এই উপমহাদেশের সিনেমাকে জনপ্রিয়ই করেছে পেস্ন-ব্যাক। এ বিষয়ে কারোরই দ্বিমত থাকার কথা নয়। এটা যেন উপমহাদেশীয় এনভায়রনমেন্টই এমন যেখানে দর্শকই কাহিনীর একটানা সংলাপ শোনার বিরক্তি থেকে মুক্ত হতেই এক ফাঁকে মনোমুগ্ধকর গানের মধ্যে থাকতে চায়। কাজেই সিনেমা হবে কিন্তু পেস্ন-ব্যাক থাকবে না সেটা কী হয়? ঢাকাই সিনেমাও জনপ্রিয় হয়েছে পেস্ন-ব্যাক দিয়ে। গল্প যত ভালোই হোক তাতে মনকাড়া পেস্ন-ব্যাক না থাকলে সিনেমাটি দর্শক টানতে পারে না পেস্ন-ব্যাকহীন সিনেমার দিকে তাকালেই বোঝা যায়।
হিন্দি সিনেমার মতো ঢাকাই সিনেমাতেও অনেক বছর ধরে দর্শকদের মন মজিয়েছে পেস্ন-ব্যাক। তবে পেস্ন-ব্যাকের জনপ্রিয়তায় ধারাবাহিকতা হারানোয় দর্শক কমতে থাকলে একপর্যায়ে ভারতীয় সিনেমায় নিয়ে আসা হয় আইটেম সং বা আইটেম গান। আজ হিন্দি, তামিল, তেলেগু প্রভৃতি সিনেমাকে টেনেই নিয়ে যাচ্ছে একমাত্র আইটেম গান। অবস্থা এমন হয়েছে একটি হলেও কোমড় ঝাঁকানি দেওয়া আইটেম গান চাই-ই। বলিউডে এ যেন এক অঘোষিত রীতি। এ আইটেম গান দর্শককে ফুরফুরে মেজাজে রাখে।
ফলে সিনেমার সঙ্গে আইটেম গানের খুব একটা সঙ্গতি না থাকলেও চলে। এতে নির্মাতার উদ্দেশ্যই থাকে, নায়িকা বা আইটেম গার্লকে লাস্যময়ী করে উপস্থাপন করে ওই গান দিয়ে সিনেমার কাটতি বাড়ানো। আইটেম গান হিট তো সিনেমা দেখার আকর্ষণও হিট। এখন আইটেম গান নাই তো সিনেমাও একেবারে পানসে। যার সবশেষ প্রমাণ 'পুষ্পা : দ্য রাইজ' ছবির 'ও আন্তাভা' গানে সামান্থার নাচ। 'পুষ্পা : দ্য রাইজ' ছবির এক আইটেম সং 'ও আন্তবা'র জন্য আকাশছোঁয়া পারিশ্রমিক নিয়েছেন সামান্থা রুথ প্রভু। এরপর ইউটিউবের সুবাদে সারা বিশ্বের গান পাগলরাই মেতেছেন এই গানে। এমন সাড়া পাওয়া যাবে আগে থেকেই আঁচ করতে পেরেই হয়ত গানটিতে পারফর্ম করতে সামান্থা দর হেঁকেছিলেন পাঁচ কোটি রূপী! আবার শাহরুখ খানের 'রইস' হিট না হোক 'লায়লা ও লায়লা' গানের রিমেকে সানি লিওনের নাচ দেখার জন্য মুখিয়ে ছিল দর্শক। তার আগুন ঝরানো গানটিতে তিন কোটি রুপি নেন সানি। 'ও সাকি' কিংবা 'দিলবার'সহ একাধিক হিট আইটেম গান উপহার দেওয়া নোরা ফতেহি। তার এক নাচের জন্যই দিতে হয় ৫০ লাখ রুপি।
দর্শকদের বিনোদন জোগাতে সিনেমায় নানা ধরনেরই গান থাকে। তবে যে গানে নির্দিষ্ট করে শুধুমাত্র তরুণ-তরুণী বা টিনএজ দর্শকদের টার্গেট করেই স্নায়ু বিবশকারী উত্তেজনায় ঠাঁসা বিনোদন সাজানো হয়। যে আগুন ঝরানো গানে নৃত্যরত গায়িকা বা নায়িকাকে সঙ্গ দিতে আরও একঝাঁক কণ্ঠ মেলানো নৃত্যশিল্পী থাকে (যাকে সিনেমার ভাষায় 'এক্সট্রা'ও বলা হয়) সেগুলোকেই আইটেম সং বা আইটেম গান বলা হয়। পারফর্মাররা হলো 'আইটেম গার্ল'। এ গান মানেই দ্রম্নত গতির গান আর ধামাকা চন্ডী নাচ। তবে এ গানে যারা পারফর্ম করেন তারা একে আইটেম গান বলতে নারাজ। বলিউডের কৃতির শ্যানন ও জেরিন খান বলেন, 'আইটেম আবার কী! এই গানকে কেন আইটেম নাম্বার বলতে হবে বুঝি না।' তারা বলেন, 'শব্দটা ব্যবহার করে বরং একে একটু নেতিবাচক করে তোলা হয়। এগুলো তো একেবারেই নাচনির্ভর পরিবেশনা। দর্শকের আনন্দ আরও একটু বাড়িয়ে দিতে এগুলো রাখা হয়। দর্শকেরা এসব পছন্দও করেন। এসব গানের সঙ্গে যুক্ত যারা, তাদের নেতিবাচক চোখে দেখা হবে কেন? এই গানের শিল্পীদের সম্মান করা হবে না কেন?
