বৃহস্পতিবার, ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

শিল্পী বারী সিদ্দিকীর অজানা কথা

হীরেন পন্ডিত
  ০৬ মে ২০২৪, ০০:০০
শিল্পী বারী সিদ্দিকীর অজানা কথা

উপমহাদেশের প্রখ্যাত বংশীবাদক ও সঙ্গীতশিল্পী বারী সিদ্দিকী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করে বাউলগানের পাশাপাশি উচ্চাঙ্গসঙ্গীতে তালিম নেন ভারতে। সেখান থেকে ফিরে এসে তিনি উকিল মুন্সি, জালাল উদ্দীন খাঁর গান সংগ্রহ করেন এবং গাইতে শুরু করেন। এ ছাড়া শ্রদ্ধেয় গীতিকার শহীদুলস্নাহ্‌ ফরাজির লেখা এবং তার নিজের লেখা গান সুর করে ও গেয়ে জনপ্রিয়তা পান। এশিয়া মহাদেশের মধ্যে অন্যতম স্বনামধন্য শিল্পী হিসেবে মনে করা হয় তাকে। বারী সিদ্দিকী ১৯৫৪ সালের ১৫ নভেম্বর নেত্রকোনায় এক সঙ্গীত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। নেত্রকোনা সদর উপজেলার মৌগাতি ইউনিয়নের ফচিকা গ্রাম বারী সিদ্দিকীর জন্মস্থান। বাবা প্রয়াত মহরম আলী ও মা প্রয়াত জহুর-উন-নিসা। তিন ভাই এক বোনের মধ্যে বারী সিদ্দিকীই ছিলেন সবার ছোট। বারী সিদ্দিকীর পুরো নাম আবদুল বারী সিদ্দিকী। শৈশবে পরিবারের কাছে গান শেখার হাতেখড়ি। মাত্র ১২ বছর বয়সেই নেত্রকোনার শিল্পী ওস্তাদ গোপাল দত্তের অধীনে তার আনুষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ শুরু হয়। তিনি ওস্তাদ আমিনুর রহমান, দবির খান, পান্নালাল ঘোষসহ অসংখ্য গুণী শিল্পীর সরাসরি সান্নিধ্য লাভ করেন। ওস্তাদ আমিনুর রহমান একটি অনুষ্ঠানে গান গাওয়ার সময় বারী সিদ্দিকীকে দেখে তাকে আরও প্রশিক্ষণ নেওয়ার প্রস্তাব দেন। এরপর ছয় বছর ওস্তাদ আমিনুর রহমানের অধীনে প্রশিক্ষণ নেন তিনি। সত্তরের দশকে জেলা শিল্পকলা একাডেমির সঙ্গে যুক্ত হন বারী। এরপর ওস্তাদ গোপাল দত্তের পরামর্শে ধ্রম্নপদি সঙ্গীতে পড়াশোনা শুরু করেন বারী সিদ্দিকী। পরবর্তী সময়ে বাঁশির প্রতি বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠায় তিনি বাঁশির ওপর উচ্চাঙ্গসঙ্গীতের প্রশিক্ষণ নেন। নব্বইয়ের দশকে ভারতের পুনে গিয়ে পন্ডিত ভিজি কার্নাডের কাছে তালিম নেন। দেশে ফিরে লোকগীতির সঙ্গে ধ্রম্নপদি সঙ্গীতের সম্মিলনে গান গাওয়া শুরু করেন। তার শ্বশুরবাড়ি নেত্রকোনার সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের কারলি গ্রামে। সেই সূত্রে কারলি গ্রামে শ্বশুর নূরুল হুদার বাড়ির পাশে তিনি এই বাউলবাড়ি নির্মাণ করেন। তবে সেই বাড়ির সংশ্লিষ্ট অন্যান্য স্থাপনা নির্মাণের কাজ অসমাপ্ত থেকে গেছে। বাংলা লোকগানের জনপ্রিয় শিল্পী বারী সিদ্দিকীর স্বপ্ন ছিল তার বাউলবাড়িতে বাউলরা আসবেন, থাকবেন এবং গানের চর্চা করবেন। তার এ কাজ নিজে শেষ করে যেতে না পারলেও তা এগিয়ে নেওয়ার কথা বলেছেন সংস্কৃতিকর্মী, রাজনীতিবিদ ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। নেত্রকোনা সদর উপজেলার রৌহা ইউনিয়নের কারলি গ্রামে প্রায় এক যুগ আগে ১২০ শতক জমিতে এই বাউলবাড়ির কাজ শুরু করেন তিনি। এখানে পুকুরের ওপর ঘর, একটি মসজিদ, বাউলদের থাকার জন্য ঘর, বাড়ির সীমানাপ্রাচীর করার পরিকল্পনা থাকলেও তিনি শেষ করতে পারেননি। মৃতু্যর বছরখানেক আগে বারী সিদ্দিকী এই বাড়িতে বাউলদের নিয়ে বৈঠক করেছিলেন। গানের জলসা করেছেন। এতে অন্তত ১০০ জন বাউল যোগ দিয়েছিলেন। হেমন্তের দিনে কিছুটা বিষণ্ন সুর দেখা দেয় নেত্রকোনার কারলি গ্রামে। এখন আর সেখানে মোহন বাঁশি বাজে না। অথচ এ গ্রামে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে দেওয়া বারী সিদ্দিকী হ্যামিলনের বাঁশিওয়ালার মতো বাঁশি বাজিয়ে উদ্বেলিত করতে চেয়েছিলেন তার শ্রোতাদের। কিন্তু প্রকৃতির অমোঘ নিয়মে তিনিও হয়ে গেছেন আসমান থেকে খসে পড়া নক্ষত্র। নেত্রকোনার আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি বিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন তিনি। ছাত্র হিসেবে বারী সিদ্দিকী সব সময় ভালো ছিলেন। ১৯৭৯ সালে তিনি এসএসসি পরীক্ষা দেন। তখন ইংরেজি বিষয়ে লেটার পেয়েছিলেন। তখন ঢাকা বোর্ড কর্তৃপক্ষ তার রেজাল্ট স্থগিত করেছিল। সে সময় লেটার পাওয়াটা একটা অন্য রকম ব্যাপার ছিল। খুব কঠিনও ছিল। পরে বোর্ড কর্তৃপক্ষ তার ইন্টারভিউ নিয়েছিল। মানবিক বিভাগে তিনি ফার্স্ট ডিভিশন পেয়েছিলেন। প্রতিবছর ১৫ নভেম্বর তার জন্মদিনে বাউলবাড়িতে বাউলগানের আসর বসে। জেলা শহরসহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে সে অনুষ্ঠানে। গান শোনে এবং শ্রদ্ধা জানায় বারী সিদ্দিকীর স্মৃতির প্রতি। আমি একটা জিন্দা লাশ, শুয়া চান পাখি, আমার গায়ে যত দুঃখ সয়, পুবালি বাতাসে, তুমি থাকো কারাগারে, রজনী, ওলো ভাবিজান নাউ বাইয়া, মানুষ ধরো মানুষ ভজো প্রভৃতি গানের জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। বারী সিদ্দিকী বাংলাদেশের একজন খ্যাতিমান সঙ্গীতশিল্পী, গীতিকার ও বংশীবাদক। গানে গানে বিরহের কথা বলে গেছেন তিনি। এক স্বপ্নীল সুরের মায়ায় আবিষ্ট করে রেখেছেন লাখো দর্শক-শ্রোতাকে বছরের পর বছর। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে বারী সিদ্দিকী ঢাকার স্কয়ার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃতু্যবরণ করেন ২৪ নভেম্বর ২০১৭। বাউলবাড়ির আঙিনায়ই বারী সিদ্দিকীকে কবর দেওয়া হয় তার অন্তিম ইচ্ছা অনুযায়ী। বারী সিদ্দিকী সশরীরে না থাকলেও তার রেখে যাওয়া মায়া জড়ানো গানে দর্শকদের মাঝে অমর হয়ে আছেন।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে