বাঙালি নারীর শাশ্বত রূপ-বৈচিত্র্য যিনি পর্দায় নিপুণ দক্ষতায় ধারণ করেছিলেন, তিনি কবরী। তিনি বাংলাদেশের অগণিত মানুষের চিত্ত জয় করেছিলেন অভিনয় গুণে। সুচিত্রা সেনের ইমেজ তৈরি হয়েছিল তার ভেতর। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান স্মরণীয়। দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমে যার উপস্থিতি ছিল অনিবার্য। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া যোদ্ধাদের সাহায্যে তিনি অন্যদের সঙ্গে অর্থ সংগ্রহ করেছিলেন সাংস্কৃতিক দলের কর্মীদের সঙ্গে ট্রাকে, বাসে, পায়ে হেঁটে। অভিনেত্রী থেকে হয়েছিলেন সংসদ সদস্য। তার বিপুল কর্মযজ্ঞ ইতিহাসের পাদপ্রদীপের আলোয় তাকে উদ্ভাসিত করেছে। বিংশ শতাব্দীর ষাট ও সত্তরের দশকে কবরী দর্শক আদ্রিত হয়েছিলেন।
\হতিনি ২০০৮ সালে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দলের প্রার্থী হয়ে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ২০১৪ সাল পর্যন্ত কাজ করেন। ২০১৭ সালে প্রকাশিত হয় তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ 'স্মৃতিটুকু থাক'।
সিনেমা দেখা অনেকের হবি। ষাট ও সত্তরের দশকে বাংলা সিনেমা নিটোল গল্প ও অভিনয় দক্ষতায় উঁচুমানের ছিল। বাব-চাচারা এসব সিনেমার ভক্ত ছিলেন। পরে আমরা ভক্ত হয়ে উঠি। টিফিনের পয়সা বাচিয়ে আমরা স্কুল ফাঁকি দিয়ে এসব সিনেমা আমরা দেখতাম। নির্দিষ্ট সিনেমা ছাড়া অধিকাংশ সিনেমার কিছু দেখে হল থেকে পালাতাম। কিন্তু ব্যতিক্রম ছিল কবরী-রাজ্জাক জুটির সিনেমা।
\হকবরী ছিলেন স্বপ্নের নায়িকা। অসম্ভব প্রাণখোলা হাসি, কথা প্রক্ষেপণ, দুষ্টু-মিষ্টি আচরণ তাকে আমাদের কাছে গ্রহণীয় করে তুলেছিল। আমাদের পূর্বপুরুষদের নায়ক-নায়িকা ছিলেন উত্তম-সুচিত্রা। উত্তম-সুচিত্রার কেমিস্ট্রি ছিল অম্স্নমধুর। তাদের পোশাক শাড়ি, শার্ট, প্যান্ট, চুলের স্টাইল, প্রসাধন বাঙালি নর-নারীকে আকৃষ্ট করত। এমনকি কাজল পরা, মুখের কালো তিল, গানের দৃশ্যের অন্তরঙ্গতা ছিল নজরকাড়া।
উত্তম-সুচিত্রা জুটির পাশাপাশি ষাট ও সত্তরের দশকের ইংরেজি সিনেমার নায়ক-নায়িকা, কাহিনির নাটকীয়তা মুগ্ধ করার মতো ছিল। এর মধ্যে কবরী-রাজ্জাক ঝড়ের মতো এসে মানুষের চিত্ত জয় করেছিলেন। কবরী অনেক নায়কের বিপরীতে অভিনয় করেছেন। সবখানেই সাফল্যের চূড়া স্পর্শ করেছেন। তিনি যখন অভিনয় শুরু করেন তখন প্রযুক্তির উন্নয়ন এমন ঘটেনি। লাইট, সাউন্ড, স্টেজ, এডিটিং, ফটোশপের আধুনিক ব্যবহার ঘটেনি। সাদামাটা কাহিনিকে অসাধারণ দক্ষতায় দর্শকনন্দিত করার কৃতিত্ব ছিল কবরীর।
কবরী সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে বিশেষভাবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। সুভাষ দত্তের আবিষ্কার যে হীরা চিনিয়েছিল তা পরে প্রমাণিত হয়েছে। ময়নামতি, তিতাস একটি নদীর নাম, সারেং বৌ, নীল আকাশের নীচে, সুজন সখী প্রভৃতি সিনেমাতে কবরী ধ্রম্নপদি ধারার অভিনয়শৈলীতে দর্শক হৃদয় জয় করেন।
অভিনয়, প্রযোজনা, পরিচালনা দিয়ে তার সাত দশকের জীবন পরিপূর্ণ ছিল। মনের গহীনে দুঃখ ছিল। সব সৃজনশীল মানুষের অতৃপ্তি থাকে। কবরীরও ছিল। তাইতো তাকে বলতে হয়েছে, জীবনে ভালো বন্ধু পেলাম না। না স্বামী, না বন্ধু। সন্তানরা দূরে থাকে। কারো সঙ্গে গল্প করা- একসঙ্গে কফি খাওয়ার মুহূর্ত তার জীবনে আসেনি, তিনি আক্ষেপ করেছেন।
সুতরাং ছবির জরিনা চরিত্রে কাকে কাস্ট করা যায় এমন একজনকে খুঁজে ফিরছিলেন সুভাষ দত্ত। সঙ্গীত পরিচালক সত্য সাহা চট্টগ্রামের এক মঞ্চ কর্মী মীনা পালের সন্ধান দিলেন। মেয়েটি সাধারণ বাঙালি মেয়ের মতো, কিন্তু অসাধারণ অভিনয় করেন। প্রস্তাব শুনে সুভাষ দত্ত নড়েচড়ে বসেন। বিমানে চড়ে চট্টগ্রাম যান বিধি বাম। মীনা পাল তখন ময়মনসিংহে। সুভাষ দত্তের অনুরোধে ডা. কামাল মীনা পালের কিছু ছবি তুলে সুভাষ দত্তকে পাঠান। সুভাষ দত্ত নানা ব্যস্ততার কারণে মীনা পালের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করতে ভুলে যান। পরে ডা. কামালকে সুভাষ দত্ত জানান মেয়েটিকে তার পছন্দ হয়েছে। মেয়েটির বয়স তখন ১৩ কিংবা ১৪ বছর। মারাজি নয়তার মেয়ে অভিনয়ে আসুক। শুধু বাবার উৎসাহে মীনা পাল ঢাকায় আসেন। বিউটি বোর্ডিংয়ে তিনি আশ্রয় নেন। সালোয়ার-কামিজ পরা এক কিশোরীকে শাড়ি পরতে হয়। কণ্ঠ পরীক্ষায় অংশ নেয়ার জন্য ছুটতে হয় এক স্টুডিও থেকে অন্য স্টুডিওতে। চট্টগ্রামের আঞ্চলিক টান ছেড়ে মীনা পালের নায়িকা হয়ে ওঠার গল্পের সূচনা এ রকম। সৈয়দ শামসুল হককে দায়িত্ব দেয়া হয় মীনা পালের পোশাকি নাম দেয়ার। সব নামই কমন পড়ে যায়। অবশেষে নাম রাখা হয় কবরী। তিনি হয়ে যান কবরী।
কবরীর জন্ম ১৯৫২ সালের ১৯ জুলাই। বাবা কৃষ্ণ দাস পাল। মা বন্য প্রভা পাল। ১৯৬৩ সালে নৃত্যশিল্পী হিসেবে তার মঞ্চে অভিষেক। টেলিভিশন, রেডিওতে তিনি অংশগ্রহণ করেন। পরে মঞ্চ ও চলচ্চিত্রে অভিনয় করে খ্যাতির মধ্যগগনে আরোহণ করেন। ১৯৬৪ সালে অভিনীত ছায়াছবির জন্য তিনি আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র সম্মাননা পান। ১৯৬৫ সালে ফ্রাংক ফুট চলচ্চিত্র উৎসবে দ্বিতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পায় সুতরাং। মিষ্টি মেয়ে উপাধি তার নামের সঙ্গে যুক্ত হয়। পরের ছায়াছবি 'নীল আকাশের নীচে' কবরী জুটি বাঁধেন রাজ্জাকের সঙ্গে। 'হেসে খেলে জীবনটা', নীল আকাশের নীচে, গান হয়ে এলে, প্রেমের নাম বেদনা। ১৯৭৩ সালে জহিরুল হক পরিচালিত 'রংবাজ' ছবি মুক্তি পায়। এ চলচ্চিত্র গতানুগতিক ধারা বদলে দেয়। ১৯৭৩ সালে কবরী অভিনীত তিতাস একটি নদীর নাম মুক্তি পায়। রংবাজ ছবিতে কবরী ও নায়করাজ রাজ্জাকের অভিনয় ছিল অত্যন্ত আবেগঘন। তার সঙ্গে ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত সিনেমাটি পরিচালনা করেন জহিরুল হক। এর 'হৈহৈরৈরৈ রঙিলা' 'সে যে কেন এলো না' এ গানগুলো মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
তিতাস একটি নদীর নাম ঋত্বিক ঘটকের 'তিতাস একটি নদীর নাম' কালজয়ী সাহিত্যনির্ভর ছবি। যা অদ্বৈত মলস্ন বর্মণের কাহিনি নিয়ে তৈরি। এ ছায়াছবিতে ১৯৭৩-এ কবরী অনবদ্য অভিনয় করেন।
বেঈমান কবরী, রাজ্জাক অভিনীত আলোচিত ও সফল ছায়াছবি। এ ছবিতেও তার নায়ক ছিলেন নায়করাজ রাজ্জাক। ১৯৭৪ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ ছবি পরিচালনা করেন রুহুল আমিন। মাসুদ রানা গোয়েন্দা চরিত্র মাসুদ রানা রূপায়িত হয় চলচ্চিত্রে। চলচ্চিত্র মাসুদ রানাতে অভিনয় করেন সোহেল রানা অলিভিয়া, সোহেল রানা ও কবরী। মুক্তি পায় ১৯৭৪ সালে। সুজন সখী ১৯৭৫ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত কবরী-ফারুক অভিনীত ছায়াছবি। ছবির অন্যতম রোমান্টিক পিস হিসেবে ধরা হয়। পরিচালনা করেন চলচ্চিত্রকার খান আতাউর রহমান। পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে দুই ভাইয়ের বিচ্ছেদ ও তাদের মিলনের গল্প উঠে এসেছে চলচ্চিত্রে। সারেং বৌ নোয়াখালীর উপকূলীয় অঞ্চলের একটি গ্রামের সহজ-সরল মেয়ে নবিতুনকে নিয়ে এর গল্প। নারীর জীবন যুদ্ধের কাহিনি স্থান পায় এ ছবিতে। বউ উপন্যাস ও চলচ্চিত্রে উঠে এসেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জনপদে নারীর সংগ্রাম। চরিত্র সার্থকভাবে ফুটিয়ে তোলেন কবরী। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান কবরী। কবরীর বিপরীতে অভিনয় করেন ফারুক।
১২ দিন করোনাভাইরাসের সঙ্গে তাকে যুদ্ধ করতে হয়। কিংবদন্তি অভিনেত্রী কবরী ২০২১ সালের ১৭ এপ্রিল রাজধানীর শেখ রাসেল গ্যাস্ট্রো লিভার হাসপাতালে মৃতু্যবরণ করেন। কবরীর মতো উঁচুমানের শিল্পী যুগে যুগে আসবে না। তার স্থান অপূরণীয়। কবরী অভিনীত ছায়াছবি সংরক্ষণ করা জরুরি। কালের বিবর্তনে কবরী যেন না হারিয়ে যায় সেদিকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে লক্ষ রাখতে হবে। তার অভিনয়শৈলী ও চলচ্চিত্র নিয়ে বিস্তর গবেষণার অবকাশ রয়েছে।