নাটক ও চলচ্চিত্র থেকে মানুষ যে শুধু শিক্ষণীয় বিষয়ই পায় এমন নয়- নাটক ও সিনেমার মূল প্রাণরসই যোগান দেয় বিনোদন। যে সিনেমায় বা নাটকে বিনোদন পাওয়া যায় না সেটা যতই শিক্ষণীয় হোক দেখার বিষয় হিসেবে দর্শকের কাছে সেটার কোনো আবেদনই থাকে না তখন। একটি সিনেমায় শুধু নায়ক-নায়িকার টগবগে সংলাপ আর ফ্যান্টাসিই সবটা নয়।
তবে হালে সিনেমায় গল্পের নানা অনুষঙ্গগুলো কাটছাঁট করতে করতে এমন এক জায়গায় এনে কমপ্যাক্ট করে ফেলা হয়েছে যে, সিনেমায় কিছু চরিত্র আছে কিন্তু চরিত্রগুলোর সামগ্রিক চরিত্রায়ন দেখা যাচ্ছে না। চরিত্রগুলোর পরিপূর্ণতা নেই। এভাবে অন্যান্য পার্শ্ব চরিত্রগুলোও কাটছাঁট হতে হতে কিছু চরিত্রই হারিয়ে যাচ্ছে। যেমন- একসময়, বিশেষ করে ঢাকাই সিনেমায় কমেডিয়ান বা কৌতুক অভিনেতার একটা গুরুত্ব ছিল। প্রাণোচ্ছল হাস্যরস বা কৌতুক অভিনেতা ছাড়া বাংলা সিনেমা কল্পনাই করা যেত না। সিনেমার নায়ক-নায়িকা, ভিলেন ও পেস্ন-ব্যাকের পাশাপাশি বিনোদনের অপরিহার্য হিসেবে কৌতুক অভিনেতারাও সমান গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন। কৌতুক অভিনয় শিল্পী শুধু বাংলাদেশেই নয়- সারা বিশ্বেই তার কদর রয়েছে। যেমন- নির্বাক যুগের ব্রিটিশ অভিনেতা, হলিউড কাঁপানো স্যার চার্লস স্পেনসার চ্যাপলিন জুনিয়র যিনি চ্যার্লি চ্যাপলিন নামেই জগদ্বিখ্যাত। তার কৌতুক অভিনয় আজও মানুষের কাছে বিস্ময় হয়ে আছে। আরেক জগদ্বিখ্যাত ব্রিটিশ কৌতুক অভিনয় শিল্পী হচ্ছেন মি. বিন, সিটকম বস্নাকাডার, নট দ্য নাইফ ও'ক্লফ নিউজ খ্যাত রোয়ান সেবাস্টিয়ান অ্যাটকিনসন ওরফে রো।
সিনেমা মানেই তাতে একটি পরিপূর্ণ সুন্দর গল্প থাকবে। সমাজের নানা বৈচিত্র্যপূর্ণ চরিত্রের সমাবেশ থাকবে। সেই চরিত্রের মাঝে এমন কিছু চরিত্র থাকবে, যা গল্পের মূলভাবে থেকে গোটা সিনেমাটিকে আগলে রাখবে এবং টেনে নিয়ে যাবে। আমরা দেখি তাতে এমনই একটি চরিত্র যিনি পর্দায় উপস্থিত হওয়ার সঙ্গেই দর্শকের সব মনোযোগের কেন্দ্রে চলে আসেন। তার অভিনব বাচনভঙ্গি আর অভিনয় নৈপুণ্য বিশেষ বিনোদনের খোরাক হয়ে ওঠে। তারাই হচ্ছেন কমেডিয়ান বা 'কৌতুক অভিনেতা'। কিন্তু সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমা থেকে এই কৌতুক অভিনেতারা যেন একেবারেই হারিয়ে গেল। একজন বাংলাদেশি অভিনেত্রী বলেছিলেন, 'দেশের মানুষ যেন হাসতেই ভুলে গেছে।' তবে কি বাঙালি হাসতে ভুলে গেছে? যে হাসি ফোটানোর জন্য কৌতুক অভিনয় শিল্পীর কৌতুককর সংলাপ দর্শকের মন ভরিয়ে দিত নির্মল আনন্দে? অথচ ঢাকাই সিনেমায় নায়ক-নায়িকাই নয়, কৌতুক অভিনেতা ছাড়া গোটা সিনেমাটাই অসম্পূর্ণ হয়ে থাকত।
