বিগত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকারের আমলে রাষ্ট্রের এমন কোনো খাত নেই যে স্বর্ণমৃগ খাতে লুটপাটের মহোৎসব পালন করা হয়নি। এক্ষেত্রে অন্যান্য খাতের মতো চলচ্চিত্র নির্মাণে অনুদান প্রদানের খাতেই ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এখানে যাদের প্রধান যোগ্যতাই হচ্ছে কে কত বেশি সরকারি দালাল তারই বিচারে।
প্রতিটি অনুদান বর্ষের মতো সিনেমা নির্মাণে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫ কোটি ২০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়। যে অর্থ প্রদানের ক্ষেত্রে আছে মোট ২৬টি সিনেমা, যার মধ্যে ছয়টি স্বল্পদৈর্ঘ্যের।
'পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি' এবং 'স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি'র সিদ্ধান্তের ভিত্তিতে এসংক্রান্ত প্রজ্ঞাপনও জারি করেছে তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়।
এতে পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমার মধ্যে ১৬টি ৭৫ লাখ টাকা আর বাকি চারটি ৫০ লাখ টাকা করে পেয়েছে। এই চারটির মধ্যে দুটি শিশুতোষ এবং দুটি প্রামাণ্যচিত্র শাখার।
স্বল্পদৈর্র্ঘ্য চলচ্চিত্র বিভাগে ছয় সিনেমাকে ২০ লাখ টাকা করে দেওয়া হয়েছে, মোট ১ কোটি ২০ লাখ টাকা। এর মধ্যে দুটি সিনেমা মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক, একটি শিশুতোষ; বাকি তিনটি সাধারণ শাখায়।
১৯৭৬-৭৭ অর্থবছর থেকে দেশীয় চলচ্চিত্রে সরকারি এ অনুদান চালু করা হয়। মাঝে কয়েক বছর বাদে প্রতিবছরই অনুদান দেওয়া হচ্ছে। গত বছর (২০২২-২৩ অর্থবছর) ২৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য এবং ৬টি স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনেমাকে মোট ১৩ কোটি ৯০ লাখ টাকা অনুদান দেওয়া হয়।
তবে কারা পাচ্ছে এই অনুদান, তা খোঁজ করলে সাধারণ চলচ্চিত্রামোদীদের চোখ চড়কগাছে উঠে যাবে।
বলা হয়, বিগত বছরে যত সরকারি অনুদান দেওয়া হয়েছে তার মধ্যে ২০২৩-২৪ অর্থবছরটিতেই অনিয়মকে সবচেয়ে বেশি স্বেচ্ছাচারীরূপে করা হয়েছে। এ বছরের মতো অনিয়ম আর কোনো বছরেই হয়নি। বিগত আওয়ামী সরকারের প্রতিটি অর্থবছরের অনুদানের ক্ষেত্রে স্বজন ও দলীয়প্রীতির চোখে অনুদান তো দেওয়া হয়েছেই, তার ওপর এবার অনুদান দেওয়া হয়েছে যে সিনেমা বানানোর একদমই কোনো যোগ্যতাই রাখে না এমন লোকজনকেও। টাকা দেবে গৌরী সেন, তাই যে কেউ টাকা নিয়ে একজন যেনতেন পরিচালক সিনেমা বানিয়ে সেন্সরে জমা দিচ্ছে।
যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও যারা বিগত সরকারের দল করতেন না তাদের এই অনুদান দেওয়া হয়নি। ফলে দেশের এই সিনেমা সংশ্লিষ্টদের মত হচ্ছে, যেসব অযোগ্যর হাতে এই টাকা দেওয়া হয়েছে তা বর্তমান সরকার প্রত্যাহার করে নিক।
সৃজনশীল সিনেমা বানানোর অজুহাতে কীভাবে ন্যক্কারজনকভাবে দলীয়করণ হয়েছে সেই নামের তালিকাগুলো দেখলেই পরিষ্কার হবে। প্রত্যেকটি অনুদান পেয়েছেন দলীয় পাচাটা লোকেরা। ফলে এমনও হয়েছে যে লোক কোনোদিন সিনেমার ধারেকাছেও ছিলেন না তিনিও পেয়েছেন ৭৫ লাখ টাকার অনুদান। এই টাকা থেকে কত টাকা খরচ করবেন তার সিনেমা বানাতে গিয়ে। ১০ লাখ টাকায় বানালেও তিনি তার হিসাবে দেখাবেন এক কোটি টাকা বা তার চেয়েও বেশি।
যেমন- এক সাংবাদিক নেতা, যিনি শেখ হাসিনাকে 'মা' বলে সম্বোধন করেন- তিনি তার স্ত্রীর জন্য দলীয় প্রভাব খাটিয়ে এবার পৌনে এক কোটি টাকার অনুদান পাইয়ে দিয়েছেন। তার সেই স্ত্রী ঝুমুর আসমা জুঁই পেয়েছেন 'দুই পয়সার মানুষ' সিনেমার জন্য ৭৫ লাখ টাকার সরকারি অনুদান। তার সিনেমা বানানোর কোনো যোগ্যতাই নেই। শোবিজের লোকেরা তার নামও জানে না। আছে শুধু সরকরি দালালি করার যোগ্যতা। পরে তাকে এই সিনেমা বানাতে ভালো পরিচালক পেতে হিমশিম খেতে হয়।
তেমনি সরকারি দালাল হিসেবে পরিচিত জ্যোতিকা পাল জ্যোতি। তারও সিনেমা বানানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও অল্প বয়সেই সরকারি অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন। যেমন- বিগত স্বৈরাচার হাসিনা সরকারের দালালি করে অল্প বয়সেই পতিত লিয়াকত আলী লাকীর সহযোগী হিসেবে শিল্পকলা একাডেমির পরিচালক পদে চাকরি বাগিয়ে নিয়েছেন।
