কেমন আছেন সেই কিশোরী নায়িকা সুজাতা

প্রকাশ | ০২ এপ্রিল ২০২৪, ০০:০০

মাসুম বিলস্নাহ রাকিব
সুজাতা
ষাট দশকের অন্যতম জনপ্রিয় নায়িকা সুজাতা। ক্যারিয়ারে অনেকগুলো সুপারহিট সিনেমা উপহার দিয়েছেন তিনি। প্রায় তিন শতাধিক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। ক্যারিয়ারের শুরুতেই এক 'রূপবান' সিনেমায় অভিনয় করেই কিংবদন্তির পর্যায়ে চলে যান সুজাতা। যা গোটা ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতেই একটি বিরল ঘটনা। তিনি যখন নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন তখন তার বয়স মাত্র ১২। আবার কাকতালীয়ভাবে সবচেয়ে বড় সত্যটি হচ্ছে তিনি যে চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন সেই চরিত্রটিও মাত্র ১২ বছরের। ফলে নিজে যেমন ১২ বছরের তেমন চরিত্রটিও ১২ বছরের, এমন একটি নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে পারাও একটি বিরল ঘটনা। কারণ, শুধু উপমহাদেশেই না, বিশ্ব চলচ্চিত্রেও দেখা যায় গল্পের চরিত্রের বয়স এক আর তার অভিনেতা বা অভিনেত্রীর বয়স তার উল্টো। যেমন- দেবদাস উপন্যাসের নাম চরিত্রে নায়ক বুলবুল আহমেদ যখন অভিনয় করেন তখন তার বয়স ছিল প্রায় ৪৫ আর উপন্যাসে দেবদাসের বয়স মাত্র ১৭। এই ব্যতিক্রম প্রমথেশ বড়ুয়ার ক্ষেত্রেও দেখা গেছে। অর্থাৎ বয়সের হিসাবে আজ পর্যন্ত দেবদাসের প্রকৃত রূপায়ন ঘটেনি। সেক্ষেত্রে লোককাহিনী নির্ভর রূপবান সিনেমার চরিত্রে একমাত্র সুজাতাই প্রথম যিনি চরিত্রটির মূল বয়সের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই নায়িকা চরিত্রে অভিনয় করতে পেরেছিলেন। মাত্র ১২ বছর বয়সি নায়িকার চরিত্রে এই সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন তিনি। তখন তার প্রকৃত নাম তন্দ্রা মজুমদার। তবে পরিচালক সালাহউদ্দিন চলচ্চিত্রের পরিচয় হিসেবে তার নাম রাখেন সুজাতা। 'রূপবান' সিনেমার আগে ওই একই পরিচালকের 'ধারাপাত' সিনেমার মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিষেক হয় সুজাতার। বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে একেবারে সংক্ষিপ্ত যে কয়টি ব্যবসা-সফল সিনেমার নাম করা হবে তাতে প্রথমেই থাকবে 'রূপবান' সিনেমাটি। বছরের পর বছর চলা সেই সিনেমাটি কত ব্যবসা করেছিল সেটার সঠিক হিসাব কেউ না দিতে পারলেও তখনকার টাকার মান হিসেবে নিশ্চিতভাবে বলা যেতে পারে এটা পরবর্তী যে কোনো সিনেমার চেয়ে বেশি ব্যবসা করেছিল। এটা ছিল আবার সেই সময়ের কথা যখন হল মালিকরাও সব টাকার হিসাবও পরিবেশক বা প্রযোজকের কাছে দিতেন না। তখন ব্যবসার হিসাবেও থাকত বিস্তর গড়মিল। তখন প্রযোজক বা পরিবেশক আজকের মতো এত কড়ায়-গন্ডায় হিসাব নিতে পারতেন না। বলা যায়, সুজাতার জীবনের মোড়ই ঘুরিয়ে দেয় 'রূপবান'। এ সিনেমায় অভিনয়ের আগে তার ইচ্ছে ছিল প্রথমে থিয়েটারে অভিনয়ে নিয়মিত হবেন, তারপরে করবেন চলচ্চিত্রে অভিনয়। কিন্তু রূপবানের অভাবনীয় সাফল্যের কারণে থিয়েটারে ফিরে যাওয়া হয়নি তার। রূপবান চলচ্চিত্রটি এতটাই দর্শক সমাদৃত হয় যে, সেসময় মফস্বলের কোনো কোনো সিনেমা হলে রূপবান একটানা এক বছর ধরে চলেছিল। সুজাতা অভিনীত উলেস্নখযোগ্য আরও সিনেমার মধ্যে রয়েছে- 'ডাক বাবু', 'জরিনা সুন্দরী', 'অপরাজেয়', 'আগুন নিয়ে খেলা', 'কাঞ্চনমালা', 'আলিবাবা', 'বেঈমান', 'অনেক প্রেম অনেক জ্বালা', 'প্রতিনিধি' ইত্যাদি। বর্তমানে চলচ্চিত্রে অভিনয় কমিয়ে দিলেও ছোট পর্দার নাটকে প্রায় নিয়মিত অভিনয় করছেন রূপবানকন্যা সুজাতা। আর সংসার-সন্তান নিয়ে কাটছে তার জীবনের নানা রঙের দিনগুলো। এ অভিনেত্রীর দিনগুলো বর্তমানে কেমন যায় এ নিয়ে কথা বলার জন্য দৈনিক যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে এ অভিনেত্রীর সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি জানান, 'কিছু দিন আগে শুটিং থেকে ফেরার পথে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হই। এখনো সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে উঠিনি। হার্টের বস্নক ধরা পড়েছে। নিয়মিত ওষুধ খাচ্ছি।' নতুন কাজের ব্যাপারে জানতে চইলে তিনি জানান, কায়সার আহমেদ পরিচালিত 'বকুলপুর সিজন ২' ধারাবাহিক নাটকের শুটিং করছি। ধারাবাহিকটি দীপ্ত টিভিতে চলছে। ইতোমধ্যে এটির ৪০০ পর্ব পেরিয়ে গেছে।' বর্তমানে তো আপনাকে নতুন পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করতে হয়। এই নতুনদের সঙ্গে আপনার কাজ করার অভিজ্ঞতা কেমন জানতে চাইলে এ বরেণ্য ও গুণী অভিনেত্রী বলেন, 'খুব ভালো। নতুনরাও এখন ভালো কাজ করছে। তাদের কাজের ধরন অনেকটাই ভালো।' এরই মধ্যে 'অপারেশন জ্যাকপট' সিনেমার শুটিং শেষ করেছেন সুজাতা। তবে সিনেমায় তার অভিনয় করা হয় খুবই কম। আবার তেমন ভালো গল্পের কোনো সিনেমায়ও কাজ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। তবে এখনো তার প্রবল আগ্রহ রয়েছে সিনেমায় অভিনয় করার। চলচ্চিত্রে চরিত্র অভিনেত্রীর অভাব এবং যারা বাইরে থেকে আসছে তারাও ভালো জায়গা করে নিতে পারছেন না। এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এ অভিনেত্রী আক্ষেপের সঙ্গে বলেন, 'চরিত্র অভিনেত্রী পাওয়া গেলেও কেউ সিনেমায় নিচ্ছে না। আমাদের সময়ের যারা আছেন তাদের নিয়ে এখন কাজ করেন না। আমার কথাই ধরেন, আমার উপরে কেউ কি গল্প লিখে, না আমাকে সব সিনেমায় ডাকে। এভাবে অনেক ভালো ভালো পরিচালকও ইন্ডাস্ট্রি থেকে চলে গেছে। কিন্তু এইসব গুণী মানুষদের ধরে রাখবে এমন মানুষ চলচ্চিত্রে এখন নেই। আমাদের চলচ্চিত্রে অভিনয় শিখানোর মতো এখন শিক্ষক নেই। আমরা কি শুরুতে অভিনয় জানতাম। আমাদের শিখিয়ে নেওয়া হয়েছে। আর এখন সিনেমার বাজেট কম এই কথা বলে নায়ক-নায়িকা আর ভিলেন দিয়ে সিনেমার কাজ শেষ করে দেয়। এটা একটা ভুল সিদ্ধান্ত। এখন তো পারিবারিক গল্প নিয়ে সিনেমাই নির্মাণ হয় না। একটা সিনেমা তখনই পরিপূর্ণ হয় যখন সব চরিত্রের অভিনয় শিল্পী দিয়ে পর্দা ভরাট থাকে। মা-বাবা, ফুফু-খালা, ভাই-বোন এই সব ছোটখাটো চরিত্রগুলো সিনেমার খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু এইসব চরিত্রে এখন গুরুত্ব দিচ্ছে না। আপনি কি আবারও পরিচালনায় ফিরবেন? সঠিক বলতে পারছি না। আর কতদিন বাঁচব সেটাও জানি না। তবে একটা সিনেমা করার ইচ্ছে আছে। আর সে সিনেমায় আমার ছেলে ফয়সাল আজিমকে করব নায়ক। যদি পরিচালনায় আসতে পারি আসব, না আসতে পারলে আসব না। এখন তো কেউ আমাদের দিয়ে সিনেমা করায় না। কারণ অভিজ্ঞতার তো কোনো দরকার নেই। আমি অভিনয়ের পাশাপাশি একজন লেখক। আমার ৫-৭টা বই বের হয়েছে। এই বইয়ের ব্যাপারে অন্য সময় কথা বলব। অনেক কথা আছে বলে শেষ করা যাবে না। কীভাবে 'রূপবান' হয়ে উঠলেন সে সম্পর্কে জানতে চাইলে সুজাতা আজিম বলেন, 'রূপবান সিনেমা আমি যখন করি তখন আমার বয়স ছিল কম। ১২ বছরের মেয়ে আর ১২ দিনের ছেলে নিয়ে গল্প। আমার বয়সও ছিল তখন ১২। তাই ছবিটি মুক্তির পর যখন সুপারহিট হয় বয়স কম থাকায় তখন আমি বুঝতে পারিনি সিনেমাটি নিয়ে বাইরে কীরকম উত্তেজনা চলছে। কারণ সেটা বোঝার ক্ষমতাই তো ওই বয়সে আমার হয়নি। এতে বরং আমার জন্য ভালোই হয়েছে। নিজের মধ্যে এ নিয়ে অহংকারের জন্ম হয়নি। নিজের মধ্যে স্বাভাবিক থাকতে পেরেছিলাম। তবে আমি অনেক পরে বুঝতে পারি কিরকম একটা সুপারহিট ছবির নায়িকা ছিলাম আমি। সিনেমাটি সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছিল। মানুষের মুখে মুখে রূপবানের গান শোনা যেত। এ বিষয়গুলো ছিল আমার জন্য খুব উপভোগ্য। আমার রূপবানের পরে তো অনেক রূপবান সিনেমা হয়েছে কিন্তু আমারটার মতো আর কোনোটাই হয়নি। অ্যাকচু্যয়াল চরিত্র হিসেবে আমিই প্রথম রূপবান এবং আমিই শেষ রূপবান।