নাচে ও গানে শিল্পীদের বসন্ত বরণ

প্রকাশ | ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০

বিনোদন রিপোর্ট
বকুলতলায় আবিরের ঢালি হাতে এক নারী
'ফুল না ফুটুক আজ বসন্ত'- এই চিরায়ত পংক্তিটির রচয়িতা কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সেই চিরাচরিত দখিনা বাতাস, নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় দরজায় কড়া নাড়ছে বসন্ত। গতকাল ছিল পয়লা ফাল্গুন উপলক্ষে বসন্তবরণ উৎসব। এ উদ্দেশে আগে থেকেই ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করতে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি। বসন্তের ছোঁয়ায় আড়মোড়া ভেঙেছে প্রকৃতি। ছিল নাতিশীতোঞ্চ মিহি বাতাস। মহাসমারোহে নগরজুড়ে চলেছে বসন্তবরণ। বসন্ত বন্দনায় মেতেছে কংক্রিটের নগরও। শহুরে ব্যস্ততায় থেমে থাকেনি উৎসবের আমেজ। পাবলিক ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা এই দিন সবাই নানা রঙের বাহারি শাড়ি পরে মাথায় গাঁদা আর ডালিয়া ফুল গুঁজে ঘুরে বেড়িয়েছে। বুধবার সকাল থেকে রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় শুরু হয়েছে বসন্তউৎসব। এই উৎসবের প্রধান আকর্ষণ ছিল- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার বকুলতলা। বরেণ্য যন্ত্রশিল্পী সেতারবাদক ও বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সহকারী পরিচালক জ্যোতি বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেতারে রাগ বসন্ত মুখারী বাদনের মধ্য দিয়ে ঋতুরাজ বসন্তকে বরণ করে নেওয়ার আনুষ্ঠানিকতা। সকাল ৭-১৫ মিনিটে শুরু হয় বসন্তউৎসব-১৪৩০। যাতে 'জাতীয় বসন্তউৎসব উদ্‌যাপন পরিষদ' এই অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। উৎসব ঘিরে সকাল থেকেই বকুলতলায় তরুণ-তরুণী থেকে শুরু করে সব বয়সি মানুষের ভিড়। সবাই মেতেছে বসন্ত আমেজে। 'এসো মিলি প্রাণের উৎসবে' গানে বসন্ত বরণে মেতে ওঠে সবাই। এরপর শুরু হয় বসন্তকথন পর্ব, প্রীতি বন্ধনী বিনিময়, আবির বিনিময়। এদিন রমনা পার্কে ২২৫ জন নৃত্যশিল্পীর পরিবেশনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বসন্তবরণের আয়োজন। এরপর রমনার শতায়ু অঙ্গনের পাশে মঞ্চে পরিবেশিত হয় শিশু-নৃত্যদল এবং শিশুসঙ্গীত দলের পরিবেশনা। সকাল ১০টায় 'বসন্ত-আনন্দ শোভাযাত্রা' বের করা হয়। চারুকলা থেকে শুরু হয়ে টিএসসি ঘুরে আবারও চারুকলায় ফিরে আসে শোভাযাত্রাটি। বসন্তকথন পর্বে সভাপতিত্ব করেন- পরিষদের সভাপতি স্থপতি সফিউদ্দিন আহমদ। বক্তব্য রাখেন- সহ-সভাপতি কাজল দেবনাথ ও সাধারণ সম্পাদক মানজার চৌধুরীসহ অন্যরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী সঞ্চিতা শর্মা। এখন একটি করপোরেট চাকরি এবং সংসার দুটিই একসঙ্গে সামলান। তিনি এসেছেন দুই সন্তানকে নিয়ে বকুলতলায় বসন্তবরণ উৎসবে। নিজে পরেছেন বাসন্তী রঙের শাড়ি। দুই ছেলেকেও বাসন্তী রঙের জামায় সাজিয়ে নিয়ে এসেছেন। জানতে চাইলে সঞ্চিতা বলেন, যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তাম, তখন পহেলা ফাল্গুন, পহেলা বৈশাখের দিনগুলোর জন্য আমরা অপেক্ষা করে থাকতাম। আগের রাতে ঘুমে যাওয়ার আগে মনে মনে পরিকল্পনা সাজাতাম, ভোরবেলা উঠে কী করব, কোথায় কোথায় যাব। কোন রঙের শাড়িটা পরব, কীভাবে সাজব- এ নিয়ে কতশত ব্যস্ততা। বকুলতলায় আড্ডায় মেতেছেন তিতুমির সরকারি কলেজের কয়েকজন ছাত্রী। তারা সবাই একসঙ্গে এসেছেন। রেহানা নামে তাদের একজন বলেন, 'ভোরে-ভোরে এসে পড়েছি। রাস্তা ফাঁকা থাকায় বেশ ভালোও লাগছিল। সারা দিনের পরিকল্পনা করে ঘুরে বেড়িয়েছি। বিকালে বইমেলায় ঢুকব।' এদিকে, দুপুরে কিছুটা বিরতি দিয়ে বকুলতলায় বিকালের পর্ব শুরু হয় সাড়ে ৩টায়। বেঙ্গল পরম্পরার যন্ত্রসঙ্গীত পরিবেশনের মধ্য দিয়ে বিকালের পর্বে মেতে উঠে উৎসবপ্রেমীরা। এই পর্বে শিশু-কিশোর ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর পরিবেশনা, দলীয় সঙ্গীত, আবৃত্তির পাশাপাশি বরেণ্য শিল্পীদের জমজমাট একক পরিবেশনাও থাকে। শুধু চারুকলার