বলিউডের দর্শকরাই যদি এ গানকে নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেন ঢাকাই সিনেমায় এ গান কী সম্মান পাবে সহজেই অনুমেয়। তারপরেও এ গানকে মেইনস্টিমের দর্শক লুফে নেয়। সেই বলিউড পেরিয়ে ঢাকাই সিনেমায়ও এ গান জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ২০১২ সালে 'ভালোবাসার রঙ' ছবির মাধ্যমে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে আইটেম গানের চল শুরু হয়। এতে 'প্রেম রসিয়া' নামে একটি আইটেম গানে পারফর্ম করেন বিপাশা কবির। তখন থেকে এ গানও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে থাকে। এ সময়ে নায়লা নাঈম, জ্যাকলিন মিথিলা, কবির তিথিসহ মুনমুন, ইয়ামিন হক ববি, মৌসুমী হামিদও 'আইটেম কন্যা' হিসেবে পারফর্ম করে দর্শকের নজরে আসেন। তবে বেশির ভাগ এ গানের কথা ও সুর দর্শকের চিত্তকে নাড়া দিতে না পারায় আইটেম গানের জনপ্রিয়তার ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি।
তবে আইটেম গানের সবই কাহিনীর সঙ্গে মিল না রেখে করা হয় এমন নয়। কোনো সিনেমায় কাহিনীর সঙ্গে মিল রেখেও আইটেম গান করা হয়। সামনে ৬ জানুয়ারি মুক্তি পাবে 'বস্ন্যাক ওয়ার'। এই ছবিটিতে 'চালাও গুলি' নামের একটি আইটেম গানে পারফর্ম করেছেন চিত্র নায়িকা ববি। গানটি সম্পর্কে ববি বলেন, 'এই প্রথম অন্য কারো সিনেমার আইটেম গানে অংশ নিলাম। কয়েক দিন আগে আইটেম গানের শুটিং শেষ হয়েছে। সিনেমার গল্পের সঙ্গে মিল রেখেই আইটেম গানটি করা হয়েছে।'
তবে বলিউডে হেলেন থেকে শুরু করে আজকের মালাইকা অরোরা, সানি লিওন, ক্যাটরিনা কাইফ, কারিনা কাপুর, নোরা ফতেহি প্রমুখ আইটেমগার্ল হিসেবেই নিজেদের যেভাবে মেলে ধরতে পেরেছেন এখানে কেউ সেরকম উচ্চতার ট্রেন্ড তৈরি করতে পারেননি। এজন্য এখানকার সিনেমায় আইটেম গান যেমন জনপ্রিয়তা পায়নি তেমন আইটেম গানের শিল্পী বা নাচিয়েরাও জনপ্রিয় হতে পারেনি। বরং ঢাকাই সিনেমার সোনালী যুগে যারা নৃত্যশিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন তারাই তুলনামূলকভাবে বেশি জনপ্রিয়তা পেয়েছিলেন। এ ক্ষেত্রে আছেন রওশন জামিল, অঞ্জনা, নূতন যারা পরবর্তীতে পার্শ্বচরিত্র বা নায়িকা হিসেবেও অভিনয় করেছেন। এ ছাড়া আরও ছিলেন শর্বরী, কল্পনা প্রমুখ। তাই এ প্রসঙ্গে একজন চিত্রপরিচালক বলেন, 'আসলে আইটেম সং সময়ের একটি চাহিদা মাত্র। তবে এই আইটেম গানের নামে যেন চলচ্চিত্রে অশ্লীলতার অনুপ্রবেশ না ঘটে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।' কিন্তু অশ্লীলতার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে ঢাকাই সিনেমার আইটেম গানে যে কথা থাকে সেটা দর্শকের চিত্তকে বেশি দূর টেনে নিয়ে যেতে পারে না। এরকম মনে করেই পপশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, 'সুর তো সব গানেই থাকে কিন্তু সেখানে যদি কথারই জোর না থাকে সেটা কীভাবে দর্শক-শ্রোতার চিত্তকে বাঁধবে?' সে জন্যই কণ্ঠশিল্পী খান আসিফুর রহমান আগুনও বলেন, 'আইটেম গান আবার গান নাকি? একটা ধামাকা নাচ দিয়ে আজেবাজে কথা ও সুরের সেটা যা-ই হোক গান হতে পারে না।'