'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে রে।' এইটা বাংলা লোকগানের একটা পংক্তি। এই গানের পংক্তিটিরই অবস্থা বাংলাদেশের মিষ্টি প্রেমের অভিনেতা হিসেবে আলোচিত ফেরদৌস আহমেদের। ঢাকাই সিনেমার জনপ্রিয় চিত্রনায়ক। রুপালি পর্দায় দাপিয়ে বেড়ানোর পর সক্রিয় হন রাজনীতির মাঠে। হয়েছিলেন রূপালি পর্দা থেকে মাঠের নায়ক। দীর্ঘদিন ধরে আওয়ামী লীগের পেছনে ঘুরঘুর করছিলেন এমপি হতে। শ্বশুর এমপি ছিলেন, তিনি মারা গেলে সেই আসনেও দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, পারেননি। এরপর চলচ্চিত্রের আরেক মিয়া ভাইখ্যাত ফারুক মারা গেলে তার আসন থেকেও দাঁড়াতে চেয়েছিলেন, পারেননি। শেষমেশ পেয়েছিলেন ধানমন্ডির মতো ঢাকা-১০ আসনে। প্রথমবারের মতো জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে জয়লাভ করেছিলেন তিনি।
কিন্তু এই নির্বাচন কেমন হয়েছে দেশবাসীসহ সারা বিশ্ববাসীই জানে। এমন একটা বাজে নির্বাচনে জয়ী হয়ে এমপি হলেন। ব্যস, দাগ লেগে গেলো তার গায়ে আওয়ামী লীগের, শেখ হাসিনার সকল অপকর্মের।
পৃথিবীর ভয়ঙ্কর দৈত্যকায় নৃশংস একটি সরকার আওয়ামী সরকার। এটা কি ফেরদৌস এই দলে প্রবেশের আগে জানতেন না? তা না জানতেই পারেন। কিন্তু প্রবেশের পরও কি জানতেন না? তা তো না জানার কথা নয়। একজন মানুষ শিল্পী হয়েও কি এমন দলে থাকতে পারে? পিলখানা ঘটনার কথা কে না জানে। আর বিশ্বের সের কুখ্যাত কারাগারের একটি 'আয়না ঘর'। এটা দলের বাইরে থাকলে না জানতে পারেন। কিন্তু দলে প্রবেশের পর তো আর না জানার কথা। তারপর কি এমন নৃশংস স্বৈরাচার শেখ হাসিনার দলে থাকা যায়? তাও একজন মিষ্টি প্রেমের নায়কের পক্ষে?
ছাত্র-জনতার এক দফা দাবির জেরে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন। এখন নেত্রী ছাড়া তিনি দেশে থাকেন কেমনে! শেখ হাসিনার দেশত্যাগের খবরের পর সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি গা ঢাকা দেন, দেশ ছেড়ে পলায়ন করেন। একদিন পরেই ভেঙে দেওয়া হয় সাত মাসের সংসদ।
এরপরই প্রশ্ন ওঠে মন্ত্রিসভার যারা দেশে রয়ে গেছেন, তারা এখন কে কোথায় রয়েছেন? বিশেষ করে চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ। এই শিল্পী কি দেশ ছেড়েছেন, নাকি দেশেই কোথাও গা-ঢাকা দিয়েছেন?
সূত্র মতে, গত ৪ আগস্ট রাত পর্যন্ত ঢাকাতেই অবস্থান করছিলেন ফেরদৌস। কেননা, এর দুই দিন আগেও বিটিভিতে হাজির হয়ে টেলিভিশন চ্যানেলটির ওপর হামলা নিয়ে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন তিনি। তবে ৬ আগস্ট থেকে ফেরদৌসকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এই নায়কের ব্যবহৃত মোবাইল নম্বরটিও বন্ধ পাওয়া যাচ্ছে। তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টেও ৪ আগস্টের পর কোনো স্ট্যাটাস শেয়ার করতে দেখা যায়নি।
আসলেই 'ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দে'। কাঁদতে কাঁদতে দিনকাল যাচ্ছে তার। নিশ্চয় এই মুহূর্তে একদমই সময়টা ভালো যাচ্ছে না অভিনেতা ফেরদৌসের। সাত মাসের মাথায় হারিয়েছেন সংসদ সদস্য পদ। এর পর থেকে আওয়ামী লীগের অন্য এমপিদের মতো ফেরদৌসও দিলেন ইঁদুর দৌড়। আছেন এখন অজানা গন্তব্যে। কোনো খোঁজ মিলছে না তার। এবার জানা গেল, ছাত্র আন্দোলনে নীরব থাকায় টালিউডের একটি সিনেমা থেকে বাদ পড়েছেন তিনি।
অর্কদীপ মলিস্নকা নাথের 'মীর জাফর চ্যাপ্টার টু' সিনেমায় অভিনয় করার কথা ছিল ফেরদৌসের। গতকাল সিনেমার প্রযোজক রানা সরকার জানালেন, এ সিনেমায় আর থাকছেন না ফেরদৌস। রানা সরকার বলেন, 'সিনেমাটি দুই বাংলার দর্শকদের টার্গেট করে বানানোর পরিকল্পনা করা হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষের, বিশেষত ছাত্রদের আবেগের কথা মাথায় রেখে, আমার কোনো সিনেমায় বাংলাদেশের এমন কোনো অভিনেতা বা অভিনেত্রীদের কাস্টিং করব না, যারা বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষে ছিলেন না। সে হিসেবেই ফেরদৌসকে আমরা সিনেমাটিতে রাখছি না। এ ছাড়া তিনি কিছুদিন ধরে রেসপন্স করছিলেন না। গত জানুয়ারি থেকে বারবার যোগাযোগ করার
