শুক্রবার, ০৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৩ কার্তিক ১৪৩১

শেখ হাসিনা সরকারে আটকে পড়া সিনেমা

বিনোদন রিপোর্ট
  ১১ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
শেখ হাসিনা সরকারে আটকে পড়া সিনেমা

একটানা ১৬ বছরের শাসনামলে শেখ হাসিনা শিল্প-সংস্কৃতির জন্য কম করেননি। বলা চলে এতটা সংস্কৃতিবান্ধব রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশের মানুষ আগে দেখেনি। তবুও সেই সরকারের বিরুদ্ধে রয়েছে সংস্কৃতি অঙ্গনের হাজারো অভিযোগ। তার শাসনামলে অন্তত ছয়টি আলোচিত সিনেমা আটক বা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সেন্সরবোর্ড। সংখ্যার বিচারে খুব বেশি না হলেও গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থায় এইটুকুও ভয়ংকর বার্তা দেয়। হাসিনা সরকারের হঠাৎ পতনের পর ফিরে দেখা যাক আটকে পড়া ছবিগুলোর নাম-পরিচয় ও ধরন।

প্রথমেই এনামুল করিম নির্ঝরের নাম। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় স্থপতি তিনি। দু'হাতে রচনা করেছেন গান, করেছেন সুর, বানিয়েছেন সিনেমা। স্থপতির বাইরে যাকে প্রথম আবিষ্কার করা যায় 'আহা' সিনেমার মাধ্যমে। ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া এই সিনেমাটিকে ফরমুলার বাইরে গিয়ে আধুনিক বাংলা সিনেমার অন্যতম দলিল হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ছবিটি নির্মাণের জন্য পেয়েছেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও।

সেই নির্মাতা সরকারি অনুদান নিয়ে পরের সিনেমা নির্মাণ করেই আটকে গেলেন সেন্সরবোর্ডের হিমঘরে! ছবির নাম 'নমুনা'। ডুবলেন তো ডুবলেনই। কোমর সোজা করে দাঁড়াতে পারেননি সিনেমা পাড়ায়।

ছবিটি বাংলাদেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক কিছু বাস্তবতা নিয়ে বানানো। এটিকে পলিটিক্যাল স্যাটায়ারও বলা যায়। গুঞ্জন রয়েছে হাসিনা-খালেদার নেতিবাচক রাজনৈতিক গল্প ওঠে এসেছে এই সিনেমায়। যে ছবিটি ওয়ান ইলেভেনের মাইনাস টু ফর্মুলারও প্রতিচ্ছবি। ফলে ছবিটি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে তৈরি হলেও মুক্তির সময়ে ক্ষমতায় আসে হাসিনা সরকার। আর তাতেই ছবিটি আটকে যায়।

মজার তথ্য, যে গল্পটা বাস্তবে রচিত হয়েছে সাম্প্রতিক বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে। ধারণা করা হচ্ছে, এই গল্পটিই ১৫ বছর আগে নির্মাণ করে বসেছিলেন এনামুল করিম নির্ঝর।

রানা পস্নাজা : নজরুল ইসলাম খান। জটিলতা এখানেই, রাষ্ট্রের অর্গানগুলো যখন একসঙ্গে অক্টোপাস হয়ে ধরা দেয় সত্য প্রকাশের বিরুদ্ধে। এমনই এক ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছিল সিনেমা 'রানা পস্নাজা'। দেশের সবচেয়ে বড় স্ট্রাকচারাল দুর্ঘটনার আলোকে নির্মিত হয়েছিল ছবিটি। কিন্তু সেটি মুক্তির আলোয় আজও ডানা মেলতে পারেনি অজানা কারণে।

২০১৫ সালের ৪ সেপ্টেম্বর ছবিটি মুক্তির সব প্রস্তুতি ছিল। পেয়েছিল ছাড়পত্রও। ৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যায় পরিচালক জানতে পারেন, মুক্তিতে নিষেধাজ্ঞা এসেছে হাইকোর্ট থেকে! তাই নয়, দেশের বাইরে বা অন্য কোনো মাধ্যমেও ছবিটি দেখানো যাবে না।

জানা গেছে, 'রানা পস্নাজা' চলচ্চিত্রে 'ভীতিকর' দৃশ্য দেখানোর অভিযোগ করে বাংলাদেশ ন্যাশনাল গার্মেন্টস ওয়ার্কার্স এমপস্নয়িজ লীগের তৎকালীন সভাপতি সিরাজুল ইসলাম রিট আবেদন করেন। তারই প্রেক্ষিতে হাইকোর্টের এই আদেশ জারি হয়। সেই থেকে এখনো অন্ধকারে 'রানা পস্নাজা'।

