দীর্ঘ রাজনৈতিক সংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতিতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে নামতে হয়েছিল বাঙালিকে। নয় মাসের এ মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে বাংলাদেশের মানুষকে। চড়া দামেই কিনতে হয়েছে স্বাধীনতা। এ গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধকে রুপালি পর্দায় ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা শুরু হয় যুদ্ধের সেই উত্তাল সময় থেকেই, যা আজও অব্যাহত রয়েছে। বিভিন্ন সময়ে দেশের গুণী নির্মাতারা চেষ্টা করেছেন জাতির সোনালি সময়টা জীবন্ত ফুটিয়ে তুলতে। নির্মাণ করেছেন মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক অনেক পূর্ণদৈর্ঘ্য সিনেমা। পাশাপাশি হয়েছে বহু শর্টফিল্মসহ ডকু্যমেন্টারি।
স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত যেসব উলেস্নখ্যযোগ্য মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা হয়েছে তার মধ্যে সর্বপ্রথমই নাম করতে হয় মাসুদ পারভেজ প্রযোজিত এবং চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'ওরা ১১ জন' সিনেমাটির কথা। যারা দুজনেই ছিলেন '৭১-এর রণাঙ্গন থেকে যুদ্ধ ফেরত মুক্তিযোদ্ধা। চাষী নজরুল ইসলাম শুধু মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার প্রথম পথিকৃৎই নন, এক্ষেত্রে তিনি ছিলেন একজন আইকনও। 'ওরা ১১ জন' ছাড়াও তার আরও একটি চাষী নজরুল ইসলাম পরিচালিত 'সংগ্রাম' সিনেমাটিও উলেস্নখযোগ্য। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমার মধ্যে সবচেয়ে বেশি সিনেমা বানিয়েছেন চাষী নজরুল ইসলামই। মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা হিসেবে তার কাজগুলোই সবচেয়ে সফল ও জনপ্রিয় হয়েছে। এক্ষেত্রে 'মেঘের পরে মেঘ', 'কামালপুরের যুদ্ধ', 'ধ্রম্নবতারা', 'হাঙর নদী গ্রেনেড' তার আরও উলেস্নখযোগ্য সিনেমা। তা ছাড়া আরও যেসব মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা আলোচিত সেগুলোর মধ্যে রয়েছে- সুভাষ দত্তের 'অরুণোদয়ের অগ্নিসাক্ষী', খান আতাউর রহমানের 'আবার তোরা মানুষ হ' ও 'এখনো অনেক রাত', আনন্দের 'বাঘা বাঙ্গালী', মমতাজ আলীর 'রক্তাক্ত বাংলা', কাজী হায়াতের 'সিপাহী', নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু পরিচালিত 'গেরিলা' ও একাত্তরের যীশু', তারেক মাসুদের 'মাটির ময়না', জহির রায়হান পরিচালিত 'জীবন থেকে নেওয়া', তানভির মোকাম্মেলের 'চিত্রা নদীর পারে', 'রূপসা নদীর বাঁকে', 'জীবনঢুলী' এবং 'নদীর নাম মধুমতী' আলমগীর কবিরের 'ধীরে বহে মেঘনা' হুুমায়ূন আহমেদের 'শ্যামল ছায়া' ও 'আগুনের পরশমণি' তৌকীর আহমেদের 'স্ফুলিঙ্গ', ও 'জয়যাত্রা', ফাখরুল আরেফিন খানের 'ভুবন মাঝি', মান্নান হীরার 'একাত্তরের ক্ষুদিরাম', জাহিদুর রহিম অঞ্জনের 'মেঘমলস্নার', মোরশেদুল ইসলামের 'খেলাঘর' 'অনিল বাগচীর একদিন' ও 'আমার বন্ধু রাশেদসহ আরও অনেক সিনেমা।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা হচ্ছে 'ওরা ১১ জন'। সিনেমাটি পরিচালনা করেছেন প্রয়াত নির্মাতা চাষী নজরুল ইসলাম। এতে অভিনয় করেছেন নায়করাজ রাজ্জাক, শাবানা, নূতন, হাসান ইমাম, এটিএম শামসুজ্জামান, খলিলউলস্নাহ খান প্রমুখ। সিনেমাটিতে বেশ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা অভিনয় করেছিলেন। এই সিনেমায় ১১ জনের ১০ জনই বাস্তবের মুক্তিযোদ্ধা। তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন খসরু, মুরাদ, হেলাল ও নান্টু।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা গেরিলা। সৈয়দ শামসুল হকের 'নিষিদ্ধ লোবানদ উপন্যাস অবলম্বনে নাসির উদ্দীন ইউসুফ পরিচালিত চলচ্চিত্র গেরিলা। জয়া আহসান, ফেরদৌস, এটিএম শামসুজ্জামান, রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, শতাব্দী ওয়াদুদ, শম্পা রেজা, গাজী রাকায়েতসহ সহস্রাধিক শিল্পী অভিনয় করেছেন এই ছবিটিতে। বাণিজ্যিকভাবে দারুণ সফল হয়েছিল চলচ্চিত্রটি, সঙ্গে জিতেছিল আন্তর্জাতিক সম্মাননাও।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে নির্মিত সিনেমা মাটির ময়না। অস্কারে বিদেশি ভাষার চলচ্চিত্র বিভাগে প্রথম বাংলাদেশি চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনয়ন লাভ করেছিল। কান উৎসবসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বেশ কিছু পুরস্কার লাভ করেছিল মাটির ময়না, যদিও শুরুর দিকে বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এই মুভিটি। তারপর ২০০৫ সালে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। তারেক মাসুদ, ক্যাথরিন মাসুদের এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, রোকেয়া প্রাচী প্রমুখ।
জহির রায়হান নির্মিত কালজয়ী সিনেমা জীবন থেকে নেওয়া। মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক সিনেমা না হলেও, এই সিনেমা মূলত তৈরি হয়েছিল ভাষা আন্দোলনের সময়কে ভাবনায় রেখে। তবে তার মাঝেও পরোক্ষভাবে ফুটে উঠেছে স্বাধীনতার ভাবনা। মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণাদায়ী মুভি হিসেবেও ধরা হয়ে থাকে এই মুভিকে। এই চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন রওশন জামিল, খান আতাউর রহমান, রাজ্জাক, সুচন্দা, আনোয়ার হোসেনের মতো গুণী শিল্পীরা।
একাত্তরের যীশু সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও নির্মাতা নাসির উদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু। ছবিটি আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের চিত্রকেই তুলে ধরেছে। শাহরিয়ার কবিরের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৯৩ সালে। চলচ্চিত্রে গির্জার ফাদার চরিত্রে অভিনয় করেছেন পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, গির্জার কেয়ারটেকার ডেসমন্ডের ভূমিকায় ছিলেন হুমায়ুন ফরীদি। তাদের অসাধারণ সাবলীল অভিনয় দক্ষতা চলচ্চিত্রটিকে প্রাণ দিয়েছে। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন জহির উদ্দিন পিয়াল, আবুল খায়ের, কামাল বায়েজিদ, শহীদুজ্জামান সেলিম, শতদল বড়ুয়া বিলু, সাইফুদ্দিন আহমেদ দুলাল, ইউসুফ খসরুসহ আরো অনেকে। ফ্রেমে মুক্তিযুদ্ধের দৃশ্যায়ন নিপুণভাবে তুলে ধরেছেন বেবী ইসলাম। প্রযোজনা করেছে অনুপম চিত্রায়ণ ট্রাস্ট। যীশুর মতো মুক্তিযোদ্ধারা জীবন দিয়েছিলেন এ দেশের মানুষকে স্বাধীনতা এনে দিতে। একটা গ্রামকে কেন্দ্র করেই একাত্তরের যীশু চলচ্চিত্র তুলে এনেছে আমাদের স্বাধীনতার গল্প, আত্মত্যাগের গল্প। চলচ্চিত্রটির সংলাপ লেখার জন্য সেলিম আর দীন শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র হাঙর নদীর গ্রেনেড। সেলিনা হোসেন রচিত উপন্যাস হাঙর নদী গ্রেনেড অবলম্বনে একটি মুভি তৈরি করতে চেয়েছিলেন প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়, যদিও তা করা হয়ে ওঠেনি। শেষ পর্যন্ত চাষী নজরুল ইসলাম চলচ্চিত্রটি তৈরি করেছিলেন। এই ছবিতে বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন সোহেল রানা, চম্পা, সুচরিতা, অরুণা বিশ্বাস প্রমুখ।
