নায়ক উজ্জ্বল প্রথম সিনেমায় অভিনয় করেন কবরীর বিপরীতে। সাদাকালো যুগের সফল নায়কদের মধ্যে অন্যতম তিনি। প্রযোজক ও পরিচালনা করেও সফলতা পেয়েছেন।
আবার চলচ্চিত্রের বাইরে তিনি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক। ফলে তার নামের সঙ্গে সরাসরি বিগত ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দলের ট্যাগ লাগানো থাকায় দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি এফডিসি চত্ব্বরে একপ্রকার অপাঙ্ক্তেয় হয়েছিলেন। কীভাবে এফডিসি একটি দলের কুক্ষিগত হয়ে পড়ে তা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন। ঢাকাই চলচ্চিত্রে বারোটা বেজে গেছে এমন একটা ধারণা দেশের চলচ্চিত্র দর্শকরা এবং সমালোচকরা বলে আসলেও কেন এমন হয়েছে গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে এর ভিতর-বাহির সব অকপটে প্রকাশ করেছেন একসময়ের মেগাস্টার উজ্জ্বল।
কীভাবে দলীয়করণের মাধ্যমে সৃজনশীল সিনেমা বানানোর অজুহাতে বাংলাদেশ সরকারের অনুদান দেওয়া বিষয়টিও দেখানো হয়েছে দলীয় পরিচয় হিসেবে। প্রত্যেকটি অনুদান পেয়েছেন সরকারের অনুগত লোকরা। আর এটা করতে গিয়ে এমনও করা হয়েছে, যে ব্যক্তি কোনোদিন সিনেমার ধারেকাছেও ছিলেন না তিনিও পেয়েছেন অনুদান। শুধু তাই নয়, এমন ব্যক্তি আবার বিভিন্ন লবিং করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও বাগিয়ে নিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তাকে বারবারই সরকারি অনুদান দেওয়া হয়ে থাকে। যেমন একজন মাসুদ পথিক অন্যতম। এমন কোনো লবিং নেই যা তিনি করেননি। আবার কোনোদিন কোনো সিনেমা না বানানো এক সাংবাদিক নেতার স্ত্রী দলীয় প্রভাব খাটিয়ে ঝুমুর আসমা জুঁই পেয়েছেন 'দুই পয়সার মানুষ' সিনেমার জন্য সরকারি অনুদান। তেমনি সিনেমা বানানোর কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকলেও জ্যোতিকা পাল জ্যোতিও অল্প বয়সেই সরকারি অনুদান বাগিয়ে নিয়েছেন। এইভাবে ঢাকাই ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিকে একটা সরকারি অনুদানের লঙ্গরখানা বানানো হয়েছে বিগত স্বৈরাচারী হাসিনা সরকারের আমলে। এইভাবে উলুবনে টাকা ছড়িয়ে জনগণের কোটি কোটি টাকা লোপাট করা হয়েছে।
ফলে দেশের চলমান পরিস্থিতি, এফডিসি, সেন্সর বোর্ড, অনুদান কমিটি, নতুন সরকারের কাছে প্রত্যাশাসহ নানা বিষয় নিয়ে কথা বলা আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল স্বৈরাচারী হাসিনা সরকার পতনের পর সেই সরকারের বিরুদ্ধে এতদিন প্রকাশ্যে বলতে না পারার চাপা ক্ষোভেরও প্রকাশ ঘটেছে এই সাক্ষাৎকারে।
আর এসব বিষয়ে কথা বলতে গিয়েই দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে বিগত স্বৈরাচারী সরকারের আমলে একচ্ছত্র দলীয়করণ হয়েছে বলে দাবি করেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বিএনপির কেন্দ্রীয় কমিটির সাংস্কৃতিক সম্পাদক আশরাফ উদ্দিন আহমেদ উজ্জ্বল। সাদাকালো যুগের সবচেয়ে উজ্জ্বল নায়কদের অন্যতম মনে করা হয় তাকে। কিন্তু বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থাকায় বিগত স্বৈরাচারী সরকারের সময়ে গুরুত্বহীন ও অপাঙ্ক্তেয় হয়ে পড়েন তিনি।
চলচ্চিত্র শিল্পের সুখকর সময় অতীত। অথচ মহান মুক্তিযুদ্ধে চলচ্চিত্র শিল্প উন্নয়ন করপোরেশনের ভূমিকা ছিল গর্বের। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হান নির্মাণ করেন তথ্যচিত্র 'স্টপ জেনোসাইড'। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকে শিশু-কিশোররাও জেনেছে স্বাধীনতা এবং মুক্তির ইতিহাস। কিন্তু সেই ঐতিহ্য এখন দেশের চলচ্চিত্র অঙ্গনে নেই বললেই চলে।
ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে দলীয়করণ নিয়ে উজ্জ্বল বলেন, 'যেভাবে রাষ্ট্রের সব জায়গায় ক্ষত-বিক্ষত করেছে গত সরকার, এফডিসিও তার বাইরে নয়। রাষ্ট্র যেভাবে ধ্বংস করেছে, দেশের শিল্প-সাহিত্যের সব প্রতিষ্ঠান দলীয়করণ করে ধ্বংস করেছে। এফডিসি এখন গো-চারণভূমি। সব গরু-ছাগল চড়িয়া বেড়াইতেছে। এফডিসির ফ্লোরগুলো ভেঙে ফেলা হয়েছে। অথচ ফ্লোরগুলো ঠিক রেখেই উন্নয়ন করা সম্ভব ছিল। প্রতিটি ফ্লোরে আমাদের অসংখ্য স্মৃতি জড়িয়ে আছে। ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে অনেক দলীয়করণ হয়েছে'।
প্রতি বছর সরকারি অনুদানের জন্য ছবি জমা দিয়ে শুধুমাত্র লবিং, লিয়াজোঁ, স্বজনপ্রীতি, দলীয়প্রীতি না থাকায় সরকারি অনুদান থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন অনেক মেধাবী চলচ্চিত্র নির্মাতা। উজ্জ্বলের দাবি, দলীয় বিবেচনায় অনুদানের টাকা পেয়েছে অনেকে।
'অনুদান সব সময় যোগ্য লোক পায়নি। এখানেও দলীয়করণ হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে সিনেমা করেছে। কেন? এতে করে জনগণের টাকা নষ্ট হয়েছে'।
ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে অভিনয় করেও আজীবন সম্মাননা কিংবা একুশে পদক দেওয়া হয়নি এই মেগাস্টার উজ্জ্বলকে, এ নিয়ে কোনো আক্ষেপ আছে কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, 'আমি যদি চাইতাম তাহলে বিএনপি সরকারের সময় বড় বড় পুরস্কার নিতে পারতাম। আমি সেটা করিনি। এটা আমার মধ্যে নেই। কিন্তু, গত সরকার তা করেনি। অনুদান, সেন্সরবোর্ড, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার, একুশে পদক, স্বাধীনতা পুরস্কার সবখানে দলীয়করণ হয়েছে। অথচ এই পুরস্কারগুলোসহ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার প্রবর্তন করেছেন শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান।'
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার কীভাবে প্রবর্তিত হলো, এ বিষয়ে বলতে গিয়ে উজ্জ্বল বলেন, 'এটা সম্ভবত ১৯৭৮ সাল। বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট তখন জিয়াউর রহমান সাহেব। সেই সময় তিনি একদিন এফডিসিতে আসবেন। সবাই একটু অবাক হলেন কোনোরকম প্রস্তুতি নেই, সাজসজ্জা নেই- তিনি আসবেন। শামসুল হুদা চৌধুরী তখন মন্ত্রী ছিলেন। আমাকে দিয়ে বলালেন যেন পরে অনুষ্ঠান করে আনানো হয়। কিন্তু, আমরা জানতে পারলাম প্রেসিডেন্ট এফডিসিতে আসার জন্য রওনা হচ্ছেন। তারপর তিনি এলেন। সেদিনই তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের ঘোষণা দিয়ে যান। এছাড়া দুঃস্থ শিল্পীদের জন্য, অনুদানের জন্যও ঘোষণা দেন। কিন্তু গত সরকার তা মনে রাখেনি। একটিবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের সময় তার নাম নেওয়া হয়নি। এটা দুঃখজনক।'
নন্দিত নির্মাতা সুভাষ দত্ত পরিচালিত 'বিনিময়' সিনেমায় উজ্জ্বল নামে অভিনয় করেন উজ্জ্বল। এর পরে 'সমাধি', 'নালিশ', 'উসিলা', 'নসিব', 'অপরাধ', 'সমাধান'সহ অসংখ্য জনপ্রিয় সিনেমায় অভিনয় করেন তিনি। সর্বশেষ ২০১৫ সালে 'রাজা বাবু' সিনেমায় তাকে দেখা যায়। ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে চলচ্চিত্রে অভিনয় করেও কোনো সম্মাননা পাননি তিনি।
১৯৪৬ সালের ২৮ এপ্রিল সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে জন্ম নেওয়া উজ্জ্বল ১৯৭০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগ থেকে এমএ পাস করেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালে মঞ্চ নাটক করতেন এবং ১৯৬৭-১৯৭০ সাল পর্যন্ত টেলিভিশনের নাটকেও অভিনয় করতেন।