রোববার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

অনুদানের সিনেমা নিয়ে নয়-ছয়

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
আজ মুক্তি পাচ্ছে নুরুল আলম আতিক পরিচালিত পেয়ারা সুভাস। ছবিটির একটি দৃশ্যে সদ্য প্রয়াত আহমেদ রুবেল

রুচিশীল চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য অর্থাভাবে থাকা চলচ্চিত্র প্রযোজক ও নির্মাতাদের প্রেরণা দিতেই দেওয়া হয় সরকারি অনুদান। এই অনুদানের বরাদ্দ অর্থ নিয়েও হয় নানা রকমের নয় ছয়। কেউ কেউ ফ্ল্যাট ও জমি কিনে ফেলেছেন এই অর্থ দিয়ে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বরাদ্দ করা অর্থ নেওয়ার পর সময়মতো সিনেমার কাজ শেষ না করায় বেশ কয়েকজন প্রযোজক ও নির্মাতার বিরুদ্ধে মামলাও করেছে তথ্য মন্ত্রণালয়। গত কয়েক বছর ধরে এই অনুদান দেওয়া নিয়ে উঠছে নানা প্রশ্ন আর বিতর্ক।

২০২০-২১, ২০২১-২০২২ বা ২০২২-২৩ অর্থবছরে যেসব পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের জন্য অনুদান দেওয়া হয়েছে তার অনেকগুলোই নিয়ম ভেঙে অনুদান দেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ আছে নির্মাতা ও প্রযোজকদের। অভিযোগ রয়েছে- সিনেমা নির্মাণের জন্য এমন মানুষ অনুদান পান, যাদের অর্থের অভাব নেই। আবার পরিচালনায় পূর্ব অভিজ্ঞতা নেই, এমন পরিচালকও অনুদান পান।

সরেজমিন খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অনুদান পাওয়া কিছু সিনেমার কাজ শুরুই করতে পারেননি প্রযোজক ও নির্মাতারা। এই তালিকায় রয়েছে জয়া আহসানের 'রইদ', নইম ইমতিয়াজ নেয়ামুলের 'সাড়ে তিন হাত ভূমি' ও রকিবুল হাসান চৌধুরীর 'দাওয়াল'সহ আরও কয়েকটি নির্মিতব্য সিনেমার নাম। অনুদানের নীতিমালায় বলা হয়েছে, প্রায় ২০টি হলে সিনেমা মুক্তি দিতে হবে। কিন্তু দেখা গেছে অধিকাংশ অনুদানের সিনেমাই তার চেয়ে অনেক কম সিনেমা হলে মুক্তি দেওয়া হচ্ছে।

অনুদানের সিনেমার নির্মাণকাজ বছরের পর বছর আটকে থাকে- এ প্রসঙ্গে প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি খোরশেদ আলম খসরু বলেন, 'আমি নিজেও অনুদান পেয়ে, সময়মতো ছবি নির্মাণ করে মুক্তি দিয়েছি। আমার ছবিটি দেশের পাশাপাশি বিদেশেও মুক্তি পেয়েছে। আমি কিন্তু ইন্টারভিউ দিয়ে অনুদান পেয়েছি। অনুদানের টাকা দিয়ে সম্পূর্ণ সিনেমা শেষ করা যায় না। এ কারণে প্রযোজক অনেক সময় মাঝপথে এসে আটকে যান। আমি মনে করি, যিনি ইনভেস্ট করতে পারবেন, তিনিই অনুদান পাওয়ার যোগ্য। এর বাইরের কাউকে অনুদান দিতে হলে অনেক ভেবেচিন্তে দিতে হবে।'

সরকারি অনুদানের এই প্রকল্পটি যখন শুরু হয়েছিল তখন থেকে বেশ কয়েক বছর কত ভালো ভালো সিনেমাই না বানানো হয়েছিল। যারা বানিয়েছিলেন প্রায় সবাই ছিলেন উচ্চ প্রশিক্ষিত। কিন্তু বিগত ১৫/২০ বছর ধরে যেভাবে এই সরকারি অনুদানকে অপব্যবহার করা হচ্ছে অদূর ভবিষ্যতে এই অনুদান প্রকল্পটি টিকবেই কিনা এ নিয়ে ঘোরতর সন্দেহ রয়েছে।

সরকারি অনুদানে নির্মিত হয়েছিল 'সূর্য দীঘল বাড়ি' এবং 'এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী'র মতো কালজয়ী চলচ্চিত্র। সৈয়দ সালাউদ্দিন জাকী বানিয়েছিলেন 'ঘুড্ডি' সিনেমা। কিন্তু গত দশ বছরে কালজয়ী কোনো গল্পের সিনেমা দেখা যায়নি। চলচ্চিত্র নির্মাতা ও অভিনেতা কাজী হায়াৎ এ বিষয়ে বলেন, 'কোনো সময়ই অনুদানের সিনেমা দেখতে উপচেপড়া ভিড় দেখা যায়নি। যুগে যুগে ভালো সিনেমাগুলো দর্শক গ্রহণ করেনি। মাঝেমধ্যে একটি লেগে যায়। তবে ভালো কিছু সিনেমা তৈরি হয়।'

২০২১-২২ অর্থবছরের অনুদান কমিটির এক সদস্য নির্মাতা মতিন রহমান বলেন, 'আমাদের কাজ হলো অনুদানের নীতিমালা অনুসরণ করে গল্প দেখা। গল্পে অসামঞ্জস্য কোনো কিছু থাকলে, তা সংশোধন করতে বলি। এরপর কাজ নেই। বাকি কাজটা মন্ত্রণালয় করে থাকে।'

অনুদানের বাছাই কমিটির এক সদস্য চলচ্চিত্র গবেষক অনুপম হায়াৎ বলেন, 'আমাদের কাজ হলো গল্প পড়ে মূল্যায়ন করা। প্রত্যেক সদস্যের মূল্যায়নের ওপর অনুদান কমিটি সিনেমা নির্বাচন করে।'

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নির্মাতা এ প্রতিবেদককে বলেন, 'তদবির এবং রাজনৈতিক বিবেচনায় অপেশাদাররাও প্রতি বছর অনুদান পান। এতে সরকারের অর্থ অপচয় হচ্ছে।' বছরের পর বছর যে সিনেমাগুলো আটকে আছে ২০০৭-০৮ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া এনামুল করিম নির্ঝরের 'নমুনা' সিনেমাটি সেন্সর বোর্ডে আটকে আছে। গত ১০ বছরে অনুদান পাওয়া বেশিরভাগ সিনেমা সময়মতো মুক্তি পায়নি। কোনো কোনো সিনেমা নির্মাণে চার থেকে পাঁচ বছরও সময় লেগেছে। এমনকি কেউ কেউ সিনেমা শেষই করতে পারছেন না। আবার অনেকে সিনেমা শেষ করে নানা কারণে মুক্তি দিতে পারছেন না।

২০১০-১১ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছয় ছবির মধ্যে আলোর মুখ দেখেনি ফারুক হোসেনের 'কাকতাড়ুয়া'। ২০১১-১২ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত ছয় ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি। এর মধ্যে সৈয়দ সালাউদ্দীন জাকি 'একা একা' ছবির অর্থ ফেরত দিয়েছেন। অন্যদিকে মারুফ হাসানের 'নেকড়ে অরণ্য' ছবির প্রযোজকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে ও প্রশান্ত অধিকারীর 'হাডসনের বন্দুক' সিনেমার কাজ শেষ হলেও মুক্তি পায়নি। ২০১২-১৩ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে আলোর মুখ দেখেছে পাঁচটি। নির্মাতা তারেক মাসুদের মৃতু্যর পর অনুদানপ্রাপ্ত 'কাগজের ফুল' ছবির কাজ থমকে গেছে।

২০১৩-১৪ অর্থবছরের অনুদানপ্রাপ্ত সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে ৫টি মুক্তি পেলেও জাঁনেসার ওসমানের 'পঞ্চসঙ্গী' সিনেমার কোনো খবর নেই। একইভাবে আলোর মুখ দেখেনি ড্যানি সিডাকের 'কাঁসার থালায় রুপালি চাঁদ' সিনেমাটি। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে অনুদান পাওয়া ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবির মধ্যে মুক্তি পেয়েছে মাত্র তিনটি। সারা আফরীন প্রযোজিত কামার আহমাদ সাইমন নির্মিত 'শঙ্খধ্বনি' থেকে নাম পরিবর্তিত 'শিকলবাহা' ছবির কাজ শেষ হলেও মুক্তি পায়নি। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে অনুদানপ্রাপ্ত পাঁচটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের মধ্যে মুক্তি পেয়েছে দুটি ছবি। এ ছাড়া শবনম ফেরদৌসীর 'আজব সুন্দর' ছবির কাজ শেষ কিন্তু মুক্তি পায়নি। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে স্বল্পদৈর্ঘ্য ও পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র মিলিয়ে ১৪টি ছবিকে অনুদান দেওয়া হয়। পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র শাখার ৯ ছবির মধ্যে কাহিনিচিত্রের সঙ্গে একটি শিশুতোষ ও দুটি প্রামাণ্যচিত্র রয়েছে। পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবিগুলোর মধ্যে রয়েছে সারাহ বেগম কবরীর 'এই তুমি সেই তুমি'। কবরীর মৃতু্যর পর ছবিটির দায়িত্ব নিয়েছেন অভিনেত্রীর ছেলে। এখনও মুক্তি পায়নি হোসেন মোবারক রুমীর 'অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া' ও আকরাম খানের 'নকশি কাঁথার জমিন'। একই শাখায় শিশুতোষ চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে আবু রায়হান মো. জুয়েলের 'নসু ডাকাত কুপোকাত' এবং দুটি প্রামাণ্যচিত্র হলো হুমায়রা বিলকিসের 'বিলকিস এবং বিলকিস' ও পূরবী মতিনের 'মেলাঘর'।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে