টিভি নাটক, চলচ্চিত্র বা ওটিটি কনটেন্ট- সব ক্ষেত্রেই সবার আগে যেটা জরুরি সেটা স্ক্রিপ্ট বা পান্ডুলিপি। আর এই স্ক্রিপ্টের সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বলা হয় 'স্ক্রিপ্ট রাইটার'। একটি নাটক বা সিনেমার জন্য যে প্রি-প্রোডাকশেনের কাজে নামতে হয় তার শুরুতেই আসে তার গল্প এবং সেই গল্পের ওপর স্ক্রিপ্ট লেখার কাজ। তাই প্রত্যেক নির্মাতাকেই মূল কাজে নামার আগে প্রি-প্রোডাকশনের কাজ হিসেবে একজন স্ক্রিপ্ট বা পান্ডুলিপি রচয়িতার কাছে যেতেই হবে। এটাই নাটক-সিনেমা বানানোর অবশ্যম্ভাবী রেওয়াজ।
নাটকের স্ক্রিপ্ট হচ্ছে নাটকের নকশা। ভালো কিছু বানাতে দরকার ভালো হাতের নকশা। উন্নত একটি বিল্ডিং নির্মাণের শুরুতেই একজন ভালো স্থপতির নকশার প্রয়োজন হয়। জাহাজ, যুদ্ধবিমান বানাতে লাগে নিখুঁত নকশা। গাড়ির নিত্যনতুন মডেল তৈরির প্রথমেই ঠিক করতে হয় সেটার নকশা কেমন হবে। ভালো ও সুন্দর সব কিছুর জন্যই দরকার পাকা হাতের নকশা। নাটকের স্ক্রিপ্টও তাই।
আবার সিনেমায় স্ক্রিপ্ট হলো মূলত একটি খাঁচা। যেখানে বলার চেয়ে দেখানোর কাজটিই বেশি থাকবে। এমন একটি খাঁচা তাতে সবই থাকবে কিন্তু সেটা হবে শর্টহ্যান্ডের মতো। যেটি পুরো সিনেমাকে একজনের চোখের সামনে দৃশ্যের পর দৃশ্য দেখতে সাহায্য করবে। স্ক্রিপ্ট হলো সিনেমার ৫০%, স্ক্রিপ্ট অসাধারণ তো তার পরিচালনার কাজও একেবারে পানির মতো সহজ হয়ে গেল। এমনকি ক্ষেত্রবিশেষে সিনেমাটোগ্রাফার বা এডিটরকেও বলতে হবে না কোথায় আর কী করা লাগবে। ভালো স্ক্রিপ্ট রাইটার হলে তার স্ক্রিপ্ট পড়েই পরিচালক ধরে ফেলতে পারবেন পুরো গল্পটি। যে স্ক্রিপ্ট খুবই ভালো তাতে কখনোই ওভার রাইটিং বা অতি লিখনের দোষ থাকে না। এখানে অতি লিখন অবশ্যই একটা বাজে দোষ হিসেবে ধরা হয়। এমনকি প্রয়োজনের তুলনায় বেশি সংলাপও দোষের বিষয়। এগুলো ভালোমতো বোঝার জন্য অবশ্যই পেশাদার স্ক্রিপ্ট রাইটার জরুরি। কারণ স্ক্রিপ্ট ভালো তো নাটক, সিনেমা সবই ভালো। স্ক্রিপ্টই সিনেমার বস্নু প্রিন্ট। একজন নির্মাতার বস্নু প্রিন্ট যত ভালো, সিনেমাও তত ভালো হবে। অবশ্য এটা প্রাথমিক নিশ্চয়তা। কারণ সিনেমায় স্ক্রিপ্টই সব নয়, আরও অনেক বিষয়-আশয় আছে।
অনেকে আছেন স্ক্রিপ্ট লিখতে গিয়ে শুধু গল্প লিখে বসে থাকেন। তারা হয় কখনো স্ক্রিপ্ট লেখেননি বা স্ক্রিপ্ট লেখার গুরুত্ব অনুধাবন করতে পারেননি। স্ক্রিপ্ট লিখতে প্রথমেই দরকার ভালো গল্প। যদিও সব সময়ই ভালো গল্প হতে হবে এমন কোনো কথা নেই। অনেক সিনেমার মূল গল্পটা আহামরি কিছু না হলেও শুধু অভিনয় বা গল্পকারের বলার ঢঙের কারণেই সিনেমাটি অসাধারণ হয়ে গেছে। যেখানে থাকবে অসাধারণ ফিনিশিং। ফিনিশিং যদি সাদামাটা বা জৌলুসহীন হয়, তাহলে সে সিনেমাকে কেউ মনে রাখবে না। সে জন্য চূড়ান্তভাবে দরকার ক্ষুরধার 'চিন্তা'। এভাবে ক্ষুরধার চিন্তার জোরেই একটি সাধারণ গল্পকেও অসাধারণ করে তোলা যায়। যারা এরকম স্ক্রিপ্ট রচনা করতে পারেন নিঃসন্দেহে তারা পেশাদার। যারা এর মাধ্যমেই নিজেদের জীবন নির্বাহ করেন। পরিবার, সংসার চালান।
কিন্তু অনেকদিন ধরেই সেই রেওয়াজটি বদলাতে শুরু করায় তাদের সেই একসময়ের সুখের সংসারে যেন একটা টানাপড়েন চলছে। বিশেষ করে যারা টিভি নাটকের জন্য স্ক্রিপ্ট লিখে জীবন নির্বাহ করেন তারা তো অবশ্যই। এখন দেখা যাক যারা এই পান্ডুলিপি রচনা করে জীবন নির্বাহ করেন, এ নিয়ে কে কী বলেন। বাংলাদেশে যারা নাটকের পান্ডুলিপি লিখে জনপ্রিয়তা পেয়েছেন তাদের মধ্যে বৃন্দাবন দাস অন্যতম। নাটক লিখতে গিয়ে নাট্যকাররা সাংসারিক টানাপড়েনে বা আর্থিক দুর্গতিতে আছেন কিনা এ প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, 'আমাদের মতো যারা মুষ্টিমেয় কয়েকজন পেশাদার নাট্যকার আছেন তারা কেউই এমন আর্থিক সংকটে নেই। একটি সংগঠনে স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে এক থেকে দেড়শ' সদস্য থাকতেই পারেন। তাই বলে তারা সবাই পেশাদার এটা আমি মনে করি না।'
