আবারও ওঠে এলো শিল্পীদের পরিশ্রমিক নিয়ে বৈষম্যের অভিযোগ। এটা যে শুধু ছোটপর্দাতেই এমন নয়। ওয়েবফিল্ম থেকে শুরু করে বড়পর্দায়ও এই পারিশ্রমিক বৈষম্য চলছে বলে জানালেন ভুক্তভোগী অভিনয় শিল্পীরা। এ বিষয়ে কয়েকজন অভিনয় শিল্পীর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে কীভাবে বাজেটের দোহাই দিয়ে বৈষম্য করা হচ্ছে অভিনয় শিল্পীদের ক্ষেত্রে। যাদেরকে বাজেট কম বলে কম পরিশ্রমিক দিয়ে কাজ করিয়ে নিচ্ছেন নির্মাতারা।
অথচ গেল কয়েক বছরে টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মানও। সেই সঙ্গে বেড়েছে কাজের বাজেটও। তবুও অনেক পরিচালকের মুখে শুনতে পাওয়া যায়, কাজের বাজেট নেই। বাড়েনি, এখনো আগের মতোই রয়েছে।
এদিকে অভিনেতা আশরাফ কবীর এক ফেসবুক স্ট্যাটাসে জানান, পরিচালকরা কম টাকায় কাজ করে দিতে বলেন। কাজ করে দেওয়ার পরও ন্যায্য পাওনাটা দেন না অনেকেই। ত্রিশ বছর আগেও যা দিতেন এখনো তাই দিতে চান।
একই রকম অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন আরও একাধিক অভিনয়শিল্পী। অভিনেতা আরমান পারভেজ মুরাদ বলেন, 'এখন টেলিভিশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের সংখ্যা যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে মানও। সেই সঙ্গে বেড়েছে কাজের বাজেটও। এটা খুবই ভালো। তবে এর নিয়ন্ত্রকরা যদি আলোর দিকে আসেন, আমিত্ব ভাবটা ছাড়তে পারেন, তাহলে ভালো হয়। সিনেমা হিরো-হিরোইনসর্বস্ব হলে একটা বৈষম্য থাকেই। তখন নায়ক-নায়িকা জুস খাবেন আর অন্যরা চা খাবেন- এই আর কি। এমন ছোটলোকি তো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে মানানসই হয় না। এখানে পারিশ্রমিকে হিরো-হিরোইনই কোটি টাকা গ্রাস করলে অন্যরা ১০ হাজার টাকায় কী করবেন? যেমন- একজন শিল্পী ৬০০ সিনেমা করেছেন। এখন তিনি দিন এনে দিন খান। এটা তো হতে পারে না।'
আসলে পারিশ্রমিক নিয়ে এই ঠকাঠকির মধ্যে আছেন যুগ যুগ ধরেই অভিনয়শিল্পীরা। 'বিশ্বসুন্দরী' ছবিতে অভিনয় করে বেশ প্রশংসিত হয়েছেন মনিরা মিঠু। তার দাবি, চলচ্চিত্রে অভিনয় করে বেঁচে থাকার মতো নূ্যনতম সম্মানী পান না অনেক শিল্পী। বেশ কয়েকটি সিনেমায় কাজ করতে গিয়ে এমনই অভিজ্ঞতা হয়েছে এই অভিনয়শিল্পীর। মিঠু বলেন, টিভি নাটকের মতো পারিশ্রমিক পেলেও নিয়মিত ছবিতে অভিনয় করতেন। গল্প ভালো হলে অর্ধেক পারিশ্রমিকেও আপত্তি নেই। কারণ, সিনেমায় কাজের প্রস্তাব পেলেই খুশি হয়ে ওঠেন মিঠু। কিন্তু পারিশ্রমিকের অংক শুনলেই দমে যান। সেজন্য বেশ কিছু ছবিতে কাজের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছেন তিনি। সেসব ছবির পারিশ্রমিক একটি টিভি নাটকের চেয়েও কম!
মনিরা মিঠু আরও জানান, প্রস্তাব পাওয়া সেসব ছবির বেশির ভাগের গল্প পছন্দ হয় না। তারপরও অনুরোধে কাজ করতে হয়। গল্প ভালো ও পারিশ্রমিকের অংক ভালো হলে ছবিতে অভিনয় করতে চান তিনি।
মনিরা মিঠু বলেন, 'চুক্তির সময় প্রায়ই এফডিসি কেন্দ্রিক ছবির পরিচালকেরা বলেন আমরা এই শিল্পীকে এত টাকা দিই, সেই শিল্পীকে এত টাকা দিই। আপনাকেও সেই রকম পারিশ্রমিক দিচ্ছি। শুনে আমার বিশ্বাস হয়নি। এত গুণী শিল্পীদের পারিশ্রমিক এত কম!'
সিনেমা ও নাটকে যারা মা, বাবা, ফুপু, খালা চরিত্রে অভিনয় করেন, তাদের সঙ্গে কথা বলেছেন মিঠু। জেনেছেন, তারা সম্মানী পান খুবই কম। তাদের কথা শুনে মিঠুর মনে হয়েছে, এভাবে নির্মাতারা যুগ যুগ ধরে শিল্পীদের প্রতি অবিচার করে আসছেন।
দেশের প্রায় সব শীর্ষ তারকাসহ বহু তারকার সঙ্গে ৩ শতাধিক ছবিতে অভিনয় করেছেন এক অভিনেত্রী। এখন দু'একটি নাটকের কাজ করলেও সিনেমায় সুযোগ পাচ্ছেন না। তিনি জানান, বেশির ভাগ শিল্পীর সঙ্গে প্রযোজক-পরিচালকের ৩০ হাজার টাকায় চুক্তি হয়। সাইনিং মানি হিসেবে দেওয়া হয় ১০ থেকে ১৫ হাজার টাকা। বাকি টাকা শুটিং শেষে যা পান সেটাও ভেঙে ভেঙে দেওয়া হয়। কখনো আজীবনের জন্য বকেয়াও থেকে যায়।
বাইরে থেকে দর্শক হয়তো মনে করেন অনেক আরামেই আছেন এই চরিত্রাভিনয় শিল্পীরা। কিন্তু তারা যে দেশের গামেন্ট শ্রমিকদের চেয়ে বাজে অবস্থায় দিনাতিপাত করছেন এটা বাইরের মানুষ কী করে বুঝবে? কিন্তু মানসম্মানের ভয়েই নাকি তারা বাইরের মানুষের কাছে এসব প্রকাশ করতে লজ্জা পান। এমন কথাই বলেছেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এই প্রবীণা অভিনয় শিল্পী।
তিনি বলেন, 'কম পারিশ্রমিক দিয়ে তারা আমাদের প্রতি অবিচার করেন। আগে যারা মা-বাবা বা অন্য বড় চরিত্রে অভিনয় করতেন, তাদের বেশির ভাগই এই রকম পারিশ্রমিকই পেতেন। সেজন্য পারিশ্রমিক নিয়ে কিছু বলতে পারতাম না। বললে, আমাকে বাদ দিয়ে অন্য আরেকজনকে নেবে।'
এই শিল্পীরা আগে থেকেই তাদের সংসার জীবনে থাকতেন নানা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে। এখন বয়স বেড়েছে। কাজের জন্য কেউ ডাকছেন না। অনেকের কাছেই পাওনা পারিশ্রমিক ধরনা দিয়েও পাচ্ছেন না। অনেক নির্মাতা ফোনই ধরেন না। এই অভিনয়শিল্পী এখন নিয়মিত নাটকে অভিনয়ের চেষ্টা করছেন। নাটকে সিনেমার চেয়ে অনেক বেশি টাকা পান তিনি।
প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের চালাকিটাই হচ্ছে, যে শিল্পীকে যত কম টাকায় ম্যানেজ করা যায়, তত কমেই ম্যানেজ করার চেষ্টা করা। এই তৎপরতা আজকালেরও নয়। সেই 'মুখ ও মুখোশ' থেকেই চলে আসছে এমন অপকৌশল। এমন কথাই জানালেন, চলচ্চিত্র পরিচালক মতিন রহমান। তিনি জানান, চলচ্চিত্র অঙ্গনে শিল্পীদের মূল্যায়ন কম হয়। 'মুখ ও মুখোশ' ছবির অনেক ভালো অভিনয়শিল্পী পরে এক্সট্রা শিল্পী হিসেবে কাজ করে জীবন ধারণ করেছেন। তিনি বলেন, 'শিল্পীদের ঠকানো একটা প্রথা হয়ে গেছে। এটা যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। এই প্রথা ভাঙা কঠিন। অনেক অভিনয়শিল্পী সম্মানের কথা ভেবে চুপ থাকেন।'
পারিশ্রমিকের কারণে অনেকেই কষ্ট করে চলেন, তবু অভিনয় করতে চান না। পর্দায় যাদের উজ্জ্বল করে তুলে ধরা হয়, বাস্তবে তাদের সে রকম মূল্যায়ন করতে হবে। এ জন্য নির্মাতাদের এগিয়ে আসতে হবে। অভিনয়শিল্পীদের ঠিকমতো পারিশ্রমিক দিলে আমাদের অভিনয়শিল্পীর অভাব হতো না।'