গত দুই-আড়াই দশক ধরে দেশের সিনেমাকে একটা অস্থির সময়ের মধ্য দিয়ে পার হয়ে আসতে হয়েছে। ষাট দশক হতে নব্বই দশক পর্যন্ত যে ঢাকাই সিনেমা সমান্তরালভাবে এগিয়েছে- বিনোদন দিয়েছে দেশের অসংখ্য দর্শককে সেটা হঠাৎ করেই যেন কোনো চোরাবালিতে আটকে পড়ে গিয়েছিল। যারা সিনিয়র নির্মাতা ছিলেন তারাও যেন একই গল্পের চোরাবালিতে আটকা পড়ে গিয়েছিলেন। এ থেকে রেহাই পেতে হাত বাড়িয়েছিলেন প্রতিবেশী দেশ টলিউড-বলিউড সিনেমার দিকে। দিচ্ছিল একের পর এক নকলের হাতছানি আর রিমেক সিনেমা বানানোর হিড়িক। কিন্তু যে সিনেমা দর্শক আগেই দেখে নিয়েছিলে ভিডিও ক্যাসেটের সুবাদে তার কপি কেন দেখবে দর্শক? কাজেই বেশিদিন টিকল না সেই নকলের কাজকারবার।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য এরপর এলেন ঢাকাই সিনেমায় বেশ কিছু উদ্যমী নির্মাতা। যারা শুরুতে এফডিসি'র বাইরে থেকে সিনেমা বানাতেন। যারা চলচ্চিত্র বিষয়ে আগে পড়াশোনা করেছেন। কীভাবে একটি সিনেমা ভালো হতে পারে। কেমন গল্প হলে, কেমন লোকেশন হলে, কেমন কারিগরি দক্ষতা থাকলে একটি সিনেমা চোখের জন্য আরামদায়ক হতে পারে সেই শিক্ষা তারা হাতে-কলমেই নিলেন। অভিজ্ঞতা সীমিত হলেও ভেবেছেন অনেক বড় কিছু করার বিষয় নিয়ে। এই তাদের বেশির ভাগই শুরুটা করেন নাটক নির্মাণের মধ্য দিয়ে। নাটক ও সিনেমা দুটো দুই মাধ্যম। পার্থক্যও আকাশ-পাতাল তফাৎ। সিনেমা হলো অনেক বড় ক্যানভাসের ওপর বানানো ফিচার। এর ওপর হাত দিতে হলে অনেক সাহসেরও প্রয়োজন আছে। কিন্তু তাদের অনেকেই সেই ভয়কে জয় করছেন।
টিভির অভিনয় শিল্পীরা সংখ্যায় কম হলেও শুরু থেকেই সিনেমায় অভিনয় করছিলেন। অনেকেই সাফল্যের পরিচয় দিয়েছেন। তবে চলচ্চিত্র নির্মাণে টিভি নির্মাতারা ঝুঁকেন অনেকটা বিলম্বেই। আগে ছোট পর্দা এবং বড় পর্দা- এই দুই অঙ্গনের যেসব শিল্পী-কলাকুশলী, নির্মাতারা ছিলেন তারা দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা হিসেবেই নিজেদের পরিচয় ধরে রাখতেন। তেলে ও জলে এক না হওয়ার মতোই ছিল যেন বিষয়টি। কারণ, টিভি নাটক বানানো যতটা সহজ চলচ্চিত্র ততটা সহজ ছিল না। সেই সময় এখন অতীত। গত দুই দশকে প্রযুক্তিগত সুবিধা অনেক সহজ হওয়ায় ছোট পর্দার নির্মাতারাও ব্যাপক হারে সিনেমায় ঝুঁকতে শুরু করেন। এখন যিনি নাটক বানান তিনি সিনেমাও বানান। যিনি রাঁধতে জানেন তিনি চুলও বাঁধতে জানেন- এরকম। দুটোই সমান তালে চালাচ্ছেন। শুধু তাই নয়, যারা মূলধারার সিনেমা নির্মাতা, অবস্থাবিশেষে ছোট পর্দার নির্মাতারা তাদের চেয়েও অনেক বেশি মুন্সিয়ানার পরিচয় দিচ্ছেন। সম্প্রতি তাদের হাত ধরে সিনেমা এতটা ভালো হচ্ছে, অনেকেই ঢাকাই সিনেমার সোনালি অতীত ফেরানোর স্বপ্নও দেখা শুরু করে দিয়েছেন।
যেমন বিগত দুই দশকে তাদের এমন কিছু সিনেমা নির্মাতা হিসেবে এসেছেন যারা একদিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আরেক দিকে জাতীয় পর্যায়েও নানা পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। পুরস্কার না জুটলেও দর্শক ও সমালোচকমহলে প্রশংসিত হয়েছেন। তাদের মধ্যে একেবারে প্রথম দিকে যারা আসেন তাদের অন্যতম আবদুলস্নাহ আল মামুন। তখন টিভি থেকে সিনেমায় খুব কম নির্মাতাই
যেতেন।
বরেণ্য
কথাসাহিত্যিক ও নাট্যকার হূমায়ুন আহমেদ আসেন নব্বই দশকে। মূলত হুমায়ূন আহমেদের আগমনের পর থেকেই ছোট পর্দার নির্মাতাদের ব্যাপক হারে বড় পর্দায় আসা শুরু। তাদের মধ্যে আছেন- গাজী রাকায়েত, সালাহউদ্দিন লাভলু, নাদের চৌধুরী, নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চু, জাহিদুর রহিম অঞ্জন, সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড, এস এ হক অলীক, হাবিবুল ইসলাম হাবিব, তানিয়া আহমেদ, আলভী আহমেদ, চয়নিকা চৌধুরী, নারগিস আক্তার, আরমান পারভেজ মুরাদ, অমিতাভ রেজা চৌধুরী, মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী, তানিম রহমান অংশু, শিহাব শাহীন, তৌকীর আহমেদ, অঞ্জন আইচ, অনিমেষ আইচ, নুরুল ইসলাম আতিক, অমিতাভ রেজা, গিয়াসউদ্দিন সেলিম প্রমুখ।
টিভি নাটক নির্মাতা হিসেবে হূমায়ুন আহমেদ অনেক খন্ড নাটক ও ধারাবাহিকে সাফল্য পেয়েছেন। 'আগুনের পরশমণি' চলচ্চিত্রটি আটটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। সালাহউদ্দিন লাভলু প্রথমেই দর্শকের নজরে আসেন তার অভিনয় নৈপুণ্যের জন্য। এরপর হাত দেন নাটক, ধারাবাহিক ও টেলিফিল্ম নির্মাণে। এখানেও নিজের প্রতিভার পরিচয় তুলে ধরতে সমর্থ হন তিনি। 'মোলস্না বাড়ির বৌ' নামের তার একমাত্র সিনেমাটিও ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। নাদের চৌধুরীর টিভিতে 'বারো রকম মানুষ' নামের সিরিয়ালে লজিং মাস্টার চরিত্রে জনপ্রিয়তা পান। বেশকিছু নাটক নির্মাণের পর 'মেয়েটি এখন কোথায় যাবে' নামের চলচ্চিত্র করে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। গিয়াস উদ্দিন সেলিমও ছিলেন ছোট পর্দার নির্মাতা। ২০০৯ সালে তার 'মনপুরা' তো দেশীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসেই মাইল ফলক হয়ে আছে। চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র ও চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। গাজী রাকায়েত হোসেনের মঞ্চ ও টিভি নাটকে অভিনয় দিয়ে শুরু। তারপর নাটক নির্দেশনার কাজ। এরপরে হাত দেন চলচ্চিত্রে। জাতীয় পর্যায় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক পর্যায়েও অনেক সম্মান বয়ে এনেছেন এই কুশলী নির্মাতা। তার 'মৃত্তিকা মায়া' এবং 'গোর' চলচ্চিত্র দুটো যথাক্রমে ছয়টি ও এগারোটি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। নাট্যনির্মাতা সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড এখন নিয়মিতই সিনেমা বানাচ্ছেন। তার 'গঙ্গাযাত্রা' জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। 'অন্তর্ধান' তার উলেস্নখযোগ্য চলচ্চিত্রকর্ম। মোস্তফা সরওয়ার ফারুকীও শুরু করেন বিজ্ঞাপন, নাটক দিয়ে। শুরুতেই ভিন্নধারার কাজ দিয়ে চমক দেন। পরবর্তীতে এই চমক ধরে রাখেন চলচ্চিত্রেও। জাহিদুর রহিম অঞ্জন তার প্রথম সিনেমা 'মেঘমলস্নার' দিয়ে বাজিমাত করেন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করে। তৌকীর আহমেদ জনপ্রিয় মঞ্চ ও টিভি অভিনেতা। তারপর হাত পাকান নাটক নির্মাণে। ২০০৪ সালে 'জয়যাত্রা' সিনেমা নির্মাণ দিয়ে যাত্রা করলেন। প্রথম সিনেমাতেই জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। টিভিসি ও টিভি নাটক নির্মাতা হিসেবে পরিচিত অমিতাভ রেজা চৌধুরী এক 'আয়নাবাজি' দিয়েই ঢাকাই চলচ্চিত্রে নিয়ে এসেছেন ভিন্নতার স্বাদ। পেয়েছেন ব্যবসায়িক সাফল্যসহ প্রচুর দর্শকপ্রিয়তা। তানিম রহমান অংশু 'ন ডরাই' চলচ্চিত্র নির্মাণ করে শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। নাট্যনির্মাতা চয়নিকা চৌধুরীর প্রথম সিনেমা 'বিশ্বসুন্দরী'তেই বাজিমাত। ২০তম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ৮টি বিভাগে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন তিনি। হাবিবুল ইসলাম হাবিব টিভি নাটক নির্মাণ দিয়ে শুরু করেন। এরপর তার প্রথম সিনেমা 'রাত্রীর যাত্রী'তেই পান প্রশংসা। সম্প্রতি নতুন একটি চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান পেয়েছেন।
এভাবে দেখা যাচ্ছে মূলধারার নির্মাতারাই নয় বরং মূলধারার বাইরের নির্মাতারাই এখন দেশীয় চলচ্চিত্রের কান্ডারির ভূমিকায়। তাদের হাতেই দেশীয় চলচ্চিত্রের আগামী ভবিষ্যৎ। যে মূলধারার নির্মাতারা দেশীয় চলচ্চিত্রে পচন ধরিয়েছিলেন সেই পচন থেকে পুনরুজ্জীবনের কাজটিই যেন করে যাচ্ছেন ছোট পর্দার নির্মাতারা।