পর্দায় দেখা মেলেনি যেসব সিনেমা
প্রকাশ | ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
অনলাইন ডেস্ক
ম মাতিয়ার রাফায়েল
প্রত্যেক নির্মাতাই তার সিনেমায় যে লাখ-লাখ টাকা লগ্নি করেন নিশ্চয় সেটা জলে জলাঞ্জলি দিতে লগ্নি করেন না। প্রত্যেক নির্মাতাই একটা ব্যবসা করার আশা নিয়েই একটি সিনেমায় টাকা লগ্নি করেন। সুপার-ডুপার ব্যবসার স্বপ্ন না দেখলেও নিশ্চয় সুপার-ডুপার ফ্লপ মারার জন্য ছবিতে টাকা লগ্নি করেন না। ব্যবসা না করুক জাতীয় নির্বাচনে 'জামানত হারানো'র মতো ঝুঁকি নিয়েও নিশ্চয় সে ছবিতে তার টাকা খরচ করেন না। নিদেনপক্ষে পর্দায় তুলে দর্শকের সামনে ছবিটির একটা পরীক্ষা নিতেও নিশ্চয় তার একটা সর্বশেষ প্রচেষ্টা থাকে। কিন্তু ছবিটি কোনোদিনই পর্দায় উঠবে না এমন সম্ভাবনার আঁচ করে তো কেউ কখনো সিনেমা বানান না!
বাস্তবে ঢাকাই সিনেমায় এমন অভিজ্ঞতা বহু নির্মাতারই হয়েছে। যারা সিনেমা বানিয়ে সম্পূর্ণ করেছেন। পোস্ট প্রোডাকশনের কাজও সম্পূর্ণ করেছেন। কিন্তু সেই সিনেমা কখনই পর্দার রূপালি আলোয় ঝলমল করেনি। আবার অনেক সিনেমা আছে শুটিং শেষ করেছেন কিন্তু কোনো কারণে পোস্ট প্রোডাকশনের কাজ শুরু করতে পারেননি। আবার এমন সিনেমাও আছে শুটিংয়ের মাঝপথেই নির্মাতাকে রণে ভঙ্গ দিতে হয়েছে অনেক। আবার অনেক ক্ষেত্রে সিনেমার মহরত হয়েছে কিন্তু সে সিনেমার কাজই শুরু করা যায়নি।
যেমন চিত্রনায়িকা শাবানাকে মুসলিম নারী জাগরণের অগ্রদূত 'বেগম রোকেয়া' চরিত্রে দেখা যাচ্ছে শিগগিরই এমন একটি খবর চাউর হয়। শাবানাও অনেক স্বপ্ন নিয়ে মুখিয়ে ছিলেন এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রীয় নারী চরিত্রে অভিনয় করার জন্য। সেজন্য ঘটা করে এর মহরতও হলো। পরিচালনা করবেন ঢাকাই চলচ্চিত্রের প্রবাদপ্রতিম পুরুষ পরিচালক সুভাষ দত্ত। কিন্তু সে ছবির শুটিংই শুরু হয়নি। ঘটনাটি কুড়ি বছর আগের।
তখন তো এমন ছিল না যে ছবির বাজার ছিল না। তারপরেও কেন এমন হতো? এখন যেমন দেখা যায়, কোন ছবির কাজ শুরুর আগে অনেকেরই একটা সংশয় থাকে ছবিটি শেষপর্যন্ত পর্দায় দেখা দিবে তো! এমন পরিস্থিতিও তো তখন ছিল না তারপরেও কেন সুভাষ দত্ত সেই 'বেগম রোকেয়া' সিনেমাটি নির্মাণ করতে পারলেন না? এই যে ঘটা করে জমকালো আয়োজন, নায়ক-নায়িকা উপস্থিত করে প্রেস ব্রিফিং, বড় ব্যানার- সব কিছু নিয়েই আটকে আছে এ রকম 'বেগম রোকেয়া'র মতো অসংখ্য সিনেমা। শুটিং শুরু যেমন হয় না, তেমনি তা যায় না ডাবিং, এডিটিং তথা পোস্ট প্রোডাকশন হাউজ পর্যন্ত।