পরিচালক নজরুল ইসলাম খান তখন গণমাধ্যমে বলেছিলেন, ছবিটি বানাতে গিয়ে তিনি অর্থনৈতিকভাবে নিঃস্ব হয়েছেন। এরপর আর কোনো ছবি বানাননি তিনি। তবে এই সময়ে এসে নির্মাতা আশাবাদী। ছবিটি মুক্তির বিষয়ে ফের আলো খুঁজে পাচ্ছেন।

আমার বাইসাইকেল, মর থেংগারি : অং রাখাইন। ছবিটি অন্ধকারে পড়ে থাকার বয়স এখন ৯ বছর। চাকমা ভাষায় নির্মিত বাংলাদেশের প্রথম সিনেমাও এটি। ২০১৫ সালের মে মাসে সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে জমা দিয়েছেন অং। মাঝে টানা ৯টি বছর অনেক অনুরোধ আর যুদ্ধ করেও ছাড়পত্র মেলেনি মাত্র ৬৪ মিনিট দৈর্ঘ্যের এই বিশেষ ছবিটি প্রদর্শনের।

অং রাখাইন জানান, ৬৪ মিনিটের ছবি থেকে ২৫ মিনিট কেটে ফেলতে বলেছে সেন্সর বোর্ড! তবেই মিলবে ছাড়পত্র। নির্মাতার প্রশ্ন, তাহলে সিনেমার আর থাকল কি? তিনি শর্ত মানেননি। শুধু অপেক্ষায় ছিলেন সময়ের।

সময়টা এলো ৫ আগস্ট হাসিনা সরকার পতনের মধ্য দিয়ে! যদিও যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে, নতুন সরকারও অং রাখাইনের মন আর সিনেমার মান অক্ষুণ্ন রাখতে পারবেন কি না। কারণ এই সিনেমায় রয়েছে সেনাবাহিনী প্রসঙ্গে কিছু বিষয়।

অং রাখাইন গণমাধ্যমে বলেন, 'আমাকে অনেক ভোগানো হয়েছে। যখন এমনটা হচ্ছিল, আমি সেন্সর বোর্ড ভাইস চেয়ারম্যানকে বলেও আসছিলাম, সনদ লাগবে না। আপনারা যখন মনে করবেন, সনদটা আমার বাড়িতে পৌঁছে দিয়েন।'

সরকার বদলের পরেও অনেকটা একই প্রতিবাদ কিংবা অভিমানে অটল রয়েছে অং। বরং মন বসিয়েছেন নতুন সিনেমায়। হয়তো ভেবে নিয়েছেন, তার ছবিটির দায়িত্ব নেবে না কোনো সরকারই!

শনিবার বিকেল : মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। ১৬ বছরের সেন্সরবোর্ডের ইতিহাসে আটকে থাকা অন্যতম আলোচিত সিনেমা 'শনিবার বিকেল'। কারণ এর প্রেক্ষাপট ছিল হলি আর্টিজানে ভয়াবহ জঙ্গি হামলা এবং এটি নির্মাণ করেছেন বিপস্নবী কণ্ঠ মোস্তফা সরয়ার ফারুকী। দু'টো মিলেও কাবু হলেন না সেন্সর বোর্ড কর্তারা। এই ছবিটির ছাড়পত্রের জন্য নানান মাধ্যমে সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ হয়েছে সরকারের প্রতি। কিন্তু কাজ হলো না। ২০১৯ সালে ছবিটি ছাড়পত্রের জন্য জমা দিয়েছেন মোস্তফা সরয়ার ফারুকী।

ফারুকী মনে করেন, বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের ফল হিসেবে আর কোনো ছবি এভাবে আটকে থাকবে না। কারণ, এই আন্দোলনের অন্যতম অংশীদার নির্মাতাও। তার ভাষ্যে, 'কারও গলা চেপে ধরার সংস্কৃতি থেকে বাংলাদেশকে বের হয়ে আসতে হবে। এই পরিবর্তনের জন্যই কিন্তু বিপস্নবগুলো হয়েছে। আমরা জেলখানায় থাকতে চাই না, এটাই তো সর্বশেষ আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল।' ২০১৬ সালে রাজধানীর গুলশানে হোলি আর্টিজানে জঙ্গি হামলার ছায়া অবলম্বনে 'শনিবার বিকেল'।

মেকআপ : অনন্য মামুন। এটি নির্দিষ্ট কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনার আলোকে তৈরি সিনেমা নয়। তবে এতে লুকিয়ে থাকার কথা গস্ন্যামার ওয়ার্ল্ডের ভেতরের গল্প। যে গল্পে রয়েছে রাজনীতিরও খেলা। যথারীতি ছবিটি সবাইকে অবাক করে দিয়ে আটকে গেল সেন্সর বোর্ডে।

