বিপাশা হায়াত একইসঙ্গে মডেল, অভিনেত্রী এবং চিত্রশিল্পী। বিপাশা মানেই ছোটপর্দায় বিভিন্ন চরিত্রের দাপুটে এক অভিনেত্রী। কী মঞ্চ, কী টিভি নাটক কিংবা চলচ্চিত্র- সব মাধ্যমেই এমন দু্যতি ছড়ানো প্রতিভা তো আর বছরে বছরে পাওয়া সম্ভব নয়। তার চিরচেনা প্রাণবন্ত হাসি এমনভাবে দর্শক মন ভরিয়ে দেয় যার আবেশ অনেক সময় পর্যন্ত লেগে থাকে। এমন গুণ বাংলাদেশের শোবিজে খুব কম কমই পাওয়া যাবে। নব্বই দশকের টিভি পর্দায় যে কয়জন অভিনেত্রী সবচেয়ে বেশি পাদপ্রদীপের আলোতে থাকতেন তাদের মধ্যে বিপাশা হায়াত শীর্ষস্থানেই থাকবেন। তার অভিনয়ে এমনই মুগ্ধতা ছড়ানো ছিল যে আজও ছোটপর্দায় সে সময়ের দর্শকরা তাকে খুঁজে বেড়ান। কিন্তু সেই বিপাশা দীর্ঘদিন হয়ে গেল ছোটপদা, বড়পর্দা থেকে অনেক দূরে। তবে কি তিনি আর কখনো ছোটপর্দায় বা বড়পর্দায় ফিরবেন না? এ প্রসঙ্গে বিপাশা হায়াত বলেন, 'আমেরিকায় আমার ছেলেমেয়েরা রয়েছে। তাই অভিনয় করা হচ্ছে না। অভিনয় যে একেবারেই মিস করি না তা নয়। এখনো মাঝেমধ্যে অভিনয়কে খুব মিস করি। তবে পর্দায় না হলেও আমি আবার মঞ্চে ফিরতে আগ্রহী।' বিপাশা হায়াত জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত দর্শকপ্রিয় অভিনেত্রী। নব্বই দশকের অনেক টিভি নাটকের অভিনয় তাকে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান অভিনেত্রী হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করেছে। মঞ্চনাটকেও তিনি সমানভাবে সফলতার পরিচয় দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের বছর ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আজকের এই দিনে জন্ম গ্রহণ করেন তিনি। আজকের দিনটির মধ্য দিয়ে ৫৪ বছরে পা রাখলেন তিনি। বিপাশা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় পড়াশোনা করেন। প্রখ্যাত অভিনেতা আবুল হায়াতের বড় কন্যা তিনি। পারিবারিকভাবেই শিল্প-সংস্কৃতির সঙ্গে আবাল্য পরিচয় থাকায় এক সময়ে তিনিও হয়ে উঠেছেন জাতশিল্পী। আশির দশকে 'খোলা দুয়ার' নাটকে বাবার মেয়ে হয়েই অভিনয় শুরু করেন। এরপর যুক্ত হন নাগরিক নাট্যসম্প্রদায়ে। টিভি নাটকে প্রথমে আলোচনায় আসেন 'অয়োময়' ধারাবাহিক দিয়ে। 'অয়োময়'-এর লবঙ্গ জনপ্রিয় এবং প্রশংসিত চরিত্র। 'রূপনগর' নাটকে সমূহ বিপদে থাকা তৌকীরকে বিপাশা দিয়েছিল মানসিক সাপোর্ট। চমৎকার একটি চরিত্র ছিল। 'থাকে শুধু ভালোবাসা' নাটকে ফেরদৌসের বিপরীতে বিপাশার করুণ প্রেমের অভিনয় দর্শক আজও মনে করে। 'তোমাকে ছুঁয়ে' নাটকে নিজের সময়ের আর একজন তুমুল জনপ্রিয় অভিনেত্রী শমী কায়সারের সঙ্গে স্ক্রিন শেয়ার করে অসাধারণ অভিনয় করেছে। এমন অনেক নাটক আছে বিপাশার যেগুলো কালজয়ী। পুরো নব্বই দশক জুড়েই বিপাশা ছিলেন শীর্ষ অভিনেত্রীদের মধ্যে একজন। একে একে অভিনয় করেন 'রূপনগর', 'আশিক সব পারে', 'শঙ্কিত পদযাত্রা', 'ছোট ছোট ঢেউ', 'অন্য ভুবনের ছেলেটা', 'শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই', 'বিপ্রতীপ', 'অতিথি', 'হার জিত', 'বিষকাঁটা', 'স্পর্শ', 'থাকে শুধু ভালোবাসা', 'বীজমন্ত্র', 'চেনা অচেনা মুখ', 'ভোর হয়ে এল', 'একা', 'লজ্জা', 'মায়াকুঞ্জ', 'কাগজের বউ', 'মামলার ফল', 'প্রত্যাশা', 'এক জোনাকি', 'কাদম্বিনী', 'সম্প্রীতি গাঁথা' প্রভৃতি নাটকগুলোতে। নব্বই দশকের ছোটপর্দায় যেমন একঝাঁক গস্নামার অভিনেত্রী ছিলেন সেটা পরবর্তীতে সেভাবে জ্বলে উঠতে দেখা যায়নি। আর কী আশ্চর্য যে সেইসব একঝাঁক গস্নামার অভিনেত্রীদের প্রায় সবাই ছোটপর্দা থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছেন। কালেভদ্রেই তাদের দেখা যায়। বিপাশা হায়াতকে তো একেবারেই দেখা যায় না। সেই শমী কায়সার, তারিন জাহান, তানিয়া আহমেদ, তানভিন সুইটি, শিরিন বকুল, ত্রপা মজুমদার (তিনি অবশ্য মঞ্চে সক্রিয়) সবাই যেন যার যার বৃত্তে বন্দি হয়ে আছেন। সেই সময়ে ছোটপর্দার অনেক অভিনেত্রীই লাক্সের বিজ্ঞাপন করেছিলেন। তবে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিক বিপাশাই পেতেন। মডেলিং জগতেও খেতাব ছিল তার। একটা সময় পর অভিনয় থেকে বিরতি নিয়েছিলেন। তবে যখনই ফিরে এসেছেন তখনই যেন স্বরূপেই যেন নিজেকে আলোকিত করেছেন। এর মধ্যে অন্যতম কাজ ছিল 'দুই বোন', 'হাতটা বাড়িয়ে দাও', 'দিল দরিয়া', 'চিনিখোর', 'ইনসমনিয়া', 'শেষ বলে কিছু নেই', 'ভুলোমন সেইজন', 'বিশ্বাসঘাতক', 'আমি তোমায় ভালোবাসি', 'হারানো সুর', 'আকাশের কাছাকাছি', 'প্রিয়জন', 'কালো গোলাপের কাব্য', 'তোমার বসন্ত দিনে' অন্যতম। জানা যায়, নব্বই দশকের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত' এ অভিনয়ের জন্য প্রস্তাব পেয়েছিলেন বিপাশা। তবে কমার্শিয়াল ছবি করবেন না বলে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন। এরপর দু'টি মুক্তিযুদ্ধের সিনেমা 'আগুনের পরশমনি' ও 'জয়যাত্রা'য় অভিনয় করেন। অভিনয়ের বাইরে বিপাশা যেমন নাট্যকারও। অনেক নাটক লিখেছেন। এর মধ্যে 'প্রেরণা', 'শঙ্খবাস', 'শুধু তোমারেই জানি', 'শুকতারা', 'ঘাসফুল' অন্যতম। উপস্থাপক হিসেবেও সুপরিচিতি আছে বিপাশার। 'বিপাশার অতিথি' নামক একটা অনুষ্ঠান বেশ জনপ্রিয় হয়েছিল। কবিতা আবৃত্তি ও গানেও বেশ ভালো দখল রয়েছে তার। তার অন্য আরেকটি প্রতিভা হলো তিনি একজন চিত্রশিল্পী। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চারুকলায় স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। বছর কয়েক আগে এসিড আক্রান্ত নারীদের সাহায্যার্তে নিজের আঁকা ছবির প্রদর্শনী করেছিলেন। এ ছাড়া ধানমন্ডির গ্যালারি চিত্রে প্রদর্শিত হওয়া বিভিন্ন মাধ্যমে আঁকা তিন শতাধিক শিল্পকর্মে সাজানো তার এই 'প্রস্তর কাল' টাইটেলের চিত্রকলা দেখে দর্শনার্থীদের সবাই মুগ্ধ হয়েছেন। ২০১৯ সাল থেকে ২০২২ সালের মাঝামাঝি পর্যন্ত আঁকা তার এই শিল্পকর্মতেই বোঝা গেছে এক সময়ের সাড়া জাগানো এই অভিনেত্রী সুদূর আমেরিকায় থাকলেও বসে নেই। নিজে যে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটা অর্জন করেছেন সেটা নিয়ে এখন বাস্তব জীবনেও সফল হতে চাইছেন। বাংলাদেশ থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেওয়ার পর থেকে যে চিত্রকলার সম্ভার সাজিয়েছেন তিনি তাতেও বোঝা যায় এতদিন অভিনয়ে থাকলেও তার মনের কোণ থেকে চিত্রকলা মুছে যায়নি। কারণ এটা তিনিও ভালো করেই জানেন এখানেই রয়েছে তার সম্পূর্ণ এককভাবে নিজস্বতা প্রকাশের সব সুযোগ। শুধু অভিনয়ের তুমুল ব্যস্ততায় থাকার কারণেই এসব হয়ে ওঠেনি তার। চিত্রকলা নিয়ে তার ভাবনাও অত্যন্ত সুগভীর, যা প্রতিটি সফল চিত্রকলাতেই ধরা দেয়। বর্ণিল ক্যারিয়ারে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছাড়াও পেয়েছেন মেরিল প্রথম আলো পুরস্কার, বাচসাস পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার। সাংস্কৃতিক জীবনের মতো ব্যক্তিগত জীবনটাও মসৃণ ও পরিষ্কার বিপাশার। বোন নাতাশা হায়াত ও তার স্বামী শাহেদ শরীফ খানও পরিচিত অভিনয় শিল্পী। ফুফাতো বোন ফিমা আহমেদও নাটক ও বিজ্ঞাপনে কাজ করেছেন। ব্যক্তিজীবনে নিজের ক্যারিয়ারের সেরা জুটি অভিনেতা ও নির্মাতা তৌকীর আহমেদকে বিয়ে করেছেন বিপাশা। সংসারে রয়েছে দু'টি সন্তান :এক ছেলে ও এক মেয়ে। বিনোদন জগতে সুখী দম্পতি হিসেবে সুপরিচিতি আছে তাদের।