প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ সম্মাননা 'সিতারা-ই-ইমতিয়াজ'-এ ভূষিত হচ্ছেন উপমহাদেশের কিংবদন্তি অভিনেত্রী শবনম। আগামী ২৩ মার্চ দেশটির ইসলামাবাদে দেওয়া হবে এই পদক। পদক গ্রহণে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতির প্রয়োজন ছিল। সরকারপ্রধান ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি লাভের পর গতকাল পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেছেন শবনম।
১৯৪৬ সালের ১৭ আগস্ট ব্রিটিশ-ভারতের ঢাকায় জন্মগ্রহণকারী শবনম ছিলেন ঢাকাই বাংলা সিনেমার হার্টথ্রব নায়িকা এবং পরবর্তী সময়ে হন পাকিস্তানি সিনেমার পোস্টার গার্ল। স্পোটর্সজগতে বিখ্যাত ননী বসাকের দ্বিতীয় কন্যা জন্মেছিলেন ঝর্না বসাক নাম নিয়ে কিন্তু এহতেশামের বদলৌতে পরিচিতি পান 'শবনম' নামে। পরিচালক এহতেশামের হাত ধরে অভিনয়ে হাতেখড়ি শবনম চান্দা, তালাশ, হারানো দিন, নাচের পুতুল সিনেমা দিয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া শবনম তখন পাকিস্তানেও তুমুল দর্শকপ্রিয়তা পান। পরবর্তী সময়ে নিজেকে আরো মেলে ধরতে পাড়ি জমান তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানে মাথা উঁচু করে নিজেকে মেলে ধরেন। পরে জন্মভূমিতে ফিরে সর্বশেষ 'আম্মাজান' সিনেমা দিয়ে ক্যারিয়ারে ইতি টানেন। অর্থাৎ ১৯৫৮ সালে শবনম তার বাংলা ভাষায় শুরু করা ক্যারিয়ার বাংলা ভাষায়ই শেষ করেন ১৯৯৯ সালে 'আম্মাজান' দিয়ে। এ ছবিটির আগে শবনম বাংলাদেশে যে সিনেমাটিতে অভিনয় করেছিলেন সেটা ছিল অশোক ঘোষ পরিচালিত 'নাচের পুতুল'। ১৯৭১ সালে এ ছবিটি মুক্তি পেয়েছিল। যখন দেশে চলছিল রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা যুদ্ধ। অশোক ঘোষ পরিচালিত সেই 'নাচের পুতুল' চলচ্চিত্রে নায়ক রাজ রাজ্জাকের ঠোঁটে মাহমুদুন্নবীর গাওয়া 'আয়নাতে ঐ মুখ দেখবে যখন' কথার সেই অবিস্মরণীয় গানটির কথা নিশ্চয়ই কারো ভুলে যাওয়ার কথা নয়। এই একটি গানের জন্যই এই কালজয়ী সিনেমাটি অনেকে একাধিকবার দেখেছেন। সিনেমাটির এই গানটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল যে, এই সিনেমাটির রিলিজের ২৫/৩০ বছর পরেও পুরনো সিনেমা হিসেবে বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে দেখা গেছে। শিল্পী মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠের এই গানটি আজও দারুণ জনপ্রিয়। সেই কালজয়ী সিনেমাটিই ছিল শবনমের গস্নামারাস বয়সকালীন সর্বশেষ ঢাকাই সিনেমা। ষাটের দশকের বাংলা চলচ্চিত্রের জনপ্রিয় চিত্রনায়িকা শবনম। মুস্তাফিজ পরিচালিত 'হারানো দিন' সিনেমায় অভিনয়ের মাধ্যমে ১৯৬১ সালে নায়িকা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন শবনম। এ সিনেমাতেই তিনি ঝর্ণা বসাক থেকে 'শবনম' নাম ধারণ করেন। এ নামের অর্থ দাঁড়ায় ভোরের শিশির। নামেই মিশে আছে যেন কেমন ঘোর লাগা নেশা। তাই গানটির সঙ্গে তার অনুভূতি প্রকাশের অনবদ্য ভঙ্গী দর্শককে এতটাই ভালো লাগায় যে তখন দর্শক যেন মনে-মনে শয়নে-স্বপনের তাকেই কল্পনা করতেন। তখন ঢাকাই সিনেমায় রহমান-শবনম ও রাজ্জাক-শবনম জুটি দারুণ জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল- এই দশ বছর ছিল তার ঢাকাই সিনেমার ক্যারিয়ার। কারণ, অভিনেত্রী শবনম ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে তার ক্যারিয়ার শুরু করলেও '৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই লাহোরে চলে যান এবং সেখানেই স্থায়ী হন। বলা চলে, শবনমের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বর্ণালী সময়টাই গেছে লাহোরে। সেই অর্থে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি তার কাছ থেকে খুব বেশি কিছু পায়নি। আবার যা পেয়েছে কাজের গুণগত মানের বিচারে তাও কম নয়। আসলে এ অভিনেত্রী ছিলেন দেশপ্রেমের চাইতেও আরও বেশি পেশাদার অভিনেত্রী। অর্থাৎ পুরোপুরি পেশাদার অভিনেত্রী।
আর তার মাছে এই পেশাদারিত্ব ছিল বলেই শুধু মাঝে ৩০ বছরের অধিক সময় কাজের সুবাদে পাকিস্তানের উর্দুু ছবিতে শীর্ষ অভিনেত্রী হিসেবে কাজ করেন। অর্থ-যশ-সুনাম করতলগত করে ফিরে আসেন মাতৃভূমিক বাংলায়। তবে ফিরে এলেও পাকিস্তানে তিনি চলচ্চিত্রের রানী হিসেবেই পরিচিত। সুযোগ পেলেই দেশটি শবনমকে কিছু না কিছু ফিরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। তারই অংশ হিসেবে দেশটির তৃতীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার সিতারা-ই-ইমতিয়াজ পদকে ভূষিত হন শবনম।
এ প্রসঙ্গে শবনম বলেন, ক্যারিয়ারে লম্বা সময় পাকিস্তানে কাজ করেছি। স্বামী-স্ত্রী দুজনেই মাথা উঁচু করে কাজ করেছি। যে কারণে ওরা সর্বোচ্চ পদক দিচ্ছে। আমি গর্বিত। আর পদক গ্রহণে অনুমতি দিয়েছেন বর্তমান সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। আমি তার প্রতি কৃতজ্ঞ। আমি ধন্যবাদ জানাতে চাই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ ও মন্ত্রণালয়সংশ্লিষ্টদের। তাদের আন্তরিক সহযোগিতা না পেলে জীবন সায়েহ্নে এসে এই পদক গ্রহণে যেতে পারতাম না। একই সঙ্গে পাকিস্তান সরকারকেও ধন্যবাদ।
ছয় দশকের বর্ণাঢ্য চলচ্চিত্র জীবনে শবনম পাকিস্তানে সর্বোচ্চ তিনবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার এবং ১৩ বার সর্বোচ্চ নিগার জয় করে অনন্য রেকর্ড গড়েছেন। এছাড়া তিনটি জাতীয়, পিটিভি এবং লাক্স লাইফটাইম অ্যাওয়ার্ড লাভ করেন। এছাড়া ২০১৭ সালে লাহোর সাহিত্য উৎসবে প্রধান অতিথির আসন অলংকৃত করার বিরল গৌরব অর্জন করেন শবনম। পাকিস্তানের সিনেমায় তার অবদান এতটাই যে, সেখানে 'মহানায়িকা' বলা হয় শবনমকে।
গত ১৪ আগস্ট দেশটির স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে এই পদকে শবনমের নাম ঘোষণা করেন। খবর পাকিস্তান ভিত্তিক দি ট্রাইবু্যনাল। এছাড়া এ দি লিজেন্ড অব মাওলা জাট পরিচালক বিলাল লাসারী এবং এভারেডি পিকচার্সের কর্ণধার সতীশ আনন্দ এ পুরস্কারটি পাচ্ছেন। সেই ঘোষিত পুরস্কারটিই আগামী ২৩ মার্চ পাকিস্তান দিবসে তাদের হাতে তুলে দেওয়া হবে।
শৈশবেই বুলবুল ললিতকলা একাডেমিতে নাচ শেখেন শবনম। একজন নৃত্যশিল্পী হিসেবে তিনি সুপরিচিতি লাভ করেন। সেখানেই একটি নৃত্যের অনুষ্ঠানে নির্মাতা এহতেশাম তার নাচ দেখে 'এদেশ তোমার আমার' চলচ্চিত্রের নৃত্যে অভিনয়ের সুযোগ করে দেন।
এহতেশামের আরও কিছু সিনেমায় অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেন শবনম। কিন্তু এহতেশামের পাশাপাশি পরিচালক মুস্তাফিজের নজর কাড়তে সক্ষম হন অতিরিক্ত শিল্পী হিসেবে অভিনয় করেই।