দুর্নীতির বরপুত্র লাকীর পতন

প্রকাশ | ১৩ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
দীর্ঘ এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের চেয়ারে ছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। অবশেষে তিনি পদ ছাড়লেন। সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র জমা দিয়েছেন তিনি। লাকীর পদত্যাগের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সচিব (উপসচিব) সালাহউদ্দিন আহাম্মদ। শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের পদ থেকে লাকীর পদত্যাগের বিষয়ে সালাহউদ্দিন আহাম্মদ বলেন, 'আজ সকালে মন্ত্রণালয়ে আসার পর জানতে পেরেছি মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী পদত্যাগ করেছেন। তিনি হোয়াটস অ্যাপের মাধ্যমে পদত্যাগপত্র পাঠিয়েছেন।' এর আগে গত রোববার শিল্পকলা একাডেমির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলার শিকার হন লিয়াকত আলী লাকীর অনুসারী হিসেবে পরিচিত কয়েকজন কর্মকর্তা। এ ছাড়া অন্তত ১৫ জন কর্মকর্তার কক্ষে তালা দিয়েছেন বিক্ষুব্ধরা। জানা যায়, গত রোববার দুপুরে ছাত্র-জনতার ধাওয়া খেয়ে শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণ ছেড়েছেন লিয়াকত আলী লাকী। এ সময় তার পদত্যাগের দাবিতে স্স্নোগান দেন বিক্ষুব্ধরা। এক যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালকের দায়িত্ব পালন করছিলেন লিয়াকত আলী লাকী। ২০১১ সালের ৭ এপ্রিল প্রথম দায়িত্ব পান তিনি। সবশেষ ২০২৩ সালের ২৯ মার্চ সপ্তমবারের মতো তার মেয়াদ বাড়ানো হয়। এত দীর্ঘসময় এই দায়িত্বে থাকার নজির আর কারও নেই। দীর্ঘদিন ধরে লিয়াকত আলী লাকীর শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক পদে থাকা নিয়ে সাংস্কৃতিক অঙ্গনে ক্ষোভ তৈরি হয়। দুর্নীতির অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন জিজ্ঞাসাবাদও করেছিল তাকে। এদিকে লাকীর পদত্যাগের দাবিতে শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালা গেটে সমাবেশের ডাক দিয়েছেন থিয়েটার কর্মীরা। তার আগেই পদ ছাড়লেন তিনি। লাকী বাংলাদেশ গ্রম্নপ থিয়েটার ফেডারেশনের সভাপতির পদেও রয়েছেন। ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক কামাল বায়েজীদকে অব্যাহতি দেওয়ার ঘটনায়ও সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। তার প্রতিক্রিয়ায় ফেডারেশন ছাড়ে ঢাকা থিয়েটার। গত বছরের জুনেও 'সাধারণ নাট্যকর্মীবৃন্দ' ব্যানারে লিয়াকত আলী লাকীকে অপসারণের দাবিতে আন্দোলন করে সংস্কৃতিকর্মীদের একটি অংশ। তখনও নিজের অবস্থানে অনড় থাকেন তিনি। ২০২২ সালে দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সে সময় রাজধানীর সেগুনবাগিচায় দুদকের প্রধান কার্যালয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজির হন লিয়াকত আলী লাকী। দুদকের সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের বরাত দিয়ে গণমাধ্যমে এক প্রতিবেদনে এ কথা জানানো হয়েছে। জানা গেছে, দুদকের অনুসন্ধান কর্মকর্তা মোহাম্মদ জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ইন্টারোগেশন সেলে নিয়ে যান লিয়াকত আলী লাকীকে। এর আগে গত ৫ জানুয়ারি, ঘুষগ্রহণ, ক্ষমতার অপব্যবহার, বিভিন্ন অনিয়ম ও দুর্নীতিসহ ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা আত্মসাতসহ বিপুল পরিমাণ সম্পদ অর্জন ও বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য তলব করেছিল দুদক। এ বিষয়ক অভিযোগ অনুসন্ধানের জন্য দুদকের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ ইব্রাহিম ও সহকারী পরিচালক আফনান জান্নাত কেয়াসহ দুই সদস্যবিশিষ্ট একটি অনুসন্ধান কমিটি করেছিল দুদক। দুদক সূত্র জানা গেছে, অনুসন্ধানের অংশ হিসেবে লিয়াকত আলী লাকীর কাছে ২০১৯-২০ অর্থবছরে শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকাতে বরাদ্দকৃত বাজেট ও ব্যয়ের রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির কপি, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকাতে বরাদ্দকৃত বাজেট এবং ব্যয়ের রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির কপি, ২০২০-২১ অর্থবছরে শিল্পকলা একাডেমির অব্যয়িত ৩৫ কোটি টাকা ৩০/৬/২০২১ তারিখে ব্যয়করণ সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র এবং ওই একই অর্থবছরে ভার্চুয়াল অনুষ্ঠান আয়োজন সংক্রান্ত রেকর্ডপত্র সংবলিত নথির কপি চাওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, গত ১৪ বছর ধরে মহাপরিচালক হিসেবে থেকে সংস্কৃতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গেছেন। তার অন্যায় আবদার না মানার কারণে হাসিনা স্বৈরাচার সরকারের দোসর লিয়াকত আলী লাকী চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত অনেককে শিল্পকলা একাডেমি থেকে তাড়িয়ে দেন। অনুগত অযোগ্য, ধামাধরা ও তেলবাজদের যোগসাজশে সংস্কৃতির আঁতুড়ঘর শিল্পকলা একাডেমিকে তিনি অন্যায়, লুটপাট ও দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেন। গণবিক্ষোভে ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নেতৃত্বে পরিবর্তনের ঢেউ লেগে যায়। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, গণমাধ্যম, বিচারপতি, আইনি কর্মকর্তা এবং বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যরাও দায়িত্ব ছাড়ছেন। মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর 'দুর্নীতির' নথি যেন সরিয়ে ফেলা না যায়, বিক্ষুব্ধরা সেটি প্রতিহত করার প্রতিশ্রম্নতি বদ্ধ। লিয়াকত আলী লাকী ১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি ঢাকার নবাবগঞ্জ উপজেলার আগলা টিকরপুর গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ সাদেক আলী এবং মাতা মাজেদা আলী। লাকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন। পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রন্থাগার বিজ্ঞান বিভাগ থেকে ডিপেস্নামা অর্জন করেন। পাশাপাশি জাপান দূতাবাস থেকে এক বছরের জাপানি ভাষা শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করেন। সঙ্গীতের প্রতি অনুরাগ থেকে তিনি বুলবুল ললিতকলা একাডেমি থেকে উচ্চাঙ্গ সঙ্গীতে ৫ বছরের সার্টিফিকেট কোর্সও করেছেন। নাট্যকলায় অবদানের জন্য লিয়াকত আলী লাকী ২০১৯ সালে একুশে পদক লাভ করেছেন।