বিশ্বে সব বড় বড় বাজেটের যেসব সিনেমা হয়েছে তার মধ্যে ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর সিনেমাও উলেস্নখযোগ্য। এই ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর শুধু সিনেমাই নয়, নাটক-টেলিফিল্মও হয়েছে প্রচুর। বাংলাদেশেও ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর সিনেমা হয়েছে। তার কোনোটি বড় সাফল্য পেলেও গড়পড়তা হিসেবে তাকে ফ্লপই বলতে হবে। তার একটি বড় কারণ বাংলাদেশে ঐতিহাসিক চরিত্রের ওপর যেসব সিনেমা হয় তার বেশির ভাগই কম বাজেটের সিনেমা। ফলে যখন দেখা গেল এ সিনেমা তেমন দর্শক টানতে পারছে না তখন একপর্যায়ে নির্মাতারা সেই ঐতিহাসিক সিনেমা বানানো ছেড়ে দিলেন।
তবে সম্প্রতি আবার দেশীয় চলচ্চিত্রে নতুন একটা ট্রেন্ড বা ঝোঁক চলছে। সেটা হলো ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' জীবনীমূলক পস্নট নিয়ে সিনেমা বানানো। এগুলো আবার বাস্তব প্রেক্ষাপটের ওপরই নির্মিত হচ্ছে। একসময়ে যেসব ঐতিহাসিক গল্পের ওপর সিনেমা বানানো হতো সেগুলোতে আবার রূপকথার আঁচও লাগানো হতো। এখনকার সিনেমা সেই ট্রেন্ড থেকে সরে এসে বাস্তবের মাটিতে পা রাখতে শুরু করেছে। সেরকমই একটি সিনেমা 'কাজল-রেখা' মুক্তি দিতে যাচ্ছেন 'মনপুরা'খ্যাত পরিচালক গিয়াস উদ্দিন সেলিম। ছবিটির একটি অন্যতম মুখ্য চরিত্র হিসেবে অভিনয় করছেন মন্দিরা চক্রবর্তী।
এ রকম ট্রেন্ডের একটি সিনেমা 'রূপবান' যেটি নির্মাণের পর আকাশ-ছোয়া জনপ্রিয়তা পায়। এরপর এ রকম লোক-ঐতিহাসিক গল্পের ওপর সিনেমা বানানোর একটা হিড়িক পড়ে গিয়েছিল তখন। এরপর তো ১৯৬৭ সালে ঐতিহাসিক পস্নট নিয়ে বানানো 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' দারুণভাবে লুফে নেন দর্শক। উৎসাহিত হয়ে পরের বছরই নিয়ে আসেন ইবনে মিজান 'শহীদ তিতুমীর'।
এখন রাজনৈতিক ঐতিহাসিক বা লোক-ঐতিহাসিক 'সিগনিফিকেন্ট' চরিত্রমূলক যেসব সিনেমা বানানো হচ্ছে তার বেশির ভাগই সরকারি অনুদানে। এর মধ্যে আবার বেশির ভাগ মুক্তিযুদ্ধ ও বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে।
পাশাপাশি বিস্মৃত সময়ের 'সিগনিফিকেন্ট' চরিত্রের ওপরও হচ্ছে। যেমন 'প্রীতিলতা', 'তিতুমীর' প্রভৃতি। ঐতিহাসিক পস্নটের ওপর এ পর্যন্ত যত সিনেমা হয়েছে ব্যবসায়িকভাবে সবচেয়ে বেশি সফল 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা'। কেন্দ্রীয় চরিত্রে কিংবদন্তী অভিনেতা আনোয়ার হোসেন। এই একটি সিনেমাতে অভিনয় করেই চিরকালীন অমর হয়ে আছেন তিনি। অন্যদিকে 'আলেয়া' চরিত্রে আনোয়ারার অভিনয় আজও দেশের চলচ্চিত্রে অদ্বিতীয় হয়ে আছে। ষাট ও সত্তর দশকে বানানো ঐতিহাসিক ও 'সিগনিফিকেন্ট' পটভূমিকায় আরও সিনেমা- 'শহীদ তিতুমীর', 'রাজা সন্নাসী', 'ভাওয়াল সন্নাসী', 'গাজী কালু চম্পাবতী', 'বাহরাম বাদশাহ', 'নিমাই সন্যাসী', 'লালন ফকির', 'ঈশা খাঁ' প্রভৃতি।
তবে আমাদের এখানে ঐতিহাসিক চরিত্র বলতে সবই যেন বোঝানো হয়ে থাকে এগুলোকে রাজনৈতিক হতে হবে। অথচ প্রতিবেশী দেশ ভারতে এর বাইরেও ঐতিহাসিক চরিত্র নির্ভর সিনেমা হচ্ছে। সেগুলো আবার বিশাল বাজেটেরও। আমাদেরও এ রকম অনেক ঐতিহাসিক গল্প বা জীবনী রয়েছে। এগুলো সিনেমায় রূপ দিলে ভালো হবে, অনেকেই মনে করেন। তবে তারা এটাও মনে করেন, দেশের মানুষ এগুলোর সঙ্গে বংশপরম্পরায় পরিচিত কাজেই এটা নির্মাতাদের দায়বদ্ধতা নিয়েই করতে হবে। কারণ দেখা গেছে, ঐতিহাসিক বা জীবনীমূলক সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকাদের তুলনায় বিশিষ্ট চরিত্রাভিনেতা-চরিত্রাভিনেত্রীরাই ভালো করছেন। প্রকৃষ্ট উদাহরণ আনোয়ার হোসেন ও আনোয়ারা।
যারা জনপ্রিয় এবং শুধুমাত্র 'নায়ক-নায়িকা' হিসেবেই পারফর্ম করেন, পাশাপাশি চরিত্রাভিনয় করেন না- তারা এই চ্যালেঞ্জে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অসফল হন। এর কারণ হয়ত তাদের মাথায় নিজেদের অগুনতি দর্শকের চিন্তা প্রতিক্রিয়াশীল থাকে। তখন এ ধরনের চরিত্রে সেই চাপটা নিতে ব্যর্থ হন। 'ওভার অ্যাকটিং' করে ফেলেন। তবে এটা নির্মাতার নির্দেশনাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কীভাবে নির্দেশনা দিচ্ছেন, কি রকম পারফর্ম চাচ্ছেন, সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। এ প্রসঙ্গে তরুণ প্রজন্মের এক তারকা অভিনেতা বাপ্পী চৌধুরী বলেন, 'সারা দেশের মানুষই আমাকে 'নায়ক' হিসেবে চিনে। শাকিবকে চিনে, আরিফিন শুভকে চিনে। বিষয়টা আমাদের মাথায় থাকে। না জানি কেমন হয়, এমন একটা মানসিক চাপ থাকে।'
সেক্ষেত্রে চরিত্রাভিনেতারা অনেকটা নির্ভার থাকেন। চাপমুক্তভাবে অভিনয় করতে পারেন। জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকারা ব্যবহৃত হন শুধুমাত্র ব্যবসায়ের জন্যই। এখন কোন ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' সিনেমা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক লক্ষ্যেই বানালে নির্মাতা সেকরকম অভিনেতা-অভিনেত্রীই চাইবেন।
ব্যবসায়ের জন্যই সব সিনেমা বানানো হয়। তবে ঐতিহাসিক বা 'সিগনিফিকেন্ট' সিনেমা শুধুমাত্র ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যই নয় তাতে একটা দায়বদ্ধতাও থাকা দরকার। কারণ এগুলোর সঙ্গে দর্শক শুধু জন্ম থেকেই নয় বা বংশপরম্পরায়ও পরিচিত। তখন পান থেকে চুন খসলেই বিপদ।
এ বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে, ছয়বার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত বিশিষ্ট অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদ বলেন, 'এক্ষেত্রে আমি বুঝি ভালো অভিনেতা এবং খারাপ অভিনেতা। সেক্ষেত্রে পরিচালকের ওপর নির্ভর করে তিনি কি বানাচ্ছেন, কীভাবে বানাবেন। সেখানে কোন চরিত্রে কাকে পারফেক্ট মনে করবেন। আর এটা কি সবসময়েই হয়? কখনো পপুলার নায়কও তো ভালো করেন। এক্ষেত্রে নির্মাতা চরিত্র অনুযায়ী যাকে মানানসই মনে করবেন তাকেই নেবেন। আমি এটাই বুঝি।'
তাহলে এ ধরনের চলচ্চিত্রে এমনকি সামাজিক চলচ্চিত্রেও জনপ্রিয় তারকাদের তুলনায় চরিত্রাভিনেতারাই কেন সবচেয়ে বেশি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ নানা পুরস্কার লাভ করছেন? সে তুলনায় জনপ্রিয় এবং শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা হিসেবে পারফর্ম করা অভিনেতারা কেন পিছিয়ে? অনেকে দু'চারশ' সিনেমায় অভিনয়ের অভিজ্ঞতা থাকলেও এক্ষেত্রে কেন ব্যর্থ হচ্ছেন? সফল হলে কিন্তু বড় পুরস্কারের স্বীকৃতি মিলত। অথচ চরিত্রাভিনেতারা ১০-২০টি সিনেমা করার অভিজ্ঞতাতেই একাধিক জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আরও অন্যান্য অনেক পুরস্কার পাচ্ছেন। সন্দেহ নেই এতে নির্দেশকের কৃতিত্বই বেশি। কারণ গল্প অনুযায়ী তিনি সঠিক চরিত্র নির্বাচন করতে পেরেছেন। এরকম অভিনেতা হিসেবে সবচেয়ে এগিয়ে আছেন, রাইসুল ইসলাম আসাদ। অভিনয় করেছেন ২২টি চলচ্চিত্রে। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছেন ৬ বার। এ ছাড়া তারিক আনাম খান সিনেমা করেছেন ২৪টি। জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছে দু'বার। বুলবুল আহমেদ তার সময়ে যতটা না জনপ্রিয় নায়ক ছিলেন তারচেয়ে বেশি ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেতাই। তিনি জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পেয়েছে চারবার। এটিএম শামসুজ্জামান (ছয় বার), আনোয়ার হোসেন (দু'বার), আনোয়ারা (আট বার), হুমায়ুন ফরিদী (একবার) চঞ্চল চৌধুরী (দু'বার), জাহিদ হাসান (একবার), আরমান পারভেজ মুরাদ (১বার)।
এক্ষেত্রেও রাইসুল ইসলাম আসাদ পরিচালকদের কৃতিত্বকেই বড় মনে করেন। একটি সিনেমা কিরকম হবে না হবে সবটাই পরিচালকের ওপর নির্ভর করে। তার মানে, সেক্ষেত্রে সিনেমার ক্যাটেগরি অনুযায়ীই নির্মাতাদের চরিত্র নির্বাচন করতে হবে। শুধুমাত্র জনপ্রিয় নায়ক-নায়িকা করে ব্যবসায়িক চিন্তা করলেই হবে না। একজন ভালো নির্মাতা ব্যবসায়িক সাফল্য যেমন চান পাশাপাশি বড় পুরস্কার পেলে নিজের যোগ্যতা নিয়েও অনেকটা নিঃসন্দেহ থাকেন। এ জন্য জনপ্রিয় এবং শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা নয় সিনেমাটির সাফল্যের জন্য তাকে এর মধ্যদিয়ে ভাল চরিত্রাভিনেতাও সৃষ্টি করতে হবে। যেভাবে আনোয়ার হোসেন, আনোয়ারা তৈরি হয়েছিলেন। তখন ঐতিহাসিক 'সিগনিফিকেন্ট' চরিত্রটির প্রতিও সঠিক সম্মান দেওয়া হবে।