একটা সময় ছিল যখন গানের শিল্পীরা তার গানের বাজার তৈরি করে দিতে অডিও বাজারে ঘোরাঘুরি করতেন। অনেক কষ্ট হতো নিজের গলা নিয়ে সেই গানের বাজারে পরীক্ষা দিতে গিয়ে। কত শিল্পীকেই না তখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসতে হয়েছে সেই গানের বাজার থেকে। যেখানে তার গলাকে 'পণ্য' হিসেবে ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছেন। মনোকষ্টে কত শিল্পীই না অবশেষে গানই ছেড়ে দিয়েছেন। মাঝেমধ্যে বন্ধুদের আসরে টুকটাক গান গাওয়া ছাড়া। সেই দিনগুলো সেই কবেই হয়ে গেছে অতীত।
বিশেষ করে করোনাকালীন পরিস্থিতি গানের শিল্পীদের জন্য শাপে বর হয়। সেই যে শুরু, এরপর থেকে শিল্পীরা সবাই এখন নিজের বেড়রুমের পাশেই নির্মাণ করে নিয়েছেন নিজস্ব স্টুডিও। এতে শিল্পীদের বাড়তি আয়-রোজগারেরও একটা পথ পরিষ্কার হয়। যেখানে একসময় সারা বছর জমজমাট থাকত রাজধানীসহ চট্টগ্রামের রিয়াজউদ্দিন বাজার এবং দেশের বিভিন্ন স্থানে অবস্থিত বাণিজ্যিক স্টুডিওগুলো। শিল্পীদের নতুন সব গানের রেকর্ডিংয়ে ব্যস্ত থাকত স্টুডিওপাড়া। মগবাজার, বেইলী রোড কিংবা ইস্কাটনের এসব বাণিজ্যিক স্টুডিওতে বিভিন্ন উৎসবে ২৪ ঘণ্টাই কাজ চলতো।
সেই তাদের একচেটিয়া বাজার যেন এখন শিল্পীরাই গ্রাস করে ফেলেছে। প্রথমে শুরু করেন, যারা অডিও বাজারে ঘুরে ঘুরেও পাত্তা পেতেন না, তারা। একপর্যায়ে তারা যখন নিজস্ব স্টুডিওকে দর্শক-শ্রোতার কাছে পৌঁছে দিতে সফলকাম হচ্ছিলেন তখন এগিয়ে আসেন প্রতিষ্ঠিত গানের শিল্পীরাও।
এভাবেই সময়ের পরিক্রমায় আগের সেই জৌলুষও হারিয়ে বসে বেইলী রোড কিংবা মগবাজারের স্টুডিওপাড়া। আগে যেখানে ব্যস্ততার জন্য স্টুডিওর একটি শিফট ভাড়া পেতেও অনেক সময় অপেক্ষা করতে হতো, সেখানে এখন সারা মাসই ফাঁকা থাকে স্টুডিওগুলো। এখন শিল্পী ও সঙ্গীত পরিচালকদের ঘরে ঘরে বসেছে হোম স্টুডিও। যে কেউ নিজের নামের পাশে জুড়ে দিচ্ছেন সঙ্গীত পরিচালকের তকমা। শুধু রাজধানীতেই বসবাস করছেন নামধারী অজস্র সঙ্গীত পরিচালক। বাণিজ্যিক স্টুডিও বন্ধ হওয়ায় বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক গুণী ও মেধাবী মিউজিশিয়ান। একটা সময় বাঁশি কিংবা বেহালা ও গিটার বাজিয়েও সংসার চালিয়েছেন মিউজিশিয়ানরা। সেখানে এই মিউজিশিয়ানদের ডাকছেন খুব কমসংখ্যক সঙ্গীত পরিচালক। কারণ, সফ্?টওয়্যারের মাধ্যমে লুপস ব্যবহার করেই বিভিন্ন মিউজিক বসিয়ে দিচ্ছেন বেশির ভাগ সঙ্গীত পরিচালক। ফলে একটি গানের আবেদনও আর সেরকম যুৎসই হচ্ছে না। থাকছে না গানের মান। এদিকে একটি রুমে কম্পিউটার ও একটি কিবোর্ড বসিয়েই খুব সহজে স্টুডিও দিয়ে ফেলছেন যে কেউ। এতে দক্ষতা কিংবা মানের কোনো বালাই থাকছে না। এভাবেই বেড়েই চলেছে হোম স্টুডিওর সংখ্যা। বাড়ছে নামধারী সঙ্গীত পরিচালক। বিদেশে বসেও অনেকে স্টুডিও রেকর্ডিংয়ের কাজ করছেন। তবে এর মধ্যেও চালু আছে কিছু বাণিজ্যিক স্টুডিও। এ নিয়ে স্টুডিও বাজনার দিলশাদ হোসেনের মতে, 'বহু স্টুডিও বন্ধ, বন্ধ হওয়ার পথে আছে আরও। দেশে স্টুডিও ব্যবসা আর আগের মতো হবে না।' কারণ, এখন যিনি গানের শিল্পী