অথচ এসব প্রি-প্রোডাকশন অনুযায়ী অনেক ছবিরই যেমন তৈরি ছিল কোনো গল্প, লিখেছিলেন কোনো রাইটার, কলাকুশলীও ছিল সব ঠিকঠাক। কোনো ছবির গানও রেকর্ড করা হয়ে গেছে। রিলিজও করা হয়েছে। হয়েছে তার অ্যালবামও। কিন্তু সে সিনেমাটি উঠলো না রূপালি পর্দায়। কিংবা তার শুটিংও হলো না শুরু। কোনো ছবির দু'এক লট শুটিং করেই থেমে গেছে চিরতরে। যেমন, গাজী মাজহারুল আনোয়ারের কথায় এবং সত্য সাহার সুরে 'সালাম পৃথিবী তোমাকে সালাম/দুনিয়াকে করেছো টাকার গোলাম/নীল আকাশের নিচে আমি/চলি একা একা/টাকার দুনিয়ায় গড়েছো তুমি/হিসাবের নামে ফাকা।'- গানটি যখন প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী মাহমুদুন্নবীর কণ্ঠে পেস্ন-ব্যাক হিসেবে রিলিজ পায় তখন তা প্রচন্ড জনপ্রিয়তা পায়। মানুষের মুখে মুখে মুখরিত থাকে এ গান। কিন্তু যে সিনেমাটির জন্য রেকর্ড করা হয়েছিল এ গান সে সিনেমাটি কোনোদিনই রুপালি পর্দায় উঠতে পারেনি। হারিয়ে গেছে একেবারেই কালের অন্ধকারে।
এক শাকিব খানেরই আটকে আছে বেশ কিছু সিনেমা। মুক্তি পায়নি শুটিং শেষ হয়েও নূর হোসেন বলাই পরিচালিত 'অপমানের জ্বালা'। এছাড়া এম এ রহিম পরিচালিত 'রানা দ্য ফাইটার', মনতাজুর রহমান আকবর পরিচালিত 'মাই ডার্লিং'। জি সরকার পরিচালিত 'লাভ ২০১৪'। প্রায় ১২ বছর ধরে ক্যানবন্দি হয়ে আছে নজরুল ইসলাম খান পরিচালিত 'স্বপ্নের বিদেশ'। শাকিব-শাবনূর অভিনীত ছবিটি সেলুলয়েড যুগে শুরু। মৌসুমী, ফেরদৌস, শাকিব খান ও জনাকে নিয়ে 'চোখ যে মনের কথা বলে' কাজ অনেক দূর এগিয়েছিল।
তালিকায় থাকা এরকম আরও ছবি আছে। আবু সাঈদ খানের 'আসবো না ফিরে', সাজেদুর রহমান সাজু পরিচালিত 'অন্তরে প্রেমের আগুন', বি এইচ নিশানের 'মন যারে চায়', রানা হামিদের 'ছলনাময়ী নারী', জীবন রহমানের 'কাকনদাসী' ছবিগুলোর কোনো মুক্তির দেখা নেই। শান্তি চৌধুরী পরিচালিত 'মায়ানগর', দেওয়ান নাজমুল পরিচালিত 'নাকফুল', আজাদী হাসানাত ফিরোজ পরিচালিত 'প্রেমের নদী', বাবুল রেজা পরিচালিত 'নবীন কমিশনার' ছবিগুলো আটকে আছে। সরকারি অনুদানে করা ফারুক হোসেন পরিচালিত সিনেমা 'কাকতাড়ুয়া' মুক্তির তারিখ ঘোষণা দিয়েও শেষপর্যন্ত এটার আজও এটার মুক্তিই দেওয়া হলো না।
মান্নার আকস্মিক মৃতু্যতেও আটকে যায় বেশ কটি বিগ বাজেটের ছবি। যার মধ্যে জাহিদ হোসেনের 'লীলামন্থন' দীর্ঘদিন সেন্সর বোর্ড আটকে রাখে। পরে ছবিটির অনেক দৃশ্য কাটছাট করে এবং তার নাম পরিবর্তন করে 'জীবন যন্ত্রণা' নামে মুক্তির ঘোষণা দিয়েছিল গত বছর। নির্বাচনী পরিবেশের কারণে মুক্তি দেওয়া হয়নি। বলা হয়েছিল চলতি বছরের শুরুতেই মুক্তি দেওয়া হবে।
এম এম সরকার পরিচালিত 'বৃষ্টির চোখে আগুন' শেষ হয়নি। পরে পরিচালকও প্রয়াত হন। পরিচালক মতিউর রহমান বাদল ও আবিদ হাসান বাদলের মৃতু্যর কারণে আটকে গেছে 'জনতার ডাক' এবং 'পাগলের বিয়ে'। অনিমেষ আইচের পরিচালক হওয়ার কথা ছিল 'না মানুষ' ছবিতেই। মৌসুমী হামিদকে নিয়ে যাত্রা হয়েছিল এর। কিন্তু কিছুদিন শুটিংয়ের পর বন্ধ হয়ে যায়। আহমেদ নাসির পরিচালিত 'লাভ ইন কোরিয়া' বহু বছর ধরেই শুটিং অসমাপ্ত। নূর মোহাম্মদ মণি পরিচালিত 'কিস্তির জ্বালা' ৫ বছরেও শেষ হয়নি। গান রেকর্ডিং করেও তিন বছরে জাকির হোসেন রাজু কোনো কিনারা করতে পারেননি 'সোনার কাজল'র। শংখদাস গুপ্তের 'হ্যালো অমিত' শুটিং বন্ধ কয়েক বছর আগেই। আটকে যাওয়া ছবির তালিকায় আরও রয়েছে ছটকু আহমেদের 'তোমাকেই খুঁজছে বাংলাদেশ', এম এ রহিমের 'সুন্দরী গুলবাহার', মোহাম্মদ আসলামের 'ভালোবাসা ডটকম' ইত্যাদি ঘোষণা দিয়েও শুরু হয়নি 'মুসাফির টু'র কাজ। শফিকুল ইসনলাম ভৈরবী শেষ করতে পারেননি 'শুয়াচান পাখি', ডায়েল রহমানের ধরতে পারেননি 'দুদ মিয়া'। ঘোষণা দিয়েও পপিকে নিয়ে 'দেহ' বানাতে পারেননি সালমান হায়দার। জানা যায়, পপির কারণে তিন পরিচালক তাদের সিনেমার কাজ সম্পূর্ণ করতে পারছেন না। ওয়াজেদ আলী সুমন ব্যর্থ হয়েছেন শুভ-পরীকে নিয়ে 'দরদিয়া' বানাতে। বাপ্পি-তানহাকে নিয়েও পারেননি 'জানবাজ' শুরু করতে। শাহিন সুমনের 'প্রবাসী ডন' আটকে। আশিকুর রহমান পারেননি 'ম্যাডাম ফুলি টু' বানাতে। পড়ে আছে বেঘোরে 'নূরজাহানের প্রেম', প্রয়াত এনায়েত করিমের 'বউ পাগল', রেজা পরিচালিত 'কেন আমি সন্ত্রাসী', এমএ আউয়াল পিন্টুর 'কালো বিড়াল' ও 'তুষের আগুন', মাসুম পারভেজ রবেলের 'লড়াকু সন্তান', আইনুলের 'সাহসী কন্যা' ইত্যাদি। মোহাম্মদ হোসেন প্রযোজিত পরিচালিত 'নষ্ট ছেলে'র মতো অশ্লীলতা যুগের আরো কিছু ছবি কোনদিন মুক্তি পাবে না।
এগুলোর বাইরে অনুদান পাওয়া ডজনখানেক ছবি মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। অনুদানের সিনেমা 'হাডসনের বন্ধুক', 'যৈবতী কন্যার মন' কবে শেষ হবে তা অনিশ্চিত।
এ রকম নামসর্বস্ব আরও যেসব সিনেমা রয়েছে সেগুলোর মধ্যে আছে 'প্রজন্ম এক্স', 'মারুফ টাকা ধরে না', 'নষ্ট হওয়ার কষ্ট', 'আলস্নাহ রাখলে মারে কে', 'চাইলাম যারে পাইলাম তারে', 'মন যারে চায়', 'প্রিয়তমা আমি দাড়ি তুমি কমা', 'কেন আমি আসামি', 'বিচার আমি করব', 'কালো বিড়াল', জলে ভাসা পদ্ম, আমার পিরানের কোনো মাপ নাই, 'মধুর জীবন', 'বিন্দু বিন্দু ভালোবাসা', 'স্বজনহারা', 'ভালো লাগার চেয়ে একটু বেশি', 'ভালোবাসা ছাড়া কেউ কি বাঁচে', 'প্রিয়া শুধু আমার', 'অনেক দৃষ্টি কেড়ে তুমি এলে', 'নীলাঞ্জনা', 'টাকার খেলা', 'অসম প্রেম'সহ আরও অসংখ্য সিনেমা।