ষাট দশকের শুরু থেকেই সিনেমাকে একমাত্র বিনোদনের উপরকরণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। আর এই সিনেমার ৯৯ শতাংশই পুরুষপ্রধান বা নায়কপ্রধান সিনেমা। ঢাকাই সিনেমায় তো বটেই বিশ্ব সিনেমাতেও নারীপ্রধান সিনেমা একেবারেই হাতেগোনা। আবার যেসব নারীপ্রধান সিনেমা হয়েছে সেখানেও বিনোদনটাকেই প্রধান হিসেবে আনা হয়েছে। নারীর একান্ত বাস্তবচিত্র খুব কমই প্রতিফলিত হয়েছে সেসব নারীপ্রধান সিনেমায়। তারপরেও এমন নারীপ্রধান সিনেমাও খুব বেশি হয়নি।
অথচ ঢাকাই সিনেমার বয়স বর্তমানে যেখানে এসে পৌঁছেছে সেটাও কম নয়। প্রথম সিনেমা 'মুখ ও মুখোশ' মুক্তির পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭০ বছর চলছে ঢাকাই সিনেমার বয়স। স্বাধীনতার আগে যদিও ঢাকাই বাংলা সিনেমাকে উর্দু সিনেমার সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে হতো কিন্তু স্বাধীনতার পর একেবারেই একচেটিয়া হয়ে পড়ে ঢাকাই বাংলা সিনেমা। কিন্তু এসব সিনেমায় বাংলার 'নারী সমাজ' নিয়ে তার বাস্তবচিত্র বলার মতো কতটা প্রতিফলিত হয়েছে?
যারা নায়িকা হিসেবে অভিনয় করেন তাদের অনেকেই এ নিয়ে আক্ষেপ করেন যে তারা নারীপ্রধান গল্পের সিনেমায় অভিনয় করতে পারছেন না। যে কারণে তারা তাদের অভিনয়কে প্রমাণ করার সুযোগও পাচ্ছেন কম। পুরো সিনেমাটির গল্পজুড়েই থাকে শুধু নায়ক আর খল অভিনেতা। অর্থাৎ গোটা ঢাকাই সিনেমা রয়ে গেছে নায়ক, খল অভিনেতা বা পুরুষের নিয়ন্ত্রণে। ঢাকাই সিনেমার এমন বাস্তবতায় তখন নারীপ্রধান সিনেমা কী করে হবে? নারীর জীবন যে কীরকম সংগ্রামময় এটা দেশের তেমন কোনো সিনেমায় প্রতিফলিত না হলেও কোনো কোনো চলচ্চিত্র পরিচালকের সিনেমায় নারীর সংগ্রামময় জীবন প্রতিফলিত হয়েছে। যেমন, ধরা যাক মসিহউদ্দিন শাকের এবং শেখ নিয়ামত আলী পরিচালিত 'সূর্য দীঘল বাড়ী' সিনেমাটি। বরেণ্য উপন্যাসিক আবু ইসহাক রচিত 'সূর্য দীঘল বাড়ী' অবলম্বনে তৈরি এ সিনেমাটি সরকারি অনুদানের প্রথম সিনেমা। আর সরকারি অনুদানের হিসেবে এই সিনেমাটি ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে এ কারণে যে, সরকারি অনুদানের এই সিনেমাটিই প্রথম নারীপ্রধান হিসেবে নারীর বাস্তবচিত্রকে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।
বাংলা ১৩৫০ সনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে অবিভক্ত ভারতের বাংলায় ব্যবসায়ীদের কারসাজিতে 'পঞ্চাশের আকাল' নামে যে দুর্ভিক্ষ হয়েছিল তাতে লাখ লাখ দরিদ্র মানুষ প্রাণ হারায়। যারা কোনমতে শহরের লঙ্গরখানায় পাত পেতে বাঁচতে পেরেছিল তাদেরই একজন একালের সময় স্বামী পরিত্যক্ত জয়গুন। সঙ্গে তার মৃত প্রথম স্বামীর ঘরের ছেলে ও দ্বিতীয় স্বামীর ঘরের মেয়ে। আরও আছে মৃত ভাইয়ের স্ত্রী-পুত্র। তারা গ্রামে ফিরে এসে এমন এক খন্ড জমিতে ঘর তৈরি করে যেটি অপয়া ভিটে বলে পরিচিতি ছিল। জীবনযুদ্ধে যখন সে প্রাণপণ লড়ছে তখন তার প্রতি গায়ের মোড়লের দৃষ্টি পড়ে। দ্বিতীয় স্বামীও তাকে আবার ঘরে তুলতে চায়। সে কারো প্রস্তাবেই সায় দেয় না। কিন্তু এ দু'জনের সাক্ষাৎ ঘটে এবং মোড়ল তার প্রতিযোগীকে হত্যা করে। ঘটনার একমাত্র দর্শক হিসেবে জয়গুনকেও মূল্য দিতে হয় অন্যভাবে। চলচ্চিত্রটিতে একজন নারী তার চারপাশের বৈরী পরিবেশের সঙ্গে লড়াই করতে গিয়ে কী করে প্রতি পদে পদে হোঁচট খেতে হচ্ছে তারই বাস্তবচিত্র ফুটে ওঠে এই নারীপ্রধান সিনেমাটিতে। তবে যেহেতু এই সিনেমাতে প্রচলিত বিনোদনকে উপেক্ষা করা হয়েছে সে কারণে নিটোল বিনোদনপ্রিয় দর্শকও এ সিনেমাকে উপেক্ষ করে।
আবার এমন সিনেমাও আছে যে সিনেমা নারীপ্রধান হলেও বাস্তবতা বর্জিত বিনোদনমূলক আখ্যাননির্ভর। বাঙালি দর্শক অবশ্য এমন বিনোদনমূলক নারীপ্রধান সিনেমা দেখতে চায়। যেমন, ঢাকায় নির্মিত প্রথম নারীকেন্দ্রিক সিনেমা 'রূপবান'। সালাউদ্দিন নির্মিত এই ছবির নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন সুজাতা। নারীর ত্যাগ-তিতীক্ষা মূর্ত হয়ে ধরা দিয়েছে এই সিনেমাটিতে। লোককাহিনি নির্ভর ছবিটিতে অভিনয়ে আরও যারা ছিলেন তারা হলেন- আনোয়ার হোসেন, ইনাম আহমেদ, মনসুর, চন্দনা, সিরাজুল ইসলাম প্রমুখ। ১৯৬৫ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি ওই সময়ে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। সত্য সাহার সঙ্গীত পরিচালনায় করা এই ছবির গানগুলো দীর্ঘদিন দেশের মানুষের মুখে মুখে ছিল।
শহিদুলস্নাহ কায়সার রচিত 'সারেং বৌ' সিনেমাটি যেমন দর্শকপ্রিয়তা পেয়েছিল তেমন তার গানও মানুষের অন্তর ছুঁয়ে গিয়েছিল। সিনেমাটির বিখ্যাত গান- 'ওরে নীল দরিয়া, আমায় দে রে দে ছাড়িয়া'-গানটি শোনেনি, এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না দেশে। ছবিটির প্রধান চরিত্র সারেংয়ের বৌ হিসেবে এই নারী চরিত্রটির জন্যই এমন একটি অবিস্মরণীয় গানের সৃষ্টি হয়েছিল। ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি পরিচালনা করেছিলেন আবদুলস্নাহ আল মামুন। এতে জুটি বেঁধে অভিনয় করেন ফারুক ও কবরী। ছবিতে 'নবিতন' নামের এক গৃহবধূর ভূমিকায় দেখা যায় কবরীকে; যে তার স্বামী, সংসার ও নিজের প্রতি সৎ ও নিষ্ঠাবান থাকার জন্য নানা প্রতিকূলতাকে জয় করে নেয় তার জীবনযুদ্ধের মধ্য দিয়ে।
ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে নারীপ্রধান চরিত্রের সিনেমা নির্মাণে যিনি অন্য সবাইর চাইতে এগিয়ে থাকবেন তিনি কিংবদন্তি পরিচালক আমজাদ হোসেন। নারীর জীবনযুদ্ধ নিয়ে তিনি একাধিক সিনেমা নির্মাণ করেছেন। তার মধ্যে উলেস্নখযোগ্য 'গোলাপী এখন ট্রেনে' ও 'ভাত দে' অন্যতম। 'গোলাপী এখন ট্রেনে' মুক্তি পেয়েছিল ১৯৭৮ সালে। ছবিতে অভিনয় করেছেন ববিতা, ফারুক, আনোয়ার হোসেন, রোজী সামাদ, আনোয়ারা, রওশন জামিল, এ টি এম শামসুজ্জামানের মতো নন্দিত তারকারা। ছবিটি মস্কো ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পর্যন্ত প্রদর্শিত হয়েছিল। তৎকালীন সমাজের বাস্তবতায় একজন খেটে খাওয়া নারীর অসামান্য সংগ্রামকে তুলে ধরা হয়েছে ছবিটিতে। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্রসহ মোট ১১টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল এই ছবি। অনেকের মতে, এটিই ববিতার ক্যারিয়ারের শ্রেষ্ঠ সিনেমা। এছাড়া চিত্রনায়িকা শাবানা প্রযোজিত 'ভাত দে' সিনেমাটিও আমজাদ হোসেনের আরও এক কালজয়ী নির্মাণ। পাশাপাশি এই সিনেমাটির মধ্যদিয়ে শাবানা তার ক্যারিয়ারকেও এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে যান। ছবিটিতে পাওয়া গেছে শাবানার অভিনয় দক্ষতার সর্বোৎকৃষ্ট পরিচয়। ১৯৮৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর এই ছবি ৯টি শাখায় জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছিল। ছবিতে এক গরিব গায়েনের মেয়ে জরির ভূমিকায় অভিনয় করেন শাবানা। একদিন ভাতের তীব্র অনটনে পড়ে বাইরে বের হতে গিয়ে মারা যায় জরির বাবা। সেই থেকে জরির অভাব-অনটনের মাত্রা আরও তীব্র হয়ে ওঠে। প্রেম ও করুণ পরিণতি তাকে ঠেলে দেয় চরম দুরবস্থায়। ভাতের জন্য জরির অবর্ণনীয় কষ্ট আর করুণ পরিণতির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে ছবিতে। অনেকে মনে করেন সিনেমাটির রূপকল্প নেওয়া হয়েছে কবি রফিক আজাদ লিখিত 'ভাত দে হারামজাদা' নামের বিখ্যাত কবিতা থেকে। ছবিতে অনবদ্য অভিনয়ের জন্য শাবানা পেয়েছিলেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। ঢাকাই সিনেমায় এ ছাড়া আরও উলেস্নখযোগ্য কিছু নারীপ্রধান চরিত্রের সিনেমা হয়েছে। এরমধ্যে আছে 'খায়রুন সুন্দরী', 'হাঙর নদী গ্রেনেড', 'নিরন্তর', 'গেরিলা', 'অগ্নি', 'রেহানা মরিয়ম নূর', 'ন ডরাই', 'বিশ্বসুন্দরী', 'শিমু' প্রভৃতি।