পরেও তার কাছ থেকে সাড়া পাইনি।'
গত বছরের শুরুর দিকে অভিনয়শিল্পীদের লুক প্রকাশ করে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা করা হয়েছিল মীর জাফর চ্যাপ্টার টু সিনেমার। এখনো শুরু হয়নি শুটিং। ফেরদৌসের কারণেই কি এই দেরি? এমন প্রশ্নের জবাবে রানা সরকার বলেন, '২০২৩ সালেই সিনেমার শুটিং হওয়ার কথা ছিল, তবে সেটা সম্ভব হয়নি। ফেরদৌসের কারণে নয়, বিভিন্ন কারণে একটু দেরি হচ্ছে। যেহেতু এটার
শুটিং হবে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত এলাকায়, তাই সেখানে শুটিং করার
ক্ষেত্রে অনুমতির একটা বিষয় আছে।'
মীর জাফর চ্যাপ্টার টু সিনেমার ভবিষ্যৎ নিয়ে এই প্রযোজক বলেন, 'দুই দেশে মুক্তির পরিকল্পনা থাকায় উভয় দেশের শিল্পীদের নিয়ে কাজটি করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু এখনকার যে পরিস্থিতি দেখছি, তাতে আগের শিল্পীদের নিয়ে কাজ করা কঠিন। দুই বাংলায় মুক্তি দেওয়া না গেলে এর সার্থকতা থাকবে না। শুধু পশ্চিমবঙ্গে সিনেমাটি মুক্তি দেওয়াটা উচিত হবে না। বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়া সম্ভব হলেই নির্মাণের পরিকল্পনা করব।'
এ সিনেমায় বাংলাদেশের জিয়াউল রোশানেরও অভিনয়ের কথা আছে। ভবিষ্যতে সিনেমার কাজ শুরু হলে রোশান থাকবেন বলে জানিয়েছেন প্রযোজক রানা। তিনি বলেন, 'রোশানের সঙ্গে আমাদের কোনো ঝামেলা নেই। শুটিং শুরুর আগে তার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে। সে করতে চাইলে অবশ্যই সিনেমায় থাকবে। সে সময় ফেরদৌস ভাইয়ের রিপেস্নসমেন্ট করা হবে।' গ্রামের রাজনীতির গল্প নিয়েই লেখা হয়েছে মীর জাফর চ্যাপ্টার টু সিনেমার চিত্রনাট্য। নির্মাতা অর্কদীপ বলেন, 'আমি মুর্শিদাবাদের ছেলে। ছোট থেকে ওখানে নানা অপরাধ ঘটতে দেখেছি। গ্রামের রাজনীতির চিত্রটা আমার প্রথম সিনেমায় ফুটিয়ে তুলতে চাই।'
এদিকে গুঞ্জন উঠেছে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে কলকাতা চলে গেছেন ফেরদৌস। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন দীর্ঘদিনের বন্ধু টলিউড অভিনেত্রী ঋতুপর্ণা সেনগুপ্তের বাড়িতে। তবে এরপর মুখ খুলেছেন অভিনেত্রী। সংবাদমাধ্যমকে জানালেন বিষয়টি ভিত্তিহীন।
ঋতুপর্ণা বলেন, 'আমার কানেও খবরটা এসেছে। আমাদের দুজনের এমন একটা ছবি দিয়ে খবরটা প্রচার করা হচ্ছে, যে ছবিটা কিছুদিন আগে একটা শোতে তোলা। ফেরদৌস তো আমার সবচেয়ে ভালো বন্ধু, এটা তো সবাই জানেন। শেষবারও যখন ঢাকায় গেলাম, ওর বাসায় গিয়েছি। সেও কলকাতায় এলে আমার বাসায় আসে। আমাদের নিয়মিত যাতায়াত আছে। সত্যি কথা
বলতে এই ঘটনার পর যোগাযোগ করতে পারিনি।'
ফেরদৌসের অবস্থান সম্পর্কে জানেন না উলেস্নখ করে এ অভিনেত্রী বলেন, 'আমি জানিও না ফেরদৌস এখন কী অবস্থায় আছে। দেশ থেকে বেরিয়েছে কি না, তাও জানি না। শুধু এটুকুই চাইছি, ও যেন ভালো থাকে, সুস্থ থাকে, সাবধানে থাকে। কারণ, মানুষ হিসেবে ফেরদৌস খুব ভালো। ওর দেশে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কী হয়েছে, কিন্তু সে তো একজন ভালো মানুষ, চলচ্চিত্রের একজন বড় তারকা, একজন শিল্পী, অসাধারণ একটা সুন্দর মন আছে ওর। সত্যি বলতে, নির্বাচনের সময়ও ফেরদৌস আমাকে বলেছিল, আমি ভালো কাজ করতে চাই। মানুষের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে চাই। সে জন্যই নির্বাচন করতে এসেছিল। যাহোক, ওর দেশে এখন অন্য রকম একটা পরিস্থিতি হয়েছে, আমি ভাবতে চাই, ফেরদৌস যেখানেই থাকুক নিরাপদে এবং ভালোভাবে আছে।'