অনেকের অভিনয় এমন যে, তার স্বাভাবিক অভিনয়ও কেমন বিমলানন্দকর কৌতুকময় হয়ে ধরা দেয়। যেমন গুরুগম্ভীর অভিনেতা হিসেবে পরিচিতি পেলেও অভিনেতা অমল বোস সে গোত্রেরই কৌতুককর অভিনয় করতে জানতেন। অভিনেতা খান জয়নুল, হাসমতও সেরকম অভিনেতা ছিলেন। বাংলাদেশে বলিষ্ঠ কৌতুক অভিনেতা ছিলেন খান জয়নুল। শুধু কৌতুক অভিনেতাই নয় তিনি পার্শ্ব অভিনিতা হিসেবেও তার গুণের পরিচয় দিয়েছেন। বিশেষ ভ্রম্নভঙ্গির সঙ্গে কৌতুক অভিনয়ের মাধ্যমে দর্শককে শুধু হাসাতেই নয়, কাঁদাতেও জানতেন তিনি। এছাড়া আরেকজন কমেডিয়ান রবিউল, যার শারীরিক উপস্থিতিতেই প্রেক্ষাগৃহে দর্শকের মাঝে নির্মল হাসির ঢেউ খেলে যেত। তবে রবিউলসহ টেলি সামাদ, দিলদার যেন কৌতুক করতেই অভিনয় করতেন এমন মনে হতো। কিন্তু সেটা কখনোই ভাঁড়ামির পর্যায়ে যেত না।
বাঙালি জীবনাচারে কৌতুককর অনেক কিছুই আছে। গল্পেও তার অনুপ্রবেশ ঘটে। কিন্তু সেরকম সতেজ গল্পের অভাবে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে হাস্যরসাত্মক বিষয়গুলোও। তারই ধারাবাহিকতায় কমেডির গুরুত্বও কমে আসছিল দিন দিন। এখন তো সিনেমা থেকেই হারিয়ে বসেছে এই শিল্পীরা। সর্বশেষ যাদের কমেডি দর্শককে মনোরঞ্জন করেছে তাদের মধ্যে বস্ন্যাক আনোয়ার, আফজাল শরীফ, ফাইয়াজ আহমদ ববি, কাবিলা, চিকন আলী, জ্যাকি আলমগীর, হারুন কিসিঞ্জার অন্যতম। কিন্তু সিনেমা থেকেই যদি কমেডির গুরুত্ব হারিয়ে বসে তখন এই শিল্প তারা কোথায় মেলে ধরবেন? শুধুমাত্র ম্যাগাজিনেই সীমাবদ্ধ থাকবে?
অথচ সিনেমায় বা টিভি নাটকে বিপুল দর্শকের মনোরঞ্জন করে তাদের অনেকেই দর্শকপ্রিয় হয়েছেন। যেমন- বেবি জামান, সাইফুদ্দিন, আশীষ কুমার লোহ, পরাণ বাবু, রবিউল, আনিসুর রহমান আনিস, হাবা আসমত, আলতাফ হোসেন, মতি, টেলি সামাদ, এটিএম শামসুজ্জামান, দিলদারদের নাম তো কিছুতেই হারিয়ে যাওয়ার নয়। তাদের অনেকের আবার নির্দিষ্ট দর্শকও ছিল। যাদের কমেডি দেখার জন্যই সিনেমা হলে দর্শক যেতেন। তাদের মধ্যে টেলি সামাদ, দিলদার, রবিউল, হাবা হাসমত, মতি, এটিএম শামজুজ্জামান অন্যতম।
এখন তাদের শূন্যতা পূরণ না হওয়ায় ঢাকাই সিনেমার জৌলুসই হারিয়ে বসেছে অনেকটা। তারপরও যারা আছেন তারাও সিনেমায় ব্যবহৃত হচ্ছেন না। সেই দুঃখে অনেকে এই পেশাটাই ছেড়ে দিয়েছেন। তবে তাদের কারো কারো কৌতুক খুব বেশি ভাঁড়ামি হয়ে পড়ায় দর্শকই তাদের গ্রহণ করতে পারেনি। কৌতুক যে একটা আলাদা শিল্প, এটা যেন তারা ভুলেই যান। আর সাম্প্রতিক সিনেমায় যেন হাসতে না জানা দর্শকের জন্য হাস্যরসাত্মক গল্পবিহীন নায়ক আর খল নায়কের গুরুগম্ভীর অভিনয়ই চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
এ ব্যাপারে ঢাকাই সিনেমার একজন পরিচালকের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন- 'ইন্ডাস্ট্রিটাই তো হারিয়ে যাচ্ছে। কৌতুক অভিনেতা নেইও আসলে। এটা হচ্ছে গড গিফটেড ব্যাপার। সবাইকে দিয়ে হয়ও না। যারা আছেন, সেই কাতুকুতু দিয়ে তো কমেডি হয়ও না। কাবিলা ছিলেন- গলার সমস্যায় পারছেন না। ভিলেনদের মধ্যে ছিলেন সাদেক বাচ্চু ভাই। আগে তো আমরা বাইরে থেকে যোগাড়যন্ত্র করে কমেডিয়ান আনতাম। এখন এটাও হচ্ছে না। মেইন হিরো-হিরোইনরাই কমেডি করছে। যেমন- শাকিব, ফেরদৌস- রিয়াজও করতেন। তবে দিলদার, খান জয়নুল, টেলি সামাদ, এটিএম শামজুজ্জামান, অমল বোস, আলতাফ ভাইদের মতো কমেডিয়ান তো হবে না।'