার বদলে বিভক্ত করাই তাদের নাটকের মূল ভাব। মূল কথা হচ্ছে বাংলাদেশের থিয়েটারগুলো সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিতে সবচে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে তাদের নাটকের মধ্যে। স্বাধীনতা ৫৪ বছরের ইতিহাসে বাঙালির জীবনে যে এতো বিভেদ আর বৈষম্য তার মূলেই এই থিয়েটার কর্মীরা। পরে তারাই আবার ছোটপর্দায় ছড়িয়ে যায় তাদের এই সামাজিক বৈষম্য জারি রাখার একই মিশন নিয়ে। পাকিস্তানের সময়ে যতখানি বৈষম্যের মধ্যে ছিল বাংলাদের মানুষ সেই বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর শতগুণে বেড়ে যায় এই বৈষম্যতা। পাকিস্তান আমলেও বাংলাদেশে গ্রামীণ জনপদগুলোতে যেরকম হিন্দু-মুসলিম সদ্ভাব দেখা যেতো স্বাধীনতার পর সেটা ভেঙে চুরে বহুধা বৈষম্যের সৃষ্টি হয়। হিন্দু হয়ে যায় যেন শুধু একটি দলের সম্পত্তি। এটার প্রতিরোধে বাংলাদেশের থিয়েটারগুলো কিছুই করেনি। বরং আরও বেশি ইন্ধন ধরিয়ে দিয়েছে তাদের নাটকের সংলাপের মধ্যদিয়ে। কাজেই ছাত্র আন্দোলন যদি সফল না হতো সেই বৈষম্য যুগ যুগ চলতে থাকত। এখন একটা সুযোগ এসেছে এই বৈষম্য দূর করার। তাতে নতুন থিয়েটার গ্রম্নপ কিছু একটা করতে পারে। একারণেই নাটকের মধ্যদিয়ে সর্বদা সামাজিক বৈষম্য সৃষ্টিকারী পুরানো থিয়েটারগুলো মধ্যেও এক ধরনের আতঙ্ক বিরাজ করে। ছাত্ররা আবার তাদের চড়াও হয় কিনা। আওয়ামী মেজাজের থিয়েটার অঙ্গনগুলো তাই বুঝে উঠতে পারছে না বর্তমান কী করবে। ফলে দেশের পরিস্থিতির স্বাভাবিক হতে শুরু করলেও জমেনি শিল্পকলার নাটকপাড়া। একাডেমির পরীক্ষণ থিয়েটার হলে গত ১৬ জুলাই ছিল দেশ নাটকের 'নিত্যপুরাণ' নাটকের সর্বশেষ প্রদর্শনী। ছাত্র-জনতার আন্দোলন নিয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে তা বাতিল হয়ে যায়। এরপর একে একে বন্ধ হয়ে যায় সব নাটকের শো। চলতি সপ্তাহে শিল্পকলা একাডেমির মূল মিলনায়তন, পরীক্ষণ থিয়েটার হল ও স্টুডিও থিয়েটার হলে বেশ কয়েকটি নাটক মঞ্চায়নের জন্য শিডিউল ছিল। নাট্যকর্মীরা মঞ্চে ফেরার অপেক্ষায় থাকলেও শিল্পকলা একাডেমির নাট্যমঞ্চগুলো কবে খুলবে তা বলতে পারছেন না সংশ্লিষ্টরা। সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব মামুনুর রশীদ বলেন, 'দ্রম্নত মানুষের সাংস্কৃতিক জীবনে ফিরে আসা উচিত। এর জন্য নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা দরকার। বর্তমান সরকার সেটি করার চেষ্টা করছে। অনেক দিন শিল্পকলায় নাটক মঞ্চায়ন হয়নি। থিয়েটারে মানুষ নাটক দেখার জন্য উন্মুখ হয়ে আছে। কাজেই শিল্পকলা একাডেমি খুলে দেওয়া উচিত বলে মনে করি। মানুষ আবার নাটকমুখী হোক এটাই চাইছি।' মঞ্চ সারথি আতাউর রহমান বলেন, 'কোটা সংস্কার আন্দোলন ও কারফিউর কারণে অনেক দিন শিল্পকলার তিনটি হলে নাটক মঞ্চায়ন হচ্ছে না। এটা খুবই হতাশার খবর। ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠানটির মহাপরিচালক পদত্যাগ করেছেন। এখন নতুন নতুন পরিবর্তন আসবে। তখন হয়তো নাটক প্রদর্শনী শুরু হবে। খুব দ্রম্নত নাটক মঞ্চায়ন শুরু হোক একজন সংস্কৃতিকর্মী হিসেবে এটাই চাওয়া।'