শিক্ষার্থীদের সঙ্গে সংহতি জানালো সচেতন শিল্পীরা
প্রকাশ | ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০
বিনোদন রিপোর্ট
কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে গোটা দেশে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের পাশে সমবেতভাবে দাঁড়িয়েছে দেশের টিভি ও চলচ্চিত্রের অভিনয় শিল্পী ও কলাকুশলীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের দাবির সঙ্গে সংহতি প্রকাশ করে গতকাল রাজধানীর ফার্মগেটে সমবেত হয়েছেন দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ। বৃষ্টিকে উপেক্ষা করেই শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়াতে এক হয়েছিলেন দেশের সচেতন শিল্পীরা। এ সময়ে হত্যাকান্ডের নিন্দা, বিচার দাবি, গণগ্রেপ্তার বন্ধ করা, সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন স্স্নোগান দেন শিল্পীরা।
গতকাল বেলা ১১টায় মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে জাতীয় সংসদের সামনে সমাবেশের কর্মসূচি ছিল দৃশ্যমাধ্যমের শিল্পীদের। তবে পুলিশের বাধায় তারা সেখানে সমাবেশ করতে পারেননি। 'কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকারের কঠোর দমনপ্রক্রিয়া ও গুলিতে ছাত্র-জনতা হত্যার' প্রতিবাদে শিল্পীরা এই সমাবেশ করেন।
সকালে 'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পী সমাজ'-এর ব্যানারে শিল্পীরা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউর ইন্দিরা রোড প্রান্তে সমবেত হন। স্স্নোগানসহ ব্যানার-পোস্টার নিয়ে এগিয়ে যেতে শুরু করলে পুলিশ তাদের বাধা দেয়। এরপর তারা আর সামনে যেতে পারেননি। এরপর তারা স্স্নোগান দিতে দিতে ফার্মগেটের আনন্দ সিনেমা হলের সামনে আসেন।
এ সময় তারা হত্যাকান্ডের নিন্দা, বিচার দাবি, গণগ্রেপ্তার বন্ধ করা, সরকারের সমালোচনা করে বিভিন্ন স্স্নোগান দেন। অনেক সাধারণ জনতাও শিল্পীদের সঙ্গে এই সমাবেশ অংশ নেন। এ সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরও ব্যাপক উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়।
'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ'-এর ব্যানারে যুক্ত হওয়া সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে এদিন সরাসরি সমাবেশে উপস্থিত ছিলেন নির্মাতা নূরুল আলম আতিক, মাতিয়া বানু শুকু, আজমেরী হক বাঁধন, রেদওয়ান রনি, তানিম নূর, নুহাশ হুমায়ুন, সৈয়দ আহমেদ শাওকী, আদনান আল রাজীব, শঙ্খ দাশ গুপ্ত, অভিনয়শিল্পী মোশাররফ করিম, ইরেশ যাকের, রাফিয়াত রশীদ মিথিলা, সিয়াম আহমেদ, নাজিয়া হক অর্ষা, জাকিয়া বারী মম, সুকর্ণ শাহেদ, মোস্তফা মন্ওয়ার, দিপু ইমাম, সাবিলা নূর, প্রবর রিপন, শ্যামল মাওলাসহ আরও অনেকে। প্রায় প্রত্যেকেরই একই দাবি, হত্যার বিচার এবং হত্যা বন্ধ করা। সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতিও।
এ সময় মোশাররফ করিম বলেন, 'আমাদের দেশে বর্তমানে যে অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে, তাতে আমাদের আর ঘরে বসে থাকার মতো অবস্থা নেই। জনপ্রিয় এ অভিনেতা আরও বলেন, আমরা শান্তি চাই, আমরা রক্ত দেখতে চাই না। আমরা সব নির্যাতন, গুলি, হত্যা, রক্ত বন্ধ চাই। আমরা এগুলোর বাইরে থাকতে চাই।'
অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন বলেন, 'দেখুন আমিও কিন্তু অন্য অনেকের মতো এই রাষ্ট্র বা সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী একজন মানুষ। এই সরকারের আমলেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো ফিরে পেয়েছি। যেমন আদালত থেকে বাচ্চার অধিকার পেয়েছি, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটলো। এই সরকারের আমলেই আমি সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এর বাইরে ক্যারিয়ার বিচারে আমি সর্বোচ্চ সফল সময় পার করছি এখন। আমার তো দরকার ছিল না সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় এসে স্স্নোগান ধরার। বাকি জীবনটা আমি খুব আরামেই কাটাতে পারি চুপচাপ। প্রশ্ন আসবে আরাম ফেলে কেন আমি এমনটা করছি? উত্তরও দিচ্ছি। আমি তো শুধু অভিনেত্রী নই। এর বাইরেও আমি একজন মা, একজনের সন্তান এবং এই দেশের একজন সচেতন নাগরিক। যে বাচ্চাটা ছাদে খেলতে গিয়ে গুলি খেয়ে মরে গেল, সে তো আমারও মেয়ে হতে পারত। তখন কি আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এর বিচার চাইতাম না? যে হত্যাকান্ড ঘটে গেল এবং ঘটছে, সেটির বিচার কি আমি চাইব না? যদি না চাই, তাহলে তো আমি এই রাষ্ট্রের কেউ না। অথবা বোধশূন্য অমানুষ। আমার মনে হয়েছে, এর প্রতিবাদ করা উচিত। না করলে কাল যখন আমার মেয়েটা গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকবে, তখন অন্য কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে না। এবং এই গুলি চলতেই থাকবে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, আমি আমার স্বার্থেই রাজপথে নেমেছি। এর বিনিময়ে আমাকে যত মূল্য দিতে হয়, দিব। কিন্তু আমার কণ্ঠ থামাব না।'
অভিনেতা সিয়াম আহমেদ বলেন, 'এখানে আমার পক্ষ থেকে আলাদা করে কিছু বলার নাই। পুরো দেশের মানুষ এখন একটাই কথা বলছে। আর যখন দেশের মানুষ একটা ন্যায্য দাবি রাখেন তখন এটা বুঝা উচিত এটা ফেলে দেওয়ার মতো না। আমাদের যে ভাই-বোনেরা মারা গেল এটা মেনে নেওয়ার না। যদি আপনি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হন তবে রাতে ঘুমাতে পারবেন না। আমার কানে এখনো আসে 'কারো পানি লাগবে'। এটা মাথায় যতদিন থাকবে দেশের মানুষ শান্তিতে থাকতে পারবে না। আমরা যারা বিনোদন দুনিয়ায় কাজ করি দেশের মানুষের জন্য করি। তরুণরা আমাদের মূল দর্শক, আজ আমরা যদি তাদের সঙ্গে দাঁড়াতে না পারি তাহলে আমরা কি কাজ করলাম।'
তিনি আরও বলেন, 'আমার নিজের বাচ্চা আছে। আমি জানি আজ থেকে ১০ বছর পর আমার বাচ্চা আমাকে প্রশ্ন করবে তখন তুমি কি করেছিলে। সে সময় যেন আমি বুক উঁচু করে বলতে পারি আমি তাদের পাশে ছিলাম। আমি তাই ছাত্রদের সঙ্গে আছি। এই বাচ্চারা কোনো অনৈতিক দাবি রাখেনি যার জন্য তাদের প্রাণ হারাতে হবে। একেকজন বাবা-মায়ের আহাজারি নেওয়া যায় না। এর বিচার যতদিন না হবে বাংলাদেশের মানুষ শান্তি পাবে না।'
সাবিলা নূর বলেন, 'যেসব শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের মুক্তি চাই। যেসব হত্যা হয়েছে সেসবের বিচার চাই।'
নির্মাতা আশফাক নিপুণ বলেন, 'আমরা ছাত্রদের নয় দফার সঙ্গে সংহতি জানাই। যাদের আটক করা হয়েছে তাদের দ্রম্নত মুক্তি দেওয়া হোক। ছাত্ররা কী বলতে চায় সেটা রাষ্ট্র শুনুক। তারা দেশের শত্রম্ন না, তারা মানবিক সমাজ গড়তে চায়। আমরাই একটা মানবিক সমাজে থাকতে চাই।'
অভিনেত্রী নাজিয়া হক অর্ষা বলেন, 'এভাবে গ্রেপ্তার মোটেও গ্রহণযোগ্য নয়। এত রক্ত, এত ক্ষত আমি মেনে নিতে পারিনি, পারছিও না সাধারণ নাগরিক হিসেবে। তাদের যে দাবি সেটা যদি শুরুতেই আলোচনায় শেষ করা হতো তাহলে এত মানুষ মরতো না। ওই জায়গা থেকে মনে ক্ষত আছে আমার। যেভাবে মারধর, গুলি করা হচ্ছে এটা বন্ধ করা উচিত।'
বৃহত্তর চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, থিয়েটার, গণমাধ্যমসহ দৃশ্যমাধ্যমের নানা শাখার কর্মীরা 'দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ'-এর ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে হত্যা-সহিংসতা-গণগ্রেপ্তার-হয়রানির প্রতিবাদে এবং সব হত্যার হিসাব ও বিচার করা, গুলি ও সহিংসতা বন্ধ, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ, আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে এদিন সড়কে জমায়েত হয়েছেন। তাদের দাবি, অবিলম্বে সব হত্যাকান্ডের বিচার এবং হত্যা, সহিংসতা, গণগ্রেপ্তার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
শিল্পীরা বলেন, 'যেই ন্যায্যতা, সমতা ও মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভু্যদয়, সেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার নিয়েই আমরা রাজপথে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেছি।'