বকুলতলা, টিএসসি নয়, রমনা পার্ক, হাতিরঝিলসহ নগরীর বিভিন্ন বিনোদনকেন্দ্রেও বাসন্তী সাজে তরুণ-তরুণীদের সরব উপস্থিতি ছিল চোখে পড়ার মতো। পাঁচ তারকা হোটেল, ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা রেস্তোরাঁয়ও বসন্ত-ভালোবাসা দিবস ঘিরে নানা আয়োজন করা হয়েছে। অন্যদিকে, প্রতি বছরের মতো এবারও রমনা পার্কে শিল্পকলা একাডেমির উদ্যোগে পালিত হয় বসন্তউৎসব। এ দিন বর্ণাঢ্য এই আয়োজনে প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন- গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রী র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী এবং বিশেষ অতিথি হিসেবে সংস্কৃতি সচিব খলিল আহমদ। স্বাগত বক্তব্য প্রদান করেন- বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির সচিব সালাহউদ্দিন আহাম্মদ, সভাপতিত্ব করেন- বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকী। এরপর বিকাল ৪টায় বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয় রমনা পার্ক থেকে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রাঙ্গণে। বিকালের আয়োজনে ৪-৩০ মিনিটে অনুষ্ঠিত হয় বসন্ত নৃত্য। এরপর বিকাল ৫টায় অনুষ্ঠিত হয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। উন্মুক্ত মঞ্চের এই আয়োজনের শুরুতেই পরিবেশিত হয় দলীয় নৃত্য 'ঢাক নৃত্য'। পরিবেশনা করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি উদীয়মনা নৃত্যদল। এরপর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি নৃত্যদল পরিবেশন করে দলীয় নৃত্য 'শুভেচ্ছা ও ভালোবাসা'। এ ছাড়া দলীয় সঙ্গীত 'আনন্দ লোকে' পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি শিশুসঙ্গীত দল। দ্বৈত আবৃত্তি 'রুমঝুমকে বাজায়' পরিবেশন করবেন ডালিয়া আহমেদ ও জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়। একক সঙ্গীত 'যেথা রামধনু উঠে হেসে' পরিবেশনা করেন মেহরিন মাহমুদ। এরপর দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন নওশিন তাবাসসুম স্মরণ এবং মোমিন বিশ্বাস। ধারাবাহিক পরিবেশনায় ছিল দলীয় নৃত্য 'সুন্দরের অত্যন্দ্র প্রহরী' পরিবেশন করে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি শিশু নৃত্য দল। এরপর দ্বৈত নৃত্য 'আজি দক্ষিণ পবনে' পরিবেশন করেন আবু নাইম এবং আনন্দিতা খান। দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন সারমিন সাথী ইসলাম এবং বুলবুল ইসলাম। এরপর আবার দলীয় সঙ্গীত 'মন শুধু মন ছুয়েছে' পরিবেশন করে ঢাকা সাংস্কৃতিক দল। দ্বৈত আবৃত্তি করেন- তামান্না তিথি ও মাহিদূল ইসলাম। দলীয় নৃত্য 'বসন্ত মুখর আজি'/ 'নীল দিগন্তে' পরিবেশন করে রেওয়াজ পারফর্মার্স স্কুল। এতে নৃত্য পরিচালনা করেছেন মুনমুন আহমেদ। দ্বৈত নৃত্য 'বিশ্ববীণা রবে/আজু সখি' পরিবেশন করেন সামিনা হোসেন এবং মাহতাব মেহেদী। এরপর একক সঙ্গীত 'চেনা চেনা লাগে' পরিবেশন করেন মো. ইউসুফ আহমেদ খান। দ্বৈত সঙ্গীত পরিবেশন করেন কিরণ চন্দ্র রায় এবং চন্দনা মজুমদার। দ্বৈত নৃত্য 'ফাগুন লেগেছে শাখে শাখে' পরিবেশন করেন জুয়েইরিয়াহ মৌলি এবং মারিয়া ফারিহ উপমা। এরপর দলীয় ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠী নৃত্য পরিবেশন করে তপস্যা নৃত্যদল। পরিচালনা করেছেন- নৃত্য পরিচালক ফিফা চাকমা। দ্বৈত আবৃত্তি করেন- শিমুল মোস্তফা এবং রুপা চক্রবর্তী। দ্বৈত নৃত্য 'একটুকু ছোঁয়া লাগে' পরিবেশন করেন অনিক বোস এবং কস্তুরী মুখার্জী। এরপর দলীয় নৃত্য 'অবাক চোখে' পরিবেশন করেন কথক নৃত্য সম্প্রদায়। নৃত্য পরিচালনা করেছেন নৃত্য পরিচালক সাজু আহমেদ। এরপর আবার পরিবেশিত হয় দ্বৈত নৃত্য 'বাগিচায় বুলবুলি'- পরিবেশনা করেন আরোহী ইসলাম (আরিফুল ইসলাম অর্ণব) এবং হেনা হোসেন। সবশেষ বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নৃত্যদলের অংশগ্রহণে পরিবেশিত হয় ফ্যাশন ডান্স প্যারেড। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন- সঙ্গীতা চৌধুরী এবং আব্দুলস্নাহ বিপস্নব।