আমাদের দেশে নাটক লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়া সম্ভব কিনা এর উত্তরে তিনি বলেন, 'এ দেশের শিল্প-সংস্কৃতির কোনোটাকেই পেশা হিসেবে বেছে নেওয়া সম্ভব নয়। সেটা যেমন স্ক্রিপ্ট লেখার ক্ষেত্রে, তেমনি অভিনয়ের ক্ষেত্রেও। আজকে যিনি সুপার-ডুপার নায়ক বা নায়িকা কালকে তার এই অবস্থা না-ও থাকতে পারে। আমি যে এখন স্ক্রিপ্ট লিখতে পারছি একসময় সেটা না-ও থাকতে পারে। কাজেই এখানে নাটক লেখাকে পেশা হিসেবে নেওয়াটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ। এসএ হক অলিক স্ক্রিপ্ট লেখার পাশাপাশি অভিনয় ও পরিচালনা করে থাকেন। কিন্তু তিনি স্ক্রিপ্টকে একমাত্র পেশা হিসেবে নেননি। এর পাশাপাশি অন্যান্য কাজও করছেন।'
এ প্রসঙ্গে আহসান হাবিব সকাল বলেন, 'একটা স্বপ্ন দেখেই শিল্প-সংস্কৃতির এই মাধ্যমটিতে এসেছিলাম। ভেবেছিলাম স্ক্রিপ্ট লিখে নিজের ভাগ্য ফেরাতে পারব। এ জন্য নিজের স্থায়ী চাকরিও ছেড়েছি। এখন দেখি সবই মরীচিকা। খুবই আর্থিক সংকটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে সংসার। আমার মতো আর বহু নাট্যকারই আছেন, যারা শুধু নাটক লিখে সংসার চালাতে পারছেন না। সেজন্য পাশাপাশি অন্য কিছু করতে হয়। তখন একটি ভালো মানের স্ক্রিপ্ট যে লিখবেন সেই মনমানসিকতা থাকে কী করে।' তার মানে দেশের নাটকের মান দিন দিন পড়ে যাওয়ার পেছনে এটাও একটা বড় কারণ।
দেশে নাটক লেখাকে পেশা হিসেবে কেন নেওয়া যাচ্ছে না এ নিয়ে নানাজনে নানা কথা বলেন। প্রয়াত অভিনেতা, নাট্যকার ও পরিচালক মাসুম আজিজ যায়যায়দিনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, 'এখন নাটক বানাতে স্ক্রিপ্ট লেখারও দরকার হয় না। শুটিংয়ের সময় দেখা যাচ্ছে কলাকুশলী, পরিচালক সবাই কাজের এক ফাঁকে বসে গল্পগুজব করছেন। তখন কারো মাথায় একটা আইডিয়া এসে গেল। পছন্দ হলেই সে গল্পভাবনা নিয়ে একটা গোঁজামিল দিয়ে অন্য কোনো সময়ে নাটক বানানোর কাজ শুরু গেল।' এগুলোই হচ্ছে নাটকের গল্পভাবনা। অর্থাৎ এখন স্ক্রিপ্ট না হলেও চলে। সিনেমা বা নাটক বানানোর এই চল যেখানে প্রবল সে দেশে কী করে আলাদাভাবে কেউ স্ক্রিপ্ট লেখাকে পেশা হিসেবে বেছে নিতে পারবেন? ফলে মাসুম রেজা, বৃন্দাবন দাসদের মতো সেভাবে নতুন জনপ্রিয় নাট্যকারও আর তৈরি হতে পারছেন না। নাট্যকাররা মনে করেন, এ কারণেই প্রতিদিন বিটিভিসহ দেশের সব বেসরকারি চ্যানেলগুলোতে জমছে হাবিজাবি নাটক। কিন্তু তার পরও যতই হাবিজাবি নাটক-সিনেমা হোক, এগুলোও যাদের স্ক্রিপ্টের ওপর বানানো হচ্ছে সেই সব নাটক সিনেমার নায়ক-নায়িকারা প্রচুর টাকা রোজগার করতে পারলেও একজন স্ক্রিপ্ট রাইটারকে কিন্তু গরিবই থেকে যেতে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত কম সম্মানী পাওয়ার কারণে। তার ওপর একটি নাটক বা সিনেমা যতই জনপ্রিয় হোক স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবেও তার নামটি প্রায় আড়ালেই থেকে যায়।
সে জন্য অনেকেই এখন আর শুধু স্ক্রিপ্ট রাইটিংয়েই সীমাবদ্ধ থাকতে চান না। যেমন হিমেল আশরাফ। তিনি একাধারে স্ক্রিপ্ট রাইটার, আবার পরিচালকও। 'প্রিয়তমা' ছবিটির জন্য পেয়েছেন তুমুল পরিচিতি। যদি তিনি ছবিটির শুধুই স্ক্রিপ্ট রাইটার হতেন, তাহলে এমন পরিচিতি কি হতো তার!