তিনিই তার গানের গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীতায়োজকসহ সবকিছুই। তবে এ অবস্থায়ও হতাশা ও আশাবাদের পাশাপাশি কমবেশি কাজ নিয়ে স্টুডিও চালিয়ে নিচ্ছেন কিছু পরিচালক। স্টুডিও গান, গানচিল, হানড্রেড মাইলস, তান রেকর্ডিং স্টুডিও, প্রমিক্স স্টুডিও, ভেলোসিটি, অধ্যায় মিউজিক, বাটার কমিউনিকেশনসসহ বেশ কিছু স্টুডিও। সময়ের পরিক্রমায় এগুলোও কতদিন টিকবে, কে জানে। কারণ, টিকে থাকার চেষ্টা করেও অনেকেই ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছেন বা অন্য ব্যবসায় ঝুঁকে পড়েছেন।
এ বিষয়ে গীতিকবি মোহাম্মদ রফিকউজ্জামান বলেন, 'এটা অস্বীকার করা যাবে না যে, কথা, সুর, পরিমিত সঙ্গীত, সুন্দর গায়কি ও সেই গানে সঠিকভাবে দেশীয় যন্ত্রের ব্যবহার একটি গানকে অন্যরকম উচ্চতায় নিয়ে যায়। সে গান টিকেও থাকে বহুদিন। কিন্তু এখনতো সব হচ্ছে হোম স্টুডিওতে। বাদ্যযন্ত্র ব্যবহারের রীতিতো উঠেই যাচ্ছে। অল্পসংখ্যক সঙ্গীত পরিচালকই বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করছেন। সবাই সফ্?টওয়্যার ব্যবহার করেই গান বানিয়ে ফেলছেন। এর মাধ্যমে একদিক থেকে যেমন গুণী বাদ্যযন্ত্রীরা বঞ্চিত হচ্ছেন, অন্যদিকে কমছে গানের মান। অথচ একটি বাঁশি কিংবা বেহালার সুর কিন্তু গানের আবেদনটাই বদলে দিতে পারে।' এ নিয়ে দেশের স্বনামধন্য শিল্পীদেরও কম আক্ষেপ নেই। পেস্ন-ব্যাক সম্রাজ্ঞী হিসেবে খ্যাত সাবিনা ইয়াসমীন যায়যায়দিনকে বলেন, 'আমি এমন মানের শিল্পী না যে, নিজের ঘরকে স্টুডিও বানাবো। বলেন তো, যারা ঘরে ঘরে স্টুডিং বানিয়ে খৈ ভাঁজার মতো একের পর এক গান করছে, কোন গানটা আপনার মনে আছে? কয়জনের মনে থাকে? কয়টা গান মানুষ দ্বিতীয়বার শোনে?' তবে এ নিয়ে নতুন প্রজন্মের শিল্পীদের কথার সুর অন্যরকম। তারা মনে করেন, এ জন্য তাদের সময় দিতে হবে। তাদের গাওয়া আজকের যে গান শ্রোতাপ্রিয় হতে পারেনি ৩০-৪০ বছর পর হয়তো সে গান শ্রোতাপ্রিয় হবে।' তবে এভাবে তাদের বেডরুমের পাশের রুমকেও যার যার নামে স্টুডিও বানিয়ে ফেলা, গান রেকর্ডিংয়ের ব্যবসা করা, এটা কি তাদের শিল্পীসত্তার জন্য সাংঘর্ষিক হয় না? গানের শুদ্ধচর্চার ক্ষেত্রে সমস্যা হয় না? এই সমস্যার কথা অবশ্য স্বীকার করতে নারাজ শিল্পীরা। তারা মনে করেন, এতে করে বরং গানের প্রতি শিল্পীদের পেশাদারিত্ব আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে।
এ বিষয়ে কিংবদন্তি সঙ্গীতশিল্পী সৈয়দ আবদুল হাদী বলেন, 'আগে একটা গানের পেছনে আমরা অনেক সময় দিতাম। বাণিজ্যিক স্টুডিওতে দুই-তিন দিন ধরে একটি গানের রেকর্ডিং হতো। গান রেকর্ডিংয়ের সময় স্টুডিওতে গীতিকার, সুরকার ও ছবির পরিচালক থাকতেন। থাকতেন মিউজিশিয়ানরা। এক টেকে সে সময় রেকর্ডিং হতো। তখন এক লাইন করে করে রেকর্ডিং হতো না। একটা গান রেকর্ডিংয়ে কখনো সারা রাত চলে গেছে। এ কারণেই গানের মান ভালো ছিল। এ কারণে এখনো সেসব গান মানুষের মুখে মুখে। এখনতো ঘরে ঘরে স্টুডিও। যে কেউ সঙ্গীত পরিচালক বনে যাচ্ছেন। এটা কিন্তু আমাদের সঙ্গীতের জন্য ভয়াবহ একটি ব্যাপার।'