এবার একুশে পদকের ঘোষণায় সবচেয়ে বেশি সম্মানিত করা হয়েছে শোবিজের লোকদের। বাংলাদেশের ইতিহাসেই এবারই প্রথম যে শিল্প-সাহিত্য, ভাষা আন্দোলন প্রভৃতির ক্ষেত্রে এবার শোবিজের লোকদেরই বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আর এই মনোনয়নের মধ্য দিয়ে পরিষ্কার হয়ে গেল দেশের শিল্প-সাহিত্যের গুরুত্ব ক্রমশ তলানিতে এসে ঠেকছে। যেখানে এখন কোনো গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে না যে কারণে তারা একুশে পদকের মতো সম্মানজনক পদকে ভূষিত হতে পারেন। নিঃসন্দেহে সরকারের এ উদ্যোগ দেশের শিল্পীদের মনে বড়ো অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
একটা সময় ছিল যখন দেশের চলচ্চিত্রে, নাটকে, গানে, গানের নানা শাখায় অনেক বড় বড় মাপের প্রতিভা এসেছে, কিন্তু তখন তাদের অনেককেই এই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়নি। তাদের অনেককেই এই না পাওয়ার বেদনা নিয়ে পৃথিবী ছাড়তে হয়েছে। এই পুরস্কার না পাওয়া নিয়ে তাদের অনেকেরই একটা আক্ষেপও ছিল। এবার যেভাবে সরকার শিল্পীদের মূল্যায়ন করেছে এটা নিশ্চয় এ দেশের শোবিজের জন্য ইতিবাচক হয়ে থাকবে।
এবারের একুশে পদকে শিল্পীদের মধ্যে যেমন মরণোত্তর রয়েছে তেমন বর্তমান শিল্পীরাও আছেন। তবে নিশ্চয় কোনো শিল্পীই চান না তাকে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়া হোক। এ ব্যাপারে বিশিষ্ট অভিনয় শিল্পী এবং আবৃত্তিকার জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায় যায়যায়দিনকে দেওয়া গত বছর আবৃত্তির জন্য তার একুশে পদ প্রাপ্তির অনুভূতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন, 'যে কোনো প্রাপ্তিই তো ভালো লাগার কথা। সবচেয়ে ভালো লাগছে জীবদ্দশায় পুরস্কারটি পেয়েছি, এটাই ভাবতে ভালো লাগছে। অন্তত মরনোত্তর পুরস্কার যে পাইনি এতেই খুব ভালো লাগছে। খুবই বড় একটি স্বীকৃতি। এ তো আমার কর্মের জন্যই স্বীকৃতি। খবরটি জানার পর থেকেই একটা সুন্দর অনুভূতি কাজ করছে আমার মনে।'
এবার সেরকমই জীবদ্দশাতেই যে শিল্পীদের নামে একুশে পদক প্রদানের বিষয়টি ঘোষণায় এসেছে তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছেন অভিনয়ে ডলি জহুর, এম এ আলমগীর, গানে শুভ্র দেব ও নৃত্যকলায় শিবলী মহম্মদ। দেশের শিল্পাঙ্গনে তাদের সবাই-ই অত্যন্ত সুপরিচিত এবং নিঃসন্দেহে তারা তাদের যোগ্য সম্মান পেয়েছেন। ডলি জহুর গত বছরই বাংলাদেশ চলচ্চিত্র পুরস্কার কমিটির জুরিবোর্ড কর্তৃক আজীবন সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সেবার তার ওই সম্মাননা প্রদান নিয়ে অনেক জল ঘোলা করা হয়েছিল। বিতর্ক হয়েছিল অনেক। ফেসবুকে এ নিয়ে অনেকেই অনেক কটাক্ষসহ বিরূপ মন্তব্য করেছেন। কিন্তু ডলি জহুর এ নিয়ে কোনো দুঃখ বা খেদ প্রকাশ করেননি। বরং বলেছেন একটি দেশের সবারই যার যার অবস্থান থেকে যে কোনো প্রতিক্রিয়া জানানো গণতান্ত্রিক অধিকার রয়েছে। তবে এবারে তার আরও বড় পুরস্কার প্রাপ্তিতে নিঃসন্দেহে সেই বিরোধিতাকারীদের আর কিছুই বলার থাকবে না।
প্রতি বছরের মতো এবারও 'একুশে পদক-২০২৪' এর জন্য মনোনীতদের নামের তালিকা প্রকাশ করেছে সরকার। ভাষা আন্দোলন, শিল্পকলা, ভাষা ও সাহিত্যসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ২১ বিশিষ্ট নাগরিক এই পদক পেতে যাচ্ছেন। মঙ্গলবার সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
একুশে পদক ঘোষণায় এবারের তাৎপর্য হলো এই ২১ জনের মধ্যে শুধু শিল্পকলা থেকেই এ সম্মাননা পাচ্ছেন ১২ জন শিল্পী। এরমধ্যে রয়েছেন সংগীতের জন্য জালাল উদ্দীন খাঁ (মরণোত্তর), বীর মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণী ঘোষ, বিদিত লাল দাস (মরণোত্তর), এন্ড্রু কিশোর (মরণোত্তর) ও শুভ্র দেব। নৃত্যকলায় শিবলী মহম্মদ। অভিনয়ে ডলি জহুর ও এম এ আলমগীর। আবৃত্তিতে খান মো. মুস্তফা ওয়ালীদ (শিমুল মুস্তাফা) ও রূপা চক্রবর্তী। চিত্রকলায় শাহজাহান আহমেদ বিকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ ও আর্কাইভিংয়ের জন্য কাওসার চৌধুরী।
এরমধ্যে এমন সুখবরে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় অভিনেত্রী ডলি জহুর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বলেন, 'আমি নিয়মিত চেকআপের জন্য এখন হাসপাতালে এসেছি। খবরটা পেয়ে ভালো লাগছে। কয়েকদিন আগে অনেকেই বলাবলি করছিল, আমার নাকি একুশে পদক পাওয়া উচিত। আমি তখন তাদের বলেছি, 'এসব পুরস্কারের প্রতি আমার কোনো লোভলালসা নেই। তবে আজ (মঙ্গলবার) সত্যি সত্যি পুরস্কারের কথা শুনে অবাক হয়েছি।'
থামলেন না আবেগাপস্নুত কিংবদন্তি বললেন, 'তবে আমি সবসময়ই বলতাম এবং আজও বলছি, আমার চেয়ে দেশে আরও অনেক গুণী মানুষ আছেন। তাদেরও এই সম্মাননা পাওয়া উচিত।'
এদিকে সংগীতের জন্য মনোনীত সংগীতশিল্পী শুভ্র দেবের প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি তুলে ধরেন নিজের বর্ণাঢ্য সংগীত ক্যারিয়ারের কথা। বিশেষ করে প্রেমের গানের বাইরেও স্পোর্টস এবং সামাজিক কর্মকান্ডে তার গানের রেশ ছড়িয়ে দেওয়ার বিষয়টি। তিনি মনে করেন, তারই স্বীকৃতি মিলেছে এই একুশে পদক প্রাপ্তির মাধ্যমে।
শুভ্র দেব বলেন, 'অ্যাকচুয়ালি আমি তো শুধু গানের অ্যালবামই করিনি, প্রচুর কাজ করেছি। ক্রিকেটের থিম সং থেকে শুরু করে দেশের সর্বাধিক স্পোর্টস রিলেটেড থিম সং আমার করা। এর বাইরে সামাজিক অনেক ইভেন্ট বা প্রজেক্টেরও গান করেছি। আজ (মঙ্গলবার) সন্ধ্যায় একুশে পদক প্রাপ্তির চূড়ান্ত খবর পেয়ে ভালো লেগেছে। এটা তো আসলে বড় একটা অর্জন। আমি আরও আনন্দিত, আমার সঙ্গে আমাদেরই সিলেটের বিদিত লাল সেন মরণোত্তর হলেও পুরস্কারটি পেয়েছেন। এটা ওনার প্রাপ্য ছিল।'
এদিকে আবৃত্তিতে এই সম্মাননা পাচ্ছেন দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় বাচিকশিল্পী শিমুল মুস্তাফা। প্রথমত তিনি খুব করেই বললেন, পদক হাতে প্রাপ্তির আগে তিনি এ বিষয়ে কোনো প্রতিক্রিয়া দেবেন না। কারণ, মন্ত্রণালয় থেকে তাকে বারণ করা আছে। তবে কিছু না বলেও এটুকু বললেন, 'দেখুন, এটা তো আমার জন্য সবচেয়ে আনন্দের ও বড় প্রাপ্তি। সেটা যে কারোর জন্যই সম্ভবত। আমিও তার বাইরে নই। খবরটি পেয়ে খুশি লাগছে। এই প্রাপ্তিতে আমি কৃতজ্ঞতা জানাই মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।'
'একুশে পদক-২০২৪'-এর জন্য মনোনীত অন্যদের মধ্যে রয়েছেন ভাষা আন্দোলনে মৌ. আশরাফুদ্দীন আহমদ (মরণোত্তর) ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হাতেম আলী মিয়া (মরণোত্তর)। সমাজসেবায় মো. জিয়াউল হক ও আলহাজ রফিক আহামদ। ভাষা ও সাহিত্যে মুহাম্মদ সামাদ, লুৎফর রহমান রিটন, মিনার মনসুর ও রুদ্র মুহাম্মদ শহিদুলস্নাহ (মরণোত্তর)। আর শিক্ষায় অধ্যাপক ডক্টর জিনবোধি ভিক্ষু একুশে পদক পেতে যাচ্ছেন। তাদের সবাইকে ১৮ ক্যারেট স্বর্ণের তৈরী ৩৫ গ্রাম ওজনের একটি করে পদক, দুই লাখ টাকা, একটি সম্মাননা পত্র ও একটি রেপিস্নকা দেওয়া হবে।