স্বমহিমায় ফেরদৌসী রহমান
প্রকাশ | ১৯ মার্চ ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
ঢাকাই সিনেমার পেস্ন-ব্যাকে কাদের গান সবচেয়ে বেশি মুগ্ধতা ছড়িয়েছে- এমন প্রশ্ন করা হলে অবলীলায় যাদের নাম সবার আগে আসবে তাদের শীর্ষে থাকবেন এ দেশের সঙ্গীতের জীবন্ত কিংবদন্তি চিরসবুজ গানের পাখি ফেরদৌসী রহমান। তার এমন অনেক গান আছে যেগুলোর সুর ও কণ্ঠ চিরকালের শ্রোতাদের কানকে এতটাই আরাম দেবে যে সে গান তার বারবারই শুনতে ইচ্ছা করবে। এতটাই হৃদয় আচ্ছন্নকর কণ্ঠ তার। 'যে জন প্রেমের ভাব জানে না', 'যার ছায়া পড়েছে মনের আয়নাতে', 'এই যে নিঝুম রাত ঐ যে মায়াবী চাঁদ', 'এই রাত বলে ওগো তুমি আমার, 'প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে', 'মনে যে লাগে এতো রঙ ও রঙিলা', 'ঝরা বকুলের সাথী আমি সাথী হারা', 'নিশি জাগা চাঁদ হাসে কাঁদে আমার মন', 'আমার প্রাণের ব্যথা কে বুঝবে সই', 'আমি রূপনগরের রাজকন্যা রূপের যাদু এনেছি' 'পদ্মার ঢেউরে', 'ও কি গাড়িয়াল ভাই'সহ আরও অনেক জনপ্রিয় গান উপহার দিয়েছেন ফেরদৌসী রহমান। ৬০ ও ৭০-এর দশকের ঢাকাই বাংলা চলচ্চিত্রের বহু পেস্ন-ব্যাকে নেপথ্য কণ্ঠশিল্পী হিসেবে যুক্ত ছিলেন তিনি। প্রজন্মের পর প্রজন্মের সঙ্গীত শিক্ষক হিসেবেও সবার কাছে যিনি এক মুগ্ধতার নাম। কণ্ঠে, চেহারায়, গালভরা হাসিতে আগে যেমনটি ছিলেন এখনো ঠিক তেমনটিই অমলিন রয়েছেন।
বাংলাদেশের গান যতকাল থাকবে, ততকালই পরম শ্রদ্ধার সঙ্গে যে শিল্পীর নাম থাকবে- তিনি ফেরদৌসী রহমান। যিনি আবার আরেক কিংবদন্তি ও প্রখ্যাত পলস্নীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দীনের সুযোগ্য কন্যা। যাদের দু'জনই বাংলা গানকে নিয়ে গেছেন অনন্য এক উচ্চতায়। যে আব্বাসউদ্দীনের কণ্ঠে রেকর্ড করা গান 'প্রাণ সখিরে ঐ শোন কদম্বতলে বংশী বাজায় কে'- শুনলে যে কারও মনই সেই হারানো অতীতে ফিরে যেতে চাইবে। যেমন বাবা তেমন কন্যা হিসেবে ফেরদৌসী রহমানের কণ্ঠও তাই। তার হাত ধরেই বাংলাদেশ টেলিভিশনে যাত্রা শুরু হয় গান শেখানোর অনুষ্ঠান 'এসো গান শিখি'। যা এখনো মাসে চারবার এই অনুষ্ঠান বিটিভিতে প্রচার হয়। এখনো তিনি এই অনুষ্ঠানের রেকর্ডিং-এ অংশ নিয়ে থাকেন আগের সেই উদ্দীপনার সঙ্গেই। সময়ের ছাপটুকু ছাড়া দেখতে প্রায় সেই অবিকল ফেরদৌসী রহমান জীবন চলার পথ পরিক্রমায় ইতোমধ্যেই ৮৩ বছর উত্তীর্ণ হয়ে এলেন।
ব্রিটিশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহারে ১৯৪১ সালের ২৮ জুন জন্মগ্রহণকারী বাংলা সঙ্গীতের অনন্য প্রতিভা ফেরদৌসী রহমান বলেন- 'দেখতে দেখতে জীবনের এতটা বছর পেরিয়ে এলাম। এখন এই বয়সে খুউব বেশি প্রয়োজন না হলে, জরুরি কাজ না থাকলে ঘরের বাইরে বের হই না। ঘরে বসে যাদের গান ভালো লাগে মাঝে মাঝে তাদের গান শুনি। যেমন শাহনাজ রহমতুলস্নাহ, রুনা লায়লা, সাবিনা ইয়াসমিন, কনকচাঁপা, শাকিলা জাফর, আলম আরা মিনু-এদের সবার কণ্ঠে আমার গান শুনতে ভালো লাগে। শাহনাজ, রুনা, সাবিনার তো এমন কিছু গান আছে- যেগুলোর জন্য শ্রোতা মনে রাখবে তাদের আজীবন। পরবর্তী সময়ে বাপ্পা মজুমদার, ন্যান্সি, লিজাও ভালো করছে। তারপরও সবশেষে একটা কিন্তু থেকে যায়। এখন যারা গান করছে তারা গানের গ্রামারটা ভালো করে জেনেবুঝে গানের চর্চাটা করছে না। গান আসলে সাধনার বিষয়। এর বিকল্প বা শর্টকাট কোনো রাস্তা নেই। যে কারণে আমি এখনো বিটিভির 'এসো গান শিখি' অনুষ্ঠানটা করি। যাতে জীবনের শেষ সময় পর্যন্ত আমি গানে আমার জ্ঞান টুকু দিয়ে যেতে পারি। যাইহোক আমি সবার দোয়া প্রার্থী।'
একজন ফেরদৌসী রহমান, বাংলাদেশের সঙ্গীতাঙ্গনের উজ্জ্বল তারা। বাংলা গানের সব ঘরনাতেই তার সাবলীল বিচরণ দর্শক-শ্রোতাকে মুগ্ধ করে। একাধারে পলস্নীগীতি, রবীন্দ্রসঙ্গীত, নজরুলসঙ্গীত, ইসলামিক গান, গজল, আধুনিক ও পেস্নব্যাকের শিল্পী। চলচ্চিত্রসহ সব ঘরানার গানই প্রস্ফুটিত হয়েছে এই গুণী শিল্পীর কণ্ঠে। সঙ্গীত জীবনের সাফল্যের ধারাবাহিকতা সেই যে ছোট্টবেলায় শুরু হয়েছিল তা এখনো বহমান, অম্স্নান ও অটুট হয়ে আছে। আবার ইসলামিক গানের কথা এলে দেখা যায়, রমজান মাসে তার কণ্ঠে হামদ ও নাতের দরদ মাখানো সুর শ্রোতার কণ্ঠকে যতটা আবিষ্ট করে রাখে সেটা খুব কম কণ্ঠশিল্পীর গলাতেই পাওয়া যায়।
কিংবদন্তি এ শিল্পীর গানের হাতেখড়ি হয়েছে প্রথমে তার পিতা পলস্নীগীতি সম্রাট আব্বাস উদ্দিনের কাছে। এরপর বাবা ছাড়াও ওস্তাদ মোহাম্মদ হোসেন খসরু, ইউসুফ খান কোরেইশী, কাদের জামেরী, গুল মোহাম্মদ খানসহ বেশ কয়েকজন নামজাদা সঙ্গীতজ্ঞের কাছে তালিম নিয়েছেন।
গানে গানে সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মাননা একুশে পদক, জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের আজীবন সম্মাননা, সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার'সহ দেশ-বিদেশের নানা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন দেশের সঙ্গীতাঙ্গনের এই কিংবদন্তি ব্যক্তিত্ব।
জীবনের প্রথম মাত্র ৮ বছর বয়সে ফেরদৌসী রহমান রেডিও'র 'খেলাঘর' অনুষ্ঠানে গান করেন ১৯৪৮ সালে। ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গান করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি প্রথম গান রেকর্ড করেন এইচ এম ভি থেকে। ১৯৬০ সালে 'আসিয়া' সিনেমাতে তারই বাবা পলস্নীগীতি সম্রাট আব্বাসউদ্দিনের সুরে আব্দুল করিমের লেখা 'ও মোর কালারে' গানটি গান। অবশ্য তার আগেই 'এদেশ তোমার আমার' সিনেমা মুক্তির মধ্যদিয়ে একজন পেস্ন-ব্যাক শিল্পী হিসেবে তার অভিষেক হয়। বাল্যে শিক্ষাজীবন কেটেছে পুরান ঢাকা বাংলাবাজার স্কুলে। এখান থেকেই এসএসসি এরপর ইডেন কলেজ থেকে এইচএসসি উত্তীর্ণ হন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগ থেকে অনার্স, মাস্টার্স এবং পরবর্তী সময়ে ইউনেস্কো ফেলোশিপ নিয়ে লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজ অব মিউজিক থেকে স্টাফ নোটেসন কোর্স সম্পন্ন করেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশেনর 'এসো গান শিখি' অনুষ্ঠানের মাধ্যমে খালামনি হিসেবেও দারুণ জনপ্রিয় তিনি। ফেরদৌসী রহমান উপমহাদেশের প্রখ্যাত সুরকার প্রয়াত রবিন ঘোষের সঙ্গে যৌথভাবে 'রাজধানীর বুকে' সিনেমার সঙ্গীত পরিচালনার কাজ করেন প্রথম। এরপর তিনি হারুনর রশীদ পরিচালিত 'মেঘের অনেক রং' সিনেমার সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। প্রায় ২৬০টি সিনেমাতে গান গেয়েছেন তিনি। 'এসো আমার দরদী' শিরোনামের একটি গানের সিডিও প্রকাশিত হয়েছে এই সঙ্গীতশিল্পীর। তিনটি লং পেস্ন, ৫০০টি ডিস্ক রেকর্ড, প্রায় ২০টি ক্যাসেট'সহ পাঁচ হাজারেরও বেশি গান রেকর্ড করা হয়েছে তার।
ফেরদৌসী রহমান নজরুল ইনস্টিটিউটের ট্রাস্টি বোর্ডেরও সদস্য ছিলেন। দেশের সঙ্গীত ভুবনে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখার জন্য তিনি জাতীয় পর্যায়ে নানাভাবে সম্মানিত হয়েছেন। তার অর্জিত উলেস্নখযোগ্য পুরস্কারের মধ্যে আছে লাহোর চলচ্চিত্র সাংবাদিক পুরস্কার (১৯৬৩ সাল), প্রেসিডেন্ট প্রাইড অব পারফরম্যান্স পুরস্কার (১৯৬৫ সাল), টেলিভিশন পুরস্কার (১৯৭৫), জাতীয় পুরস্কার শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত পরিচালক (১৯৭৭), বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (১৯৭৬), একুশে পদক (১৯৭৭ সাল)। এছাড়াও তিনি নাসিরউদ্দিন গোল্ড মেডেল পুরস্কার, মাহবুবুলস্নাহ গোল্ড মেডেল, প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান পুরস্কার।
১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার রেজাউর রহমানের সঙ্গে ফেরদৌসী রহমানের বিয়ে হয়। তাদের রুবাইয়াত ও রাজিন নামে দুই ছেলে আছে।