'নদীর নাম মধুমতী' সিনেমাটি রচনা ও পরিচালনা করেছেন তানভীর মোকাম্মেল। নূর আলী নিবেদিত চলচ্চিত্রটি প্রযোজনা ও পরিবেশনার দায়িত্বে ছিল কিনো-আই ফিল্মস। এতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছেন তৌকীর আহমেদ, আলী যাকের, রাইসুল ইসলাম আসাদ, সারা যাকের, আফসানা মিমি প্রমুখ। সিনেমার কাহিনি ও সংলাপ রচনার জন্য তানভীর মোকাম্মেল শ্রেষ্ঠ কাহিনিকার ও শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা বিভাগে এবং সাইদুর রহমান বয়াতি শ্রেষ্ঠ পুরুষ কণ্ঠশিল্পী বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেন।
বাংলাদেশের আরেক বিখ্যাত পরিচালক খান আতাউর রহমান মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নির্মাণ করেছেন 'আবার তোরা মানুষ হ'। সিনেমাটিতে যুদ্ধ-পরবর্তী সময়ের সামাজিক পরিবেশ ও বিশৃঙ্খলার চিত্র উঠে এসেছে। কেন্দ্রীয় চরিত্রে অভিনয় করেছেন চিত্রনায়ক ফারুক, অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ, চিত্রনায়িকা ববিতা, অভিনেত্রী রোজী আফসারী ও রওশন জামিলসহ অনেকে।
'ধীরে বহে মেঘনা' এটি নির্মাতা আলমগীর কবিরের প্রথম কাহিনিচিত্র। ভারতীয় মেয়ে অনিতার প্রেমিক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়। সে ঢাকায় এসে যুদ্ধের ভয়াবহতা দেখে আরও গভীরভাবে মর্মাহত হয়। মানবিকতাবোধে আচ্ছন্ন হয় তার হৃদয়। অভিনয়ে ছিলেন বুলবুল আহমেদ, ববিতা, গোলাম মুস্তাফা, আনোয়ার হোসেন, খলিল উলস্নাহ খান প্রমুখ।
প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও চলচ্চিত্রকার হুুমায়ূন আহমেদ পরিচালিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সিনেমা 'আগুনের পরশমণি'। নিজের লেখা উপন্যাস থেকেই সিনেমাটি নির্মাণ করেছেন তিনি। অভিনয় করেছেন বিপাশা হায়াৎ, আসাদুজ্জামান নূর, আবুল হায়াৎ, ডলি জহুর প্রমুখ। এ সিনেমাটি বেশ কয়েকটি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করে।
বাংলাদেশি যুদ্ধভিত্তিক সিনেমা 'আমার বন্ধু রাশেদ'। মুহম্মদ জাফর ইশবালের শিশুতোষ উপন্যাস থেকে এটি পরিচালনা করেছেন মোরশেদুল ইসলাম। অভিনয় করেছেন চৌধুরী জাওয়াতা আফনান। অন্যান্য চরিত্রে ছিলেন রাইসুল ইসলাম আসাদ, পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়, ইনামুল হক, হুমায়রা হিমু ও ওয়াহিদা মলিস্নক জলি। এছাড়া শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয় করেছেন রায়ান ইবতেশাম চৌধুরী, কাজী রায়হান রাব্বি, লিখন রাহি, ফাইয়াজ বিন জিয়া, রাফায়েত জিন্নাত কাওসার আবেদীন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে বা তার কিছু আগে থেকে শুরু করে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ঘটে যাওয়া মুক্তিযুদ্ধ সংক্রান্ত ঘটনাবলি এবং এসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে যে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তাই মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র। পূর্ণদৈর্ঘ্য, স্বল্পদৈর্ঘ্য ও প্রামাণ্যচিত্র এই তিন ধারায় নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোর আংশিক বা পূর্ণাংশে যদি মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয় বা কোনোভাবে প্রভাব বিস্তার করে, তবে এ সব চলচ্চিত্রকে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।