ঢাকাই চলচ্চিত্রের মা চরিত্রের নন্দিত অভিনেত্রী খালেদা আকতার কল্পনা। সম্মানজকক পেশা শিক্ষকতা ছেড়ে নতুন মুখের সন্ধানের মাধ্যমে চলচ্চিত্রে অভিনয়ের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত করেছিলেন তিনি। পাঁচ শতাধিক চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন। তার এই বর্ণিল ক্যারিয়ারে শতাধিক নাটকেও অভিনয় করেছেন। নায়করাজ রাজ্জাকের পরিচালনায় নির্মিত 'জিনের বাদশা' ছবিতে অভিনয় করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে ভূষিত হয়েছিলেন।
খালেদা আকতার কল্পনার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করা আরও উলেস্নখযোগ্য যেসব সিনেমা রয়েছে- তার মধ্যে- 'তিন কন্যা', 'আনন্দ অশ্রম্ন', 'কেয়ামত থেকে কেয়ামত', 'আমার প্রাণের প্রিয়া', '৭১-এর গেরিলা', 'পদ্মা মেঘনা যমুনা' প্রভৃতি।
তবে এই সিনেমাগুলো ছিল সেই সময়ের যখন ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে চলচ্চিত্রের একটা উর্বর সময় ছিল। এখন একদিনে খালেদা আক্তার কল্পনার বয়সও যেমন বেড়েছে আবার চলচ্চিত্রও কমে গেছে। ফলে সিনেমা বা নাটকে বর্ষীয়ান এ অভিনেত্রীর বলতে তেমন কোনো কাজ নেই। অথচ একটা সময় এই অভিনেত্রী মাসের প্রায় ৩০ দিনই ব্যস্ত থাকতেন। একের পর এক সিনেমা ও নাটকে অভিনয় করেছেন। শুটিং করতে করতে অনেক সময় ক্লান্তও হয়ে যেতেন। নায়ক মান্না, রুবেল, শাকিব খান, শাকিল খান, রিয়াজদের মায়ের চরিত্র অনবদ্য অভিনয় করে গেছেন এ অভিনেত্রী। চরিত্রাভিনেত্রী হিসেবে পেয়েছেন তারকা খ্যাতি। পর্দায় মা চরিত্রে অভিনয় করতে গিয়ে এক সময় দর্শকদেরও মা হয়ে ওঠেন।
কিন্তু সেই সময়টা ছিল তখনকার যখন এক এফডিসি চত্বর বা ফ্লোরেই ব্যস্ত থাকত কয়েকটি সিনেমার শুটিং নিয়ে। একজন অভিনয় শিল্পী একই জায়গায় অভিনয় করতেন একাধিক সিনেমায়। মিনিট খানেকের দূরত্বেই এক শুটিং স্পট থেকে আরেক শুটিং স্পটে গিয়ে মেকাপ নিতেন নতুন চরিত্রে নতুন করে। সেই সময়টা তো কবেই অতীত হয়ে গেছে।
চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থায় সেই মা, ভাবী চরিত্রে অভিনয় করা খালেদা আকতার কল্পনার দিনগুলো এখন কীভাবে কোথায় কাটে এটা জানার জন্য তার সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়- যথারীতি তিনি ফোনটা রিসিভও করেন এবং প্রথমেই জানান পারিবারিক কাজে খুব ব্যস্ত আছি। রোজার মাসে বাসা পাল্টিয়েছি আগে তো বুঝিনি বাসা পাল্টানো যে কতটা ঝামেলার কাজ। সবকিছুই অগোছাল হয়ে পড়ে আছে। শারীরিক অবস্থার কথা জানতে চাইলে, এ অভিনেত্রী বলেন, আলহামদুলিলস্নাহ ভালো। আমি অনেকটাই সুস্থ আছি। সবার দোয়া ও ভালোবাসায় শারীরিক অবস্থা মোটামুটি ভালোই যাচ্ছে। ঠিকমতো চলাফেরা করতে পারছি। সংসারের কাজ করছি।
নতুন কাজের ব্যাপারে জানতে চাইলে, অভিনেত্রী বলেন নতুন একটি টেলিফিল্মের কাজ শেষ করলাম। ফারহানা প্রোডাকশন থেকে নির্মিত ভালো একটি গল্পের কাজ করলাম। ঈদের জন্য আরও কয়েকটি নাটকের কাজ হাতে আছে। রোজার কারণে সব কাজ করতে পারি না। যে গল্পগুলো ভালো তার কয়েকটা কাজ করছি। কারণ বয়স তো আর কম হয়নি। আগের মতো সারাদিন-রাত শুটিং করতে পারি না।
নতুন সিনেমার কাজের প্রস্তাব কি আসে? নতুন কাজের প্রস্তাব তো মাঝেমধ্যে আসেই। তবে সিনেমার কাজ তেমন একটা করা হয় না। দুই-একটা কাজ করেছি কিন্তু সেগুলোর কোনো খবর নাই। কবে মুক্তি পাবে তাও জানি না। সম্প্রতি একটি সিনেমার প্রস্তাব পেয়েছিলাম। সামনের মাসে শুটিং হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু ফিরিয়ে দিয়েছি। ইচ্ছে করেই লোডটা নেইনি। টাকা-পয়সার ব্যাপারেও ঝামেলা ছিল একটু। এই বয়সে কোনো অনিশ্চয়তা নিয়ে কষ্ট করতে চাইছি না। ইদানীং অনেক কাজ শুরু হয় কিন্তু শেষ হয় না। আবার শেষ হলেও দেখা যায় কিছু অংশ বাকি থাকে। আর কিছু কিছু কাজ করার পর তাদের কত সমস্যা থাকে শিডিউল, টাকা-পয়সা ইত্যাদি। এসব কারণে আর মন চায় না সিনেমায় কাজ করতে। তবে ভালো গল্প, ভালো প্রোডাকশনের কাজ হলে অবশ্যই করব। আমি সিনেমার মানুষ। আমার রক্তের সঙ্গে সিনেমা মিশে গেছে। এতো আমি বাদ দিতে পারব না।
একটা সময় চট্টগ্রাম বেতারে অনুষ্ঠান ঘোষিকা হিসেবেও কাজ করেছেন খালেদা আক্তার কল্পনা। তবে হঠাৎ তার বিয়ে হয়ে যাওয়ায় রেডিওতে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। বিয়ের পর শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন। এরপর এফডিসি থেকে 'নতুন মুখের সন্ধানে' ঘোষণা করা হলো। একজন খুব উৎসাহ দেন সাড়ে চার হাজার ছেলেমেয়ের মধ্যে তিনি টিকবেন। বিশ্বাস না করলেও নির্দিষ্ট তারিখের পর তাকে যোগাযোগ করিয়ে অডিশনে পাঠানো হয়।
অডিশনে গিয়ে ছোট্ট একটা মিথ্যা বলেন। ইন্টারভিউ কার্ড লেটে আসছে বলে দেন। অডিশন নেওয়া হলো এবং তিনি প্রশংসিত হন। তখন অডিশনে বিচারকরা বলেন, 'অভিনেত্রী আনোয়ারা আপা একা ইন্ডাস্ট্রি চালাতে পারছেন না। আমরা নায়ক-নায়িকা বেশ পেয়েছি কিন্তু ক্যারেক্টার আর্টিস্টের ভীষণ অভাব। আপনাকে আমরা পেয়েছি। ইন্ডাস্ট্রি আরেকজন মা পেল।' সুযোগ এলো নিজেকে বিনোদনের সবচেয়ে বড় মাধ্যম চলচ্চিত্রে প্রমাণ করার। সেই থেকে শুরু তার চলচ্চিত্রে অভিনয়ের পথচলা। এখনো অব্দি অভিনয়ের সঙ্গে যুক্ত আছেন। জীবনের শেষদিন পর্যন্ত অভিনয় করে যেতে চান। মানুষের মনের মধ্যে বহু বছর বেঁচে থাকতে চান।
লেখালেখির অভ্যাস তো সেই ছোটবেলা থেকেই রয়েছে। অভিনয়ের পাশাপাশি তিনি ভালো লেখেন। অনেক ধারাবাহিক নাটক, খন্ডনাটক এবং টেলিফিল্মের গল্প রচনা করেছেন। এ অভিনেত্রী প্রথম যে নাটকটি রচনা করেছিলেন সেটি প্রচার হয়নি। তবে পরে এটিএন বাংলায় প্রচার হয় তার রচিত ও মনোয়ার খোকন পরিচালিত ধারাবাহিক নাটক 'আপনার চেয়ে আপন' নাটকটি। অবশ্য তার আগে তার রচনায় মনোয়ার খোকন নির্মাণ করেন রবি চৌধুরীকে নায়ক হিসেবে নিয়ে 'ফেরারী সুখ' নামে একটি নাটক। এরপর আরও বহু নাটক রচনা করেছেন খালেদা আকতার কল্পনা। সিনেমা-নাটকে অভিনয় করতে অনেক ভুলত্রম্নটি চোখে পড়া থেকেই লেখালেখির কাজ শুরু করেন। আর ছোটবেলা থেকেই নিজের মনে বীজ বপন করাই ছিল লেখালেখির ব্যাপারে।