২০২৩ সালের ২১ জানুয়ারি আপিল বিভাগে সর্বশেষ শুনানি হয়। তাতে আপিল বোর্ড জানায়, 'সিনেমাটি খুব দুর্বল নির্মাণ, দুর্বল চিত্রনাট্য, বাজে শটসহ নানা কারণেই এই ছবি প্রদর্শনের অযোগ্য।'

অন্যদিকে সেন্সর বোর্ডের সদস্য খোরশেদ আলম খসরু জানান, চলচ্চিত্র অঙ্গনের মানুষকে দৃষ্টিকটুভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগে 'মেকআপ' ছবিটি নিষিদ্ধ করা হয়েছে!

এর বিপরীতে নির্মাতা অনন্য মামুনের ব্যাখ্যাটিও বেশ যৌক্তিক। তিনি মনে করেন, কোনো সিনেমাই নিষিদ্ধ করার সুযোগ নেই। বড়জোর সেন্সরবোর্ড তাদের পর্যবেক্ষণ বা সংশোধন দিতে পারে। এমনটি এডাল্ট মার্কও দিতে পারে। যার কিছুই না করে সরাসরি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে বোর্ড।

তবে পরিবর্তিত নতুন বাংলাদেশে 'মেকআপ'সহ আটকে থাকা সব সিনেমাই মুক্তির আলোয় ডানা মেলবে বলে বিশ্বাস করেন অনন্য মামুন। ঢাকাই চলচ্চিত্র শিল্পীদের জীবনের গল্প নিয়েই তৈরি হয়েছে 'মেকআপ'।

অমীমাংসিত : রায়হান রাফী রাফী। এটা হাসিনা শাসনামলে সিনেমার কফিনে মারা সর্বশেষ পেরেক। ওটিটি'র জন্য নির্মিত সিনেমাটি মাত্র মাস তিনেক আগে 'প্রদর্শন উপযোগী' নয় বলে সিদ্ধান্ত জানায় বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ড। অথচ ওটিটি কনটেন্ট-এর জন্য সেন্সরবোর্ড কথা বলারই কথা নয়। তবুও ছবিটি তলব করেছে বোর্ড এবং নিষিদ্ধ করেছে।

তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের বিজ্ঞপ্তিতে চারটি কারণ উলেস্নখ করা হয়েছে ছবিটি নিষিদ্ধ করার ক্ষেত্রে-

১. চলচ্চিত্রটিতে নৃশংস খুনের দৃশ্য রয়েছে।

২. কাল্পনিক কাহিনি, চিত্রনাট্য ও সংলাপের বিষয়বস্তু বাস্তবতার সঙ্গে মিল রয়েছে।

৩. এ ধরনের কাহিনি বাস্তবে ঘটেছে।

৪. ঘটনা-সংশ্লিষ্ট মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন ও চলচ্চিত্রটির কাহিনি/বিষয়বস্তু বিচারাধীন মামলার সঙ্গে মিল থাকায় ভুল বার্তা দিতে পারে এবং তদন্তের বিঘ্ন ঘটাতে পারে।

ছবিটি রায়হান রাফী নির্মাণ করেছেন হাসিনা আমলের সবচেয়ে বিতর্কিত ঘটনা সাগর-রুনি হত্যাকান্ড নিয়ে। যে দম্পতির একমাত্র সন্তান মেঘ এখন পুড়ে যাওয়া বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি পরিষ্কারে ব্যস্ত সময় পার করছেন! অথচ বঙ্গবন্ধু কন্যার সরকারই তার বাবা-মায়ের হত্যাকান্ডের বিচার করতে পারেনি ১৬ বছরের শাসনামলেও। এমনকি এই নির্মম ঘটনা নিয়ে সিনেমা তৈরি করেও সেটি অজানা কারণে পড়ে রইল অন্ধকারে।

তিন মাস আগের স্মৃতি টেনে রায়হান রাফী বলেন, 'সেন্সর বোর্ড ছবিটি দেখে আনকাট ছাড়পত্র দেওয়ার কথা শুনেছি প্রথমে। একদিন পরই শুনি অজানা কারণে আটকে দেওয়া হলো! যে কারণগুলো দেখাল, সেগুলো আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতো। সব বুঝেও চুপচাপ ছিলাম। নির্মাতা হিসেবে আমাদের তো কিছু করার ছিল না। এখন আবার আবেদন করব। অনুমতি পেলে ভালো। না পেলে আবার চুপ থাকব।'

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে