ভালো গানের জন্য দীর্ঘ অপেক্ষা
প্রকাশ | ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
বর্তমানে গান শোনার চেয়ে বেশি তার পারফর্মিং কেমন সেটাই প্রধান হয়ে উঠেছে। একটা সময়ে যখন টিভি বা সিনেমার পর্দা ছিল না তখন মানুষ কান দিয়েই গান শুনতো। চোখ দিয়েও দেখত যখন সেটা কোনো আসরে বা মঞ্চে গাওয়া হতো। তবে মানুষ শুরুতে গান দেখা ও শোনা দুটোরই সাক্ষী ছিল। যখন গান রেকর্ড করার বিভিন্ন মাধ্যমগুলো দেখা দেয়নি। সর্বপ্রথম গান শোনার জন্য আসে গ্রামোফোন রেকর্ড। এরপর ক্যাসেট ও সিডি। পাশাপাশি উন্মুক্ত আসর বা মঞ্চ তো সবসময়েই ছিল। যেখানে মানুষ গান শোনার পাশাপাশি কে গাইছে, কারা কেমন বাদ্য বাজাচ্ছে সবই দেখতে পেত। তবে গ্রামোফোন রেকর্ড, ক্যাসেট, সিডি বা সিনেমার পর্দার ক্ষেত্রে গান শোনার ব্যাপারটি একেবারেই আলাদা। এখানে কে গাইছে, কারা বাদ্যযন্ত্র শিল্পী কিছুই দেখা যায় না। একসময় বহু গায়ক, গায়িকা যাদের মানুষ সারাজীবনেও দেখেনি। কিন্তু তাদের কণ্ঠ সারাজীবন শুনে আসছে।
সেই গানের মানুষগুলোর সঙ্গে তখন মানুষের যতটা ভালোবাসা ছিল বর্তমানে তার সিঁকি ভাগও নেই। মঞ্চে যাদের নিয়ে উন্মাদনা আছে তাদের গস্নামার আছে বলেই, কণ্ঠের কারণে নয়। এ জন্যই উন্মুক্ত আসরে তাদের ডাক পড়ে না- যাদের গস্নামার ফুরিয়ে গেছে। তারা ডাক পাচ্ছেন কম। তাদের নিয়ে মিউজিক ভিডিও হয় না। পেস্ন-ব্যাকেও ডাক পড়ে না। যদিও এখানে শিল্পীকে নায়ক-নায়িকার মতো সরাসরি উপস্থিত থাকতে না। তারপরেও তার ডাক পড়ে না কেন? শিল্পী বুড়ো হওয়ার কারণে নায়ক-নায়িকার ঠোঁটে গান শুনে সিনেমার দর্শক কান বন্ধ করে রাখবে?
ফলে সব মাধ্যমেই দিনকে দিন ভালো গানের সংখ্যা যেমন কমছে তেমন বাড়ছে চকটধারী ভাইরাল গানের সংখ্যাই শুধু। কারণ ভাইরাল গানের জন্য ভালো শ্রোতার দরকার নেই। ভালো শিক্ষারও দরকার নেই।
এ জন্য প্রখ্যাত নজরুলসঙ্গীত শিল্পী ফাতেমা তুজ জোহরা বলেন, 'আমরা তো বুড়ো হয়ে গেছি। তাই এখন আমাদের কেউ আর ডাকে না। আমাদের তো কোনো আপ-ডাউন নেই- তাই না! যেমন আছি তেমনই আছি। এখন তো নতুনদের সময়। নতুনদের সময়ে নতুনদেরই জয়জয়কার। তো, আমরা যেখানে থাকার সেখানেই আছি। আমাদেরকে যেখানে দরকার সেখানেই আমরা আছি।'
একইভাবে এমন কথা প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী খুরশীদ আলমও বলেন। তিনি বলেন, 'ওরা আমাদের গান ব্যবহার করে না। ওরা নতুনদের ব্যবহার করে। সবক্ষেত্রেই এমনটা হয়। আপনি পঞ্চাশ পার হলেন দেখবেন, আপনি ক্রসের খাতায় পড়ে যাচ্ছেন। এটাই আজকের বাস্তবতা। ঐসব অডিও, ভিডিও, রেডিও চ্লচ্চিত্র- সবই তেমনি। তারা আমাদের ব্যবহার করবে না। আমাদের এখানে হচ্ছে, আপনি নবীন থেকে প্রবীণে গেলেন- মাইনাস হয়ে গেলেন।'
এটা যে একজন শিল্পীর জন্য কীরকম বেদনার- তা একজন শিল্পী ছাড়া কে বুঝবে? এখানে ফাতেমা তুজ জোহরা বা খুরশীদ আলম অকপট বলেই কোনো রাখঢাক না রেখে কথাটি সরাসরি বলে ফেললেন। কিন্তু বেশির ভাগ শিল্পীই আছেন যারা ইনিয়ে-বিনিয়ে অন্য কথা বলেন। আসল বাস্তব সত্যটি বলতে যেন লজ্জা পান।
গানের পতনের শুরুটা হয় মূলত মিউজিক ভিডিও দিয়ে। এরপর এই পতনকে আরও গভীরে নিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছে টিকটকসহ নানান সোশ্যাল মিডিয়া। আজকের প্রজন্মের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হয়ে উঠেছে এই টিকটক। কারণ একে ব্যবহার করে অতি সহজেই নিজেকে লাখো মানুষের সামনে উপস্থাপন করা যাচ্ছে। একসময় অশ্লীল সিনেমায় মেয়েদের সহজ উপস্থাপন নিয়ে মানুষ ধারণা করতো তারা হয়তো টাকার অভাবে এমনটি করছে। কিন্তু ব্যাপারটি যে অত সহজ নয়, সেটা টিকটক পরিষ্কার করে দিয়েছে। এখানে টিকটকে যেসব মেয়েরা নিজেদের অতি সস্তাভাবে এবং অশ্লীলতার চরমসীমা লঙ্ঘন করা অবস্থায় উপস্থাপন করছে সেটাও কি টাকার অভাবে? এ জন্য আরেক কণ্ঠশিল্পী ফাহমিদা নবী বলেন, 'একজন অডিয়েন্স হিসেবে বলতে পারি, যে যা-ই করুক তাতে তার মনের প্রকাশটিই ঘটে। তখন অবশ্য তাতে একটা জিনিস ধরা পড়ে- তার মনে কে কোন জিনিস ধারণ করে। কার কেমন অভিরুচি, কে কেমন মানসিকতার। এই ওটিটির মধ্যদিয়ে বরং পরিষ্কার হয়ে গেছে কারা কোনো মানসিকতার, যারা করছে তারা তো বটেই যারা দেখছে- তাদেরও। কারণ, যারা দেখছে সেই 'ভিউ' হিসাবে তাদের নামও কিন্তু সেখানে শো করছে। আর এতেই পরিষ্কার হয়ে পড়ে এই সমাজটি আসলে কোন জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে।'
তার মানে এই অশ্লীল গানের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন সবাইকে টেক্কা দিচ্ছেন গানের নারী শিল্পীরা অন্যদিকে তাদের দর্শক ও শ্রোতা হিসেবে থাকা অসংখ্য মানুষ- এই উভয়ে মিলেই প্রধান প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছে একটি ভালো গানের পক্ষে। আর এভাবেই দিনকে দিন ভালো গানের সংখ্যা কমতির দিকে যাচ্ছে।
গানের মান বর্তমানে অত্যন্ত নীচে নামার কারণই হচ্ছে এখন প্রত্যেকেই এক একটি স্বাধীন স্টুডিও। নিজেই নিজের স্বাধীনতা ঘোষণাকারী। ফাহমিদা নবীর ভাষায় যেমন সমাজ তেমনই ব্যক্তি। ব্যক্তি স্বাধীনতা। কিন্তু এই সমাজেরই অনেকে যেখন বলছে, এখন কোনো ভালো গান হচ্ছে না- সেটা জানার পরও কেন সে এই গানগুলো শুনছে? এরই জবানে পপশিল্পী ফেরদৌস ওয়াহিদ বলেন, 'আসলে মানুষের মধ্যে যারা শ্রোতা হিসেবে আছেন তাদেরও এখন যুগের কারণে গান শোনারও আগের মতো সেই ধৈর্য্য নাই। আবার আগের মতো মনে ধাক্কা দেওয়ার মতো সুরও হচ্ছে কম। সবমিলিয়েই মানুষ এখন গান শোনার নামে মূলত সময় পার করছে। গানগুলোও হচ্ছে শ্রোতাদের শুধু সময় পার করানোর জন্য। মনকে টানার মতো সুর হচ্ছে না। সুর তো সবই। কিন্তু এই সুর তো ধাক্কা দিতে পারছে না।'
এই 'যুগের কারণে' তার এখন ভালো গান শোনারও ধৈর্য্য নেই তখন সে ওই সস্তা মিউজিক ভিডিও তো এমনই হবে যা দেখার জন্য কোনো ধৈর্য্যেরও দরকার নেই। খুবই শর্ট টাইমের ভিডিও। কয়েক সেকেন্ডেরও উত্তেজক ভিডিও আছে। অতটুকু দেখার ধৈর্য্য থাকলেই যথেষ্ট। ফলে এমন ভূঁইফুঁড় চিত্র নির্মাতারও অভাব নেই এখন। মাত্র ২০-২৫ হাজার টাকা খরচ করেই তৈরি করা যাচ্ছে একটি গানের মিউজিক ভিডিও। টিকটক তো পয়সা ছাড়াই হয় এমন। এরকম সহজলভ্য এ মিউজিক ভিডিওর বাজার থেকে কী আর ভালো গান প্রত্যাশা করা যেতে পারে?