নতুনদের সম্পর্কে পুরনোদের মূল্যায়ন

প্রকাশ | ২৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

মাতিয়ার রাফায়েল
মিডিয়ার জগতে যারা আছেন বিশেষ করে অভিনয় শিল্পী- তাদের কেউই ইন্ডাস্ট্রিতে পা রেখেই কিংবদন্তি হয়ে যান না। এজন্য তাদের দীর্ঘদিন লেগে থাকতে হয়। ভালো ভালো গল্প ও চরিত্রে কাজ করতে হয়। আবার সেজন্য যে সবাই-ই খ্যাতিমান বা কিংবদন্তি হবেন এমনও নয়। একটা ইন্ডাস্ট্রিতে কিংবদন্তিতুল্য পারফর্মার বলে-কয়ে জন্ম নেয় না। এজন্য দীর্ঘ অপেক্ষার প্রয়োজন আছে। তবে কিংবদন্তি না হোক অন্তত মানসম্পন্ন অভিনয় শিল্পী হতে তো বাধা নেই। সে রকম মানসম্পন্ন অভিনয় শিল্পী তো মোটামুটি সব ইন্ডাস্ট্রিতেই তো থাকেই। সেদিক থেকে যারা সিনিয়র এবং বিশিষ্ট শিল্পী হিসেবে আলোচিত তারা জুনিয়র শিল্পীদের সম্পর্কে কে কেমনভাবে দেখেন তাদের অভিজ্ঞতার আলোকে স্বাভাবিকভাবেই তার একটা ব্যখ্যা থাকবে। কেননা আজকে যারা সিনিয়য় একসময় তারাই ছিলেন জুনিয়র। সেই জুনিয়র শিল্পী অবস্থায় থেকে অভিনয় করতে করতেই সিনিয়র হয়ে উঠেছেন তারা। কেউ হয়েছেন বরেণ্য, কেউবা কিংবদন্তি। সেজন্য তাদের অভিজ্ঞতার ভান্ডার কম ওজনদার নয়। তারা অনেক কিছুই জানেন-বোঝেন। অনেক নামকরা পরিচালকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। সেই অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান জুনিয়র শিল্পীরা কেমন করছেন এ নিয়ে জ্যেষ্ঠ অভিনয় শিল্পী ও পরিচালকদের কাছে জানতে চাওয়া হয়। তখন কেউ সম্পূর্ণ ইতিবাচক বলেছেন কেউবা কিছুটা নেতিবাচক আবার অনেকে মাঝামাঝি একটা অবস্থানে থেকে তরুণদের কিছু সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে মন্তব্য করে তাদের ভালো দিকটা সম্পর্কেও বলেছেন। ঢালাওভাবে ভালো বা মন্দ কোনোটাই বলেননি। অর্থাৎ জুনিয়রদের সম্পর্কে সিনিয়রদের দৃষ্টিভঙ্গি সবারই এক নয় আবার আলাদাও নয়। একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। এসব বলতে গিয়ে ফিরে গেছেন আবার নিজেদের তরুণ সময়ের অভিনয় জীবনেও। এ সম্পর্কে সিনিয়ার অভিনয় শিল্পী, একুশে পদকসহ ৬ বারের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ জুনিয়রদের সম্পর্কে কোনো মূল্যায়নে না গিয়ে বলেন, 'আমার কথা হচ্ছে, যে যেই কাজ করুক, সেটা জেনে-বুঝে-শিখে করলে ভালো হয়। এখন সে জানাটা কীভাবে অর্জন করবে সেটা তার নিজস্ব ব্যাপার। একেকজনের কাজ একেক রকম হবে সেটাই স্বাভাবিক। সেজন্য গৎবাঁধা কোনো ফর্মুলা নেই। সেটা যে কোনো কাজের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। তবে সমস্যাটা হচ্ছে, গৎবাঁধা শেখা বিষয় দিয়ে কখনোই আগানো যায় না।' জুনিয়ররা কেমন অভিনয় করছে সে প্রসঙ্গে এখানে রাইসুল ইসলাম আসাদ তাদের অভিনয়ের ভালো-মন্দ সম্পর্কে কিছু না বলে শুধু এতটুকুই বুঝিয়েছেন তার অভিনয় 'ভালো' হলেও 'গৎবাঁধা' ভালো হচ্ছে কীনা এটাই এ অভিনেতার প্রথম দৃষ্টিভঙ্গি। সেক্ষেত্রে দেখা যায় বহু অভিনয় শিল্পীই ভালো অভিনয় করেন কিন্তু 'গৎবাঁধা'। কোনো বিশেষত্ব বা চিত্তাকর্ষক দিক নেই। সে রকম আলাদাভাবে চোখে পড়ার মতো এখন অভিনয় শিল্পী কেমন আছে এ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বেশিরভাগ সিনিয়র অভিনয় শিল্পীই মনে করেন সেজন্য একজন অভিনয় শিল্পীকে সময় দিতে হবে। হুট করেই কেউ ইউনিক অভিনয় শিল্পী হবে না। সেজন্য অপেক্ষা করতে হবে। তারা বলেন, এখনকার প্রায় সব নতুন অভিনয় শিল্পীই ট্যালেন্ট, মেধাবী- তারা খুব দ্রম্নতই শিখতে পারেন। তবে তাদের মধ্যে অস্থিরতাটা খুব বেশি। এমন মন্তব্য প্রায় সব সিনিয়র অভিনয় শিল্পীরাই করে থাকেন। সিনিয়র শিল্পীরা জুনিয়র শিল্পীদের সম্পর্কে আরেকটি দৃষ্টিকটু দিক সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, 'জুনিয়র শিল্পীরা রাতারাতি লাইম লাইটে আসতে চান, এজন্য যেভাবেই হোক তারা ভাইরাল হতে চান আর অর্থের প্রতি মোহ তাদের প্রচন্ড। সিনিয়রদের প্রতি তাদের সম্মানসূচক ব্যবহারও নাই বললেই চলে।' ইত্যাদি। বিশিষ্ট অভিনেত্রী ডলি জহুর নতুনদের সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলেন, 'এখনো বুঝতে পারছি না। হয়তো ভবিষ্যতে ভালো হবে।' তার মানে নতুনদের সম্পর্কে তিনি নেতিবাচক কিছু বলতে না চাইলেও ইতিবাচক কিছু বলতে পারছেন না। অন্যদিকে গুলশান আরা আক্তার চম্পা বলেন, 'যখন নতুন চিন্তা আর পুরনো অভিজ্ঞতা একসঙ্গে সুন্দর একটা কম্বিনেশন ঘটবে তখনই সেটা চলচ্চিত্রের জন্য সুবার্তা বয়ে আনতে পারবে।' সেজন্য তিনি মনে করেন শুধু তরুণদের দিয়ে কাজ করালে সে সিনেমা কোনো সুবার্তা বয়ে আনতে পারবে না। কাজেই তরুণরা যতটুকু ভালো করছে সেটা আরও ভালো হবে যদি তার সঙ্গে পুরনোদের যুক্ত করা হয়। সেক্ষেত্রে বিশিষ্ট পরিচালক মালেক আফসারী চমৎকার একটি উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, 'শিল্পীরা হলো কাদামাটির মতো। কাদামাটিকে যেভাবে রূপ দেওয়া হবে সেই কাদামাটিও সে রকম হবে। শিল্পীও তাই। যে শিল্পী আছে তাদের থেকেই আমাদের দেশেও শাহরুখ খান, সালমান খানদের মতো শিল্পী বানানো যেত- যদি মানের পরিচালক থাকত।' এ ক্ষেত্রে পরিচালক মালেক আফসারী একজন শিল্পীর ভালো-মন্দ হয়ে ওঠার পেছনে একজন পরিচালকই গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন। নাদের চৌধুরী বলেন, 'এখন আসলে সিনেমার বাজারই খুব ডিফিকাল্ট হয়ে গেছে। বাজার ছোট হয়ে গেছে। লগ্নিকারকও পাওয়া যাচ্ছে না। এ অবস্থায় নতুন সুপারস্টার হওয়া ডিফিকাল্ট। ভালো অভিনয় শিল্পী পাওয়াও ডিফিকাল্ট। আবার ভালো শিল্পী পেতে হলে ভালো গল্পেরও দরকার। কিন্তু ভালো গল্প সচরাচর পাওয়া যায় না। ভালো গল্পই সুপারস্টার তৈরি করে। এখন সবকিছুর সংকটের মূলেই এই ভালো গল্প না থাকা। আগে যেসব ভালো অভিনয় শিল্পী দেখা গেছে সেটা ভালো গল্পের জন্যই। এখন মূল কথা হচ্ছে ভালো শিল্পীর জন্য ভালো গল্পটিই সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন। নয়তো নতুনদের সম্পর্কে মূল্যায়নে যাওয়া কঠিন হবে। এখন ভালো গল্পই যদি না থাকে ভালো অভিনয় শিল্পী কী করে পাওয়া যাবে।' নতুন শিল্পীদের সম্পর্কে মূল্যায়ন করতে গিয়ে সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, 'একসময় তো আমরাও নতুন ছিলাম। সেই অভিজ্ঞতা থেকেও বুঝি নতুনরা সিনসিয়ারলি কাজ করে। প্রপারলি সময়টা দেয়। মনোযোগ দিয়ে কাজটা করে। তাই আমি নতুনদের নিয়েই কাজ করি। দেখবেন আমার সব সিরিয়ালেই নতুনরা কাজ করে। তাদের নিয়ে কাজ করতে আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধও করি। কখনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয় না। এভাবেই তো নতুন শিল্পী তৈরি হয়। ইন্ডাস্ট্রিটা কন্টিনিউ করতে পারে। আমি সেটাই করি। সেভাবেই চেষ্টা করছি।'