আরও একটি ব্যাপার লক্ষ করা যায়, বিগত সরকারের আমলে সরকারি অনুদানের ক্ষেত্রে শেখ মুজিব ও মুক্তিযুদ্ধের কাহিনির ওপর বেশি অনুদান দিতে। ফলে একই প্যানপ্যানানির গল্প হওয়ায় সরকারি অনুদানের সিনেমার বারোটা বেজে যায়। আর আবেদনকারীও সৃজনশীল না হওয়াতে এতে যেনতেন একটা নাম দিয়ে আর কোনো একপ্রকার জোরাতালি দেওয়া কাহিনি দিয়ে স্রেফ কে বেশি সরকারি দালাল এই পরিচয়েই অনুদান আদায় করে নিয়েছেন।
এই তেল মর্দনকারী সরকারি দালাল হিসেবে পরিচিত মাসুদ পথিক। তার যোগ্যতা হলো সরকারের দালালি করতে পারে। এ ছাড়া আর কোনোই যোগ্যতা নেই তার। এবারও দালালি করে ৭৫ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। হেন কোনো লবিং নেই যা তিনি করেননি। প্রায় প্রতিবারই তিনি এই দালালি করে সরকারি অনুদান বাগিয়ে এনেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের কাছে লবিং করে জাতীয় চলিচ্চিত্র পুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছেন। তারও সিনেমা বা নাটক, শর্টফিল্ম ইত্যাদি বানানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের মাধ্যমে এই অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন।
তবে এই অর্থবছরে পাওয়া ৭৫ লাখ টাকার অনুদানে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক 'পাকিস্তানে বন্দীজীবন' অনেকটা ভিন্ন আঙ্গিকের সিনেমা হতে পারে। তবে সেটা মুক্তি পেলেই বোঝা যাবে কেমন সিনেমা। এই অনুদান পাওয়া পরিচালক ও প্রযোজক সাজেদুল ইসলাম।
তবে অধিকাংশ অনুদানই গেছে অযোগ্যদের হাতে। এমন আরও যেসব অযোগ্যরা ৭৫ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন তাদের মধ্যে আছেন, 'ছোঁয়া'র পরিচালক ও প্রযোজক রাকিবুল হাসান।
মির্জা শবনব ফেরদৌসী যিনি পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে 'মিহিন গাথা' সিনেমার জন্য অনুদান পেয়েছেন।
'ঠিকানা' সিনেমার জন্য পরিচালক ও প্রযোজক হিসেবে অনুদান পেয়েছেন জাহাঙ্গীর হোসেন বাবর।
ফজলে হাসান শিশির অনুদান পেয়েছেন 'সুরাইয়া' সিনেমার জন্য; পরিচালনা করবেন রবিউল আলম রবি। 'জয়া' সিনেমার জন্য পরিচালনা ও প্রযোজক হিসেবে অনুদান পেয়েছেন গোলাম মোস্তফা। ৭৫ লাখ টাকা অনুদান পেয়েছেন 'লোভ' সিনেমার প্রযোজক পিংকি আক্তার, সিনেমাটি পরিচালনা করবেন সঞ্জয় সমাদ্দার।
পরিচালনা ও প্রযোজক হিসেবে 'সখী রঙ্গমালা' সিনেমার জন্য অনুদান পেয়েছেন এন রাশেদ চৌধুরী। অনুদান পেয়েছেন শেলী কাদের প্রযোজিত 'জাত'। জানা গেছে, তার এই সিনেমাটির পরিচালক নারগিস আক্তার।
এই অর্থবছরে পাওয়া অনুদানে 'ময়নার চার'-এর প্রযোজক সুমন পারভেজ, পরিচালক এ জেড এম মোস্তাফিজুর রহমান বাবু; আর 'কালবেলা' সিনেমার প্রযোজনা ও পরিচালনার জন্য অনুদান পাচ্ছেন ইব্রাহীম খলিল মিশুক (মিশুক মনি)।
এই তালিকায় আরও আছেন মনোজ প্রামাণিক প্রযোজিত 'সেয়ানা', এটির পরিচালক ইকবাল হাসান খান। 'আজিরন' সিনেমার প্রযোজনা ও পরিচালনায় আছেন গীতালি হাসান।
অনুদান পাওয়া 'পোস্টমর্টেম' সিনেমার প্রযোজক নিজাম উদ্দিন, পরিচালক, আরিফ সিদ্দিকী। 'হা ঘরে' নামে আরেকটি সিনেমাও আছে তালিকায়; ছবিটির প্রযোজক নূর মনির, পরিচালনা করবেন নাসরুলস্নাহ মানসুর। সাধারণ শাখায় মনোনীত আরেকটি সিনেমা হলো 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা'। সিনেমাটির প্রযোজক ও পরিচালক দেওয়ান নজরুল।
এভাবে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একটা সরকারি অনুদানের লঙ্গরখানা বানানো হয়েছে বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে। এভাবে উলুবনে টাকা ছড়িয়ে জনগণের কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে। অথচ খোদ প্রেক্ষাগৃহের মালিকরাই এই অদক্ষ হাতে বানানো নামকাওয়াস্তে মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা প্রদর্শন করতে চান না। কারণ নামকাওয়াস্তে বানানো এই মুক্তিযুদ্ধের সিনেমার কোনো দর্শক নেই। যে সিনেমায় কোনো দর্শক থাকে না সে সিনেমা ব্যবসা করা দূরে থাক, খরচের টাকাও উঠে আসছে না। এভাবে অনুদানের নামে জনগণের কোটি কোটি টাকা পতিত হাসিনা স্বৈরাচার সরকারের মা গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে।