মঙ্গলবার, ১৯ নভেম্বর ২০২৪, ৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

সাড়া জাগাতে পারছে না রোমান্টিক সিনেমা

মাতিয়ার রাফায়েল
  ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
'শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়' সিনেমার একটি দৃশ্যে প্রার্থনা ফারদিন দীঘি ও গাজী আবদুন নূর

সুস্থধারার সিনেমায় ফেরার পর থেকে শুরু হয় আবারও রোমান্টিক ধারা সিনেমা নির্মাণের। রোমান্টিক সিনেমায় নতুন করে এই ফেরার শুরুটা অবশ্য মন্দ যায়নি। বেশ ভালোই শুরু হয়েছে বলা যায়। এক্ষেত্রে ভিন্ন আঙ্গিকের রোমান্টিক সিনেমা 'পরাণ' সিনেমাটি তো একটা মাইলফলক হয়েই থাকবে।

এমনিতেই করোনার আগ পর্যন্ত দেশের সিনেমা ছিল একেবারেই গন্তব্যহীন। অশ্লীলতার জোয়ারে ভেসে যাওয়া এফডিসিতে যখন নতুন করে সুস্থধারার সিনেমায় ফেরার পরিকল্পনা করছিল তখন তারা কেমন সুস্থধারায় সিনেমায় ফিরবে এ নিয়ে কোনো সঠিক পরিকল্পনায় আসতে পারছিল না। অশ্লীল সিনেমায় যাও কিছু দর্শক ছিল সেটা জগাখিঁচুরি জাতীয় গল্পে বানানো সিনেমাগুলো সেই দর্শকও ধরে রাখতে পারল না। বরং দিনকে দিন সিনেমার দর্শক আরও তলানির দিকে যাচ্ছিল। ২০২০ এবং ২০২১ সাল গেছে করোনা অতিমারিতে। তখন স্থবির হয়ে পড়ে সব কর্মকান্ড, প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা। প্রেক্ষাগৃহ বন্ধ থাকায় দীর্ঘদিন তো কোনো সিনেমাই মুক্তি পায়নি তখন। প্রেক্ষাগৃহ খোলার পরও মুক্তির তালিকায় থাকা সত্ত্বেও অনেকগুলো বাণিজ্যিক ছবিগুলো মুক্তি দেওয়া হয়নি। অন্যদিকে ভিন্নধারার চলচ্চিত্র এমনিতেই কোনো লাভের অংক কষে না। তারা শুধু আলোচনায় থাকার জন্যই চলচ্চিত্র করেন। যেহেতু এ ব্যাপারে মিডিয়াও তাদের ভালো পৃষ্ঠপোষকতা দিয়ে থাকে। নিয়মিত তাদের নিউজ করে। কিন্তু যেসব সিনেমা দেখে দর্শক অভ্যস্ত হয়ে আছে আগে থেকেই সেসব মেইন স্টিমের সিনেমার গল্প আর ঘুরে দাঁড়াতে না পারায় নির্মাতা এর বাইরে কোনো ধারার গল্পে সুস্থধারার সিনেমা বানাবেন সেটার কোনো সঠিক পরিকল্পনায় আসতে পারছিলেন না। পিছিয়ে পড়ছিলেন তাদের প্রি-প্রোডাকশন কেমন হবে সেসবের আইডিয়া থেকে। কেন সব সিনেমাই দর্শক টানতে পারছে না তার কোনো কুলকিনারা করতে পারছিলেন না সিনেমা সংশ্লিষ্টরা। কথায় বলে, 'প্রচারেই প্রসার'। কথাটি এখন যে আর সবক্ষেত্রে খাটে না সেটা বিগত দু'তিন বছরে অনেক ঢাকঢোল পিটিয়ে প্রচার করা কয়েকটি বিগ বাজেটের সিনেমায় দেখা গেছে। 'অপারেশন সুন্দরবন', 'মিশন এক্সট্রিম', 'অন্তর্জাল' প্রভৃতি সিনেমার কোনোটিই কেন দর্শক টানতে পারেনি তার কোনো হিসাবই মেলাতে পারেননি সংশ্লিষ্টরা। অথচ একটা সময় ছিল যখন বাণিজ্যিক ছবি মানেই সব শ্রেণির দর্শক- সেই চিত্রটি যেন গত পাঁচ বছরে সরে যাচ্ছে।

তবে এই বাণিজ্যিক ধারার বাইরেও গত কয়েক বছরে আরেক ধারার সিনেমা হয়েছে। যেগুলোকে 'অফট্র্যাকের সিনেমা' বলা হয়। এর নির্মতারা 'প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ' ঝোলানো এমন স্টিকার দেখতে না চাইলেও তাদের মধ্যে সুস্থধারার সিনেমা বানাতে কোনোই কার্পণ্য ছিল না। তারপরও 'প্রেক্ষাগৃহ পূর্ণ' দূরের কথা- সিনেমাগুলো দেখতে দুয়েক সারিও দর্শক দেখা যায়নি। ফলে বাংলাদেশে মুক্তি দেওয়ার আগেই অনেকে তাদের সিনেমাগুলো নিয়ে গেছেন দেশের বাইরে ছোট-বড় বিভিন্ন ফেস্টিভালে।

কিন্তু দেশের বাইরে যেসব সিনেমা বিভিন্ন ফেস্টিভালে গিয়ে প্রশংসিত হয় বলে দাবি করা হয়ে আসছে এগুলো আসলে সেখানে কতটা প্রশংসিত হচ্ছে এটা দেশে থেকে কারও জানার উপায় নেই। কারণ সেখানে যেকয়টি সিনেমাই অংশগ্রহণ করছে দেখা যাচ্ছে তার সব কয়টিই দাবি করছে অমুক ফেস্টিভালে তমুক সিনেমা কেমন-কেমন প্রশংসা পেয়েছে তার নানা রকম ফিরিস্তি। এটা সবার ক্ষেত্রে বলার উদ্দেশ্য নয়। দু-একটি বাদে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এ নিয়ে যে অতিরঞ্চি করছে এ নিয়ে কোনো সংশয় থাকার কথা নয়। নয়তো ওইসব সিনেমা দেশে কেনো মিনিমাম সাড়া পাবে না? দেশের দর্শক কি এতটাই অবুঝ যে তাদের সিনেমা বোঝে না?

যাহোক এ ধারার সিনেমা অনেকগুলোই হয়েছে গত দু'তিন বছরে। তবে এ বছরের শুরু থেকে সে ধারার সিনেমা আর দেখা যাচ্ছে না যেগুলোকে অফট্র্র্যাকের সিনেমা বলে দাবি করা হয়।

এ বছর যে কয়টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এখনও পর্যন্ত কোনো সিনেমাই দর্শকের কাছে তেমন পাত্তা পায়নি। বেশির ভাগই মুখ থুবড়ে পড়েছে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হতে গিয়ে। কোনো কোনো সিনেমাকে দু-একদিন যেতে না যেতেই নামিয়ে ফেলতে হয়েছে।

গত দু'তিন সপ্তাহে যে কয়টি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে এগুলোর মধ্যে দেখা গেছে সামাজিক রোমান্টিক ঘরানার সিনেমাই বেশি। যেমন, বন্ধন বিশ্বাস পরিচালিত এবং সরকারি অনুদানে নির্মিত নিরব হোসেন ও অপু বিশ্বাস পরিচালিত 'ছায়াবৃক্ষ', নুরুল আলম আতিক পরিচালিত 'পেয়ারার সুবাস', আবদুস সামাদ খোকন পরিচালিত এবং প্রার্থনা ফারদিন দীঘি অভিনীত 'শ্রাবণ জ্যোৎস্নায়' প্রভৃতি। এ ছবির কোনোটিকেই খারাপ সিনেমা বলা যাবে না। অন্তত এমন সিনেমা বলা যাবে না যে, এগুলোর কোনো দর্শকই হবে না। তাহলে আরও কতটা উন্নত হলে সে গল্পের সিনেমাকে সুস্থধারার সিনেমা বলা যাবে? আসল কথা হচ্ছে, নব্বই দশকের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে এরপর গোটা দু'দশক যেভাবে অশ্লীলতার জোয়ারে ভাসিয়ে নেওয়া হয়েছে এ দেশের দর্শককে সেই দর্শক নিজেরাই যেন কোনো সুস্থধারার সিনেমায় ফিরতে চাইছে না। আবার এমনও নয় যে তারা আবার অশ্লীল সিনেমায় ফিরতে চাইছে। সেটাও নয়। আসল কথা হচ্ছে যেভাবে ঢাকাই বাংলা সিনেমা একটা ধারাবাহিকতা রক্ষা করে তার গল্পের পরিবর্তনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল সেটাতেই ছেদ ঘটে একটা সময় সুস্থধারার বাংলা সিনেমাকে লন্ডভন্ড করে দেওয়া অশ্লীল সিনেমার কারণে।

আর এসব কারণেই এখন দেশের প্রেক্ষাগৃহের ওপর ভরসা না করে অমিতাভ পালের মতো অন্যান্য ক্রিয়েটিভ পরিচালকরা তাদের সিনেমা দেশের বাইরেই প্রদর্শনের ব্যবস্থা করছেন। এ কারণেই অমিতাভের 'রিকশাগার্ল' ছবি দেশে মুক্তি দেওয়ার আগেই বিদেশে ঘুরছে। যে রিকশা বাংলাদেশের মানুষের জীবন-যাপনের প্রাত্যহিক প্রতীক সেটা প্রদর্শিত হয় বিদেশে। যে রিকশার সঙ্গে বাংলাদেশের মানুষ চিরপরিচিত সেই দর্শকের অপেক্ষা না করে সেই সিনেমা এমন দর্শকের কাছে যাচ্ছে যে দেশের দর্শক হয়তো জানেই না রিকশা কী বস্তু! তখন সেই দেশের মানুষ এটা দেখে যদি প্রশংসা করেন তখন এটাকে কতটা বাস্তব প্রশংসা বলা যাবে? নাকি তারা একটা অদ্ভুত বস্তু দেখেই সেটা প্রশংসা করছে? সেটা আসলে কীরকম প্রশংসা, এটি আসলে বোঝা যেত দেশের প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলে।

দেশে মুক্তি পাওয়ার আগেই বেশকিছু সিনেমা বিদেশের ফেস্টিভালে গেছে। যেমন, রিজওয়ান শাহরিয়ার সুমিতের 'নোনা জলের কাব্য', 'কালবেলা', 'চন্দ্রাবতী কথা', 'লাল মোরগের ঝুঁটি' প্রভৃতি।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে