গত এক দশক ধরে গোটা পৃথিবীজুড়েই বড়সড় একটা পরিবর্তন এসে গেছে প্রযুক্তিতে। রেডিও, টিভি, সিডি-ক্যাসেট পেস্নয়ার, সিনেমায় যা হয়নি, গুগল, ইন্টারনেট, ফেসবুকে যা হয়নি- তার সবকিছুকেই ছাড়িয়ে গেছে ইউটিউব। এ পর্যন্ত ঘটা পৃথিবীর ইতিহাসে যত পরিবর্তন এসেছে তার মধ্যে সবচেয়ে বড় যুগান্তকারী পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছে ইউটিউব। বাংলাদেশেও এর ঢেউ গত চার-পাঁচ বছরে বেশ ভালোমতোই পড়েছে।
টেলিভিশন এবং সিনেমার পাশাপাশি মানুষ এখন সবচেয়ে বেশি আগ্রহী ইউটিউবের প্রতি। কারণ নিজেদের সময়, পারিপার্শ্বিক অবস্থা এবং ব্যক্তিগত চাহিদার স্বাধীনতা অনুযায়ী যে কোনো বিষয় দেখার সুযোগ আছে ইউটিউবে। যে সুযোগ অন্য কোনো মাধ্যমেই নেই। এই শর্টকাট বা সহজ সুযোগ কাজে লাগিয়েই অনেকে বেপরোয়াভাবে যার যেমন ইচ্ছা নিজেরাই ভিডিও তৈরি করে ইউটিউবে ছেড়ে দিচ্ছেন। সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে অনলাইনের যেখানে-সেখানে ঢুঁ মারছেন। কন্টেন্টের প্রতি প্রলুব্ধ বা উৎসাহী করছেন। যার যেমন তারকা মূল্য ও তার প্রকাশের অভিনবত্ব সে অনুযায়ী জোগাড় হচ্ছে এসব সাবস্ক্রাইবার। আবার এই সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে কেউ এমন সব মাথা গরম করা ছবি বা কন্টেন্ট আপলোড করছেন যাতে তার সাইটে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। কোটি কোটি মানুষ সেটা দেখছেন, লাইক, কমেন্টস পড়ছে লাখ লাখ। এভাবে তারা রাতারাতি বনে যাচ্ছেন ইউটিউব স্টার।
তবে সব কন্টেন্টই মানুষকে প্রলুব্ধ করার জন্য, এমন নয়। এখানে অসংখ্য স্বচ্ছ বিনোদনমূলক বা শিক্ষামূলক কন্টেন্টও অনেকে ব্যবহার করেন।
তবে কথায় বলে, 'এক মণ দুধের মধ্যে এক ফোঁটা চুনা ফেললে পুরো দুধটাই নষ্ট হয়ে যায়।' আজকে বেপরোয়া ইউটিউব যেন তেমনটাই হয়ে উঠেছে। যেখানে ভিউ বাণিজ্য আর ট্রেন্ডিংয়ে অশ্লীলতার জোয়ার বইছে।
যারা এসব কন্টেন্ট তৈরি করেন তাদের অনেকে আছেন শুধু শখের বসে করছেন। অনেকের আবার পেশাই এটা। আর সেই পেশাদার ইউটিউবারদের মধ্যে যার চ্যানেলে যত বেশি সাবস্ক্রাইবার থাকবে সে হিসেবে ইউটিউব কর্তৃপক্ষের সঙ্গে তাদের অর্থের চুক্তি হবে। সেজন্যও তারাও যথেচ্ছ সাবস্ক্রাইবার বাড়াতে অস্বচ্ছতারও আশ্রয় নিয়ে থাকেন। লাইক, কমেন্টসে-এও অস্বচ্ছতার আশ্রয় নিয়ে থাকেন।
মানুষের চারটি মৌলিক চাহিদা মিটলেই যে জিনিসটাকে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় সেটা বিনোদন। তবে এসব কন্টেন্ট দেখে মানুষ বিনোদিত হলেও কিছু কন্টেন্ট আছে যা দেখে মানুষ তীব্র প্রতিক্রিয়াও করে থাকেন। আর ওইসব ভিডিওর নিচের কমেন্টগুলো দেখলেই সেটা স্পষ্ট হয়।
ইউটিউবে অন্যান্য বাণিজ্যিক বা আদর্শিক সাইট নিয়েও যেমন অভিযোগ আছে তেমনি বিনোদনকে কেন্দ্র করেও দেশের জনসাধারণে বিস্তর অভিযোগ আছে। প্রথম অভিযোগ হচ্ছে, ব্যাপক অশ্লীলতা ও নোংরামির ছড়াছড়ি। তারপর সমাজের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, অশ্রদ্ধা ও সহিংসতা ছড়িয়ে দেওয়া বিষয়ক কন্টেন্ট। এজন্য দেশের জনসাধারণ তো আছেই, শোবিজের বিশিষ্ট শিল্পী ও নির্মতারাও চাচ্ছেন এ ব্যাপারে একটা সরকারি নীতিমালা ও আইনের স্বচ্ছ প্রয়োগ হোক। কিন্তু এগুলো নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারিভাবে কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো পর্যবেক্ষণও নেই। অথচ অন্যান্য সাইট নিয়ে গুরুতর অভিযোগের ক্ষেত্রে কিন্তু সরকারিভাবে ঠিকই ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সিনেমা হোক আর ইউটিউবই হোক বিনোদনও অন্যান্য বিষয়ের মতোই বাণিজ্যিক। আবার আদর্শিকও। কিন্তু এটা কীভাবে করা হচ্ছে, তাতে কোনো স্বচ্ছতা আছে কিনা, নীতিমালা আছে কিনা, দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি ও জনস্বার্থের উপযোগী কিনা- এজন্য সরকারি পর্যবেক্ষণ থাকবে না? যেমন, অন্যান্য বাণিজ্যের ক্ষেত্রে আছে?
ইউটিউবের বিনোদন বিষয়ক কন্টেন্টের ওপর সরকারি আইন, নীতিমালা ও পর্যবেক্ষণ ইত্যাদি থাকা উচিত কিনা- এ নিয়ে কথা হয় শোবিজের বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে।
ডিরেক্টরস গিল্ডের সভাপতি সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, 'হঁ্যা, ইউটিউবটা আসলে এত উন্মুক্ত হয়ে পড়েছে যে, বেপরোয়াভাবে যে যা ইচ্ছা বানাচ্ছে, আপলোড করছে। ব্যাপারটা সুখের নয়, ভালো লাগার নয়। এ ব্যাপারে আমি যতদূর জানি, সরকারও বিষয়টি নিয়ে চিন্তাভাবনা করছে। একটা পর্যবেক্ষণ বা আইনের আওতায় আনতে বিষয়টি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছে। আমি মনে করি, ইউটিউবে এমন অনেক কন্টেন্ট আছে যেটা দর্শক মেনে নিতে পারছেন না। আসলে এরকম কন্টেন্ট কিছুতেই ছাড়া উচিত নয়।'
অন্যদিকে বিশিষ্ট ব্যান্ডসঙ্গীত শিল্পী শাফিন আহমেদ সঙ্গীতের ক্ষেত্রে বলেন শুধু ইউটিউব নির্ভর গান হওয়াকে দুঃখজনক বলেছেন। পেস্ন-ব্যাক সম্রাজ্ঞী সাবিনা ইয়াসমিন তো ইউটিউবকে বাংলা গানের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকারক মনে করেন।
এদিকে বিশিষ্ট অভিনেতা, অভিনয় শিল্পী সংঘের সাধারণ সম্পাদক আহসান হাবিব নাসিম বলেন, ইউটিউবে যেসমস্ত কন্টেন্ট আপলোড করা হচ্ছে সে সম্পর্কিত সরকারের একটা পর্যবেক্ষক কমিটি থাকা আবশ্যক। বাংলাদেশে তো এটার ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণই নেই। যদিও কোনো নিয়ন্ত্রণ শিল্পের জন্য সুখকর নয়। তারপরও একটা ভালোমন্দ আছে। কাজেই এখানেও একটা জবাবদিহিতা থাকা উচিত। নীতিমালা থাকা দরকার। যাতে শিল্পের স্বাধীনতার নামে বেপরোয়া স্বেচ্ছাচারিতার প্রকাশ না ঘটে। সেজন্য ইউটিউবেও একটা সেল্ফ সেন্সরশিপ থাকা দরকার।'
কিন্তু সেল্ফ সেন্সরশিপটাই বা কী করে হবে এ নিয়েও তাদের কাছে কোনো পরিষ্কার ব্যাখ্যা নেই। সেল্ফ সেন্সরশিপ তো হবে একেকজনের কাছে একেক রকম। এদের সবাই যে একই দৃষ্টিভঙ্গির হবে এমনো নয়। শুধু তাই নয়, এক যৌনতা সম্পর্কেই একেকজনের দৃষ্টিভঙ্গি একেক রকম। সেখানে সেল্ফ সেন্সরশিপটাই বা কী রকম হবে। সেক্ষেত্রে সরকারের একজন নীতিনির্ধারক জানিয়েছিলেন 'সরকার এমন কিছু প্রযুক্তি আনতে যাচ্ছে, যেটা থেকে শনাক্ত করা যাবে- কে কোথায়, কী ধরনের ভিডিও আপলোড হয়েছে, কারা এসবের পেছনে জড়িত। আমাদের নিরাপদ থাকার জন্য যেসব ব্যবস্থা গ্রহণ করা দরকার, সেসব ব্যবস্থা আমরা নেব।'
আবার দেখা গেছে সরকারের তরফ থেকে চলচ্চিত্রে যে সেন্সরশিপ আরোপ করা হয় তার মধ্যেও অনেক ঘাপলা রয়ে গেছে। অনেক সিনেমাই তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে সমর্থন না থাকায় সেন্সরছাড়পত্র পায়নি। এ নিয়েও হয়েছে অনেক সমালোচনা। পরে সমালোচনার জেরে কোনো কোনো সিনেমা আবার ছাড়পত্রও দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, একেক সরকারের একেক দৃষ্টিভঙ্গিও থাকে এখানে। আর তাতেও যে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন সম্পূর্ণরূপে ঘটে এমনও নয়।
তাহলে দেখাই যাচ্ছে, ইউটিউব এখন এরকম নানা মুনীর নানা মতের সুযোগে তারা যা-ইচ্ছা তা করার নরকরাজ্য বানিয়ে ফেলছে ইউটিউবকে কেন্দ্র করে।