যতই দিন কঠিন হয়ে আসছে আর সেই কঠিন সময়েই নিজেকে প্রমাণ করার জন্য এগিয়ে আসছে নারী। অথচ দিন যখন অনেক সহজ ছিল তখন শুধু চলচ্চিত্রই নয়, জীবনের সব সেক্টরেই এগিয়ে ছিল পুরুষরা। এটা সেই সময়ের চিত্র যখন কোনো সেক্টরেই নারীদের সুযোগ ছিল না। প্রয়োজনও ছিল না হয়তো। এখন প্রতিটি সেক্টরেই সময়টা বদলেছে। এগিয়ে আসছে প্রায় প্রতিটি সেক্টরেই নারীরা।
ঢাকাই চলচ্চিত্রেও এই চিত্রটি সহজ হয়ে আসছে। যদিও এই সেক্টরে নারীর পদচারণা নতুন নয়। ষাট দশকের শেষেই ঢাকাই চলচ্চিত্র নারী নির্মাতা দেখেছে। তবে সেই ষাট দশকের শুরু হলেও এরপর সেই অনুপাতে কমই নারী পরিচালক পেয়েছে ঢাকাই চলচ্চিত্র। তবে গত দুই দশকে ক্যামেরায় লুক থ্রো করায় এগিয়ে আসছেন অনেক নারী। শুধু এখানেই থামেননি তারা। বেশিরভাগই যার যার কাজে প্রশংসিত হয়েছেন। দেশীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে পুরস্কৃত হয়েছেন। চলচ্চিত্রের দুঃসময়ে এসেও তারা ক্যামেরায় লুক থ্রো করায় ভালো মুন্সিয়ানার পরিচয় দিতে পারছেন সেটার জন্য তারিফ না করা ছাড়া কোনো উপায়ই নেই।
তবে তারা বর্তমান চলচ্চিত্রের মন্দা বাজারে কতজনের ছবি লগ্নিকারক প্রযোজকের পুঁজি ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন, কতজনের ছবি সপ্তাহের পর সপ্তাহ প্রেক্ষাগৃহে চলেছে সেই হিসাবে না গেলেই ভালো হয়। সর্বশেষ চয়নিকা চৌধুরী পরিচালিত 'কাগজের বউ'টি যেরকম দেখা গেছে তাতে কাজের দিক থেকে নারী হতাশ না হলেও চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিষয়ে যারা কাজ কারবার করছেন তাদের দিক থেকে তো হতাশ হতেই হবে। তবে এর মাঝেও যে নারী নির্মাতারা চলচ্চিত্র থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে না, এতেই তারা প্রশংসিত হবেন।
এমনিতেই অভিনয় করা যতটা সহজ চলচ্চিত্র বানানো ততটা সহজ নয়। অত্যন্ত পরিশ্রমসাধ্য এবং দুরূহ একটি কাজ। তারপরেও এই সেক্টরটিতে যেসব নারী যুক্ত বেশির ভাগই সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন। সংখ্যার তুলনামূলক বিচারেও নারীরা পুরুষ চিত্র পরিচালকদের চেয়ে এগিয়ে।
এজন্য সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাণে সরকারি অনুদান প্রকল্পটিও প্রশংসার দাবিদার। কারণ, একটি সিনেমা বানাতে প্রচুর টাকার প্রয়োজন হয়। মূলত টাকার অপ্রতুলতার কারণে সিনেমা নির্মাণের মতো কাজে নারীদের খুব বেশি দেখা যেত না। যেসব নারীরা সিনেমা বানাতেন তাদের সবাই-ই ছিলেন আগে চলচ্চিত্রে অভিনয় করা অভিনয় শিল্পী। অভিনয় করে প্রচুর টাকা রোজগার করা শিল্পী।
এরমধ্যে যেমন আছে বাংলাদেশের প্রথম নারী চিত্র পরিচালক মনজন আরা বেগম রেবেকা (তিনি প্রথমে চলচ্চিত্রে শিশুশিল্পী ছিলেন পরে পূর্ণ বয়সে অভিনেত্রী হন), তারপরে জাহানারা ভূঁইয়া, সুজাতা আজিম, সুমিতা দেবী, কোহিনূর আক্তার সুচন্দা, রোজী আফসারী, কবরী, সামিয়া জামান, মৌসুমী, রোজিনা, অরুণা বিশ্বাস এবং হৃদি হক।
তবে গাইতে গাইতে গায়েন হয়ে যাওয়ার মতো চিত্র পরিচালক নয় বরং চলচ্চিত্রের ওপর পড়াশোনা করে আসা যেসব নারী নির্মাতারা সাফল্যের পরিচয় দিচ্ছেন তারা খুব বেশি বছর হয়নি দেশীয় চলচ্চিত্রাঙ্গনে এসেছেন। এই নারী চলচ্চিত্র নির্মাতারাই এখন একের পর এক সাফল্য দেখাচ্ছেন। সুযোগ ও সুবিধা পেলে চলচ্চিত্র নির্মাণে নারীরাও যে পুরুষ চলচ্চিত্র নির্মাতাদের চেয়ে কম যান না সেটার প্রমাণ দিচ্ছেন তারা। সেরকমই সর্বশেষ নজির দেখিয়েছেন 'মেড ইন বাংলাদেশ' তথা 'শিমু' চলচ্চিত্রের পরিচালক রুবাইয়াত হোসেন।
নির্মাতা হিসেবে নাম লেখানো নারীদের মধ্যে এ পর্যন্ত যারা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জন করেছেন তাদের মধ্যে নার্গিস আক্তার, কোহিনুর আক্তার সুচন্দা, চয়নিকা চৌধুরী, রুবাইয়াত হোসেন প্রমুখ।
অভিনয় শিল্পী হিসেবে চলচ্চিত্র পরিচালনায় যারা এসেছেন তারা খুব বেশি সাফল্য না পেলেও শুরু থেকেই যারা চলচ্চিত্রকে ধ্যানজ্ঞান করে এটাকে পেশা হিসেবে নিয়েছেন তাদের সাফল্যই বেশি। কেউ যেমন একাধিক ক্যাটাগরিতে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছিনিয়ে নিয়েছেন আবার অনেকে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার ছিনিয়ে নিতে না পারলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ভালো প্রশংসা পাচ্ছেন। লাভ করেছেন বিশেষ সার্টিফিকেট। গত দুই দশকে যেসব নারী নির্মাতারা পাদপ্রদীপের আলোয় এসেছেন তাদের মধ্যে আছেন- নারগিস আক্তার, মাসুদ ক্যাথরিন মাসুদ (জন্মসূত্রে মার্কিন হলেও তিনি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত), চলচ্চিত্রে রুবাইয়াত হোসেন, মাতিয়া বানু শুকু, হৃদি হক, চয়নিকা চৌধুরী, মারিয়া তুষার, শামীম আখতার, শাহনেওয়াজ কাকলী, রওশন আরা নিপা, মেহের আফরোজ শাওন, মাহবুবা ইসলাম সুমী, প্রীতি দত্ত, ক্যাথরিন মাসুদ, জেসমিন আক্তার নদী, তানিয়া আহমেদ প্রমুখ।
এই তালিকার অনেকে অভিনয় শিল্পী থেকে চলচ্চিত্র নির্মাণে এসেছেন। মৌসুমী, মেহের আফরোজ শাওন, তানিয়া আহেমদ অন্যতম।
তবে নার্গিস আক্তার, রুবাইয়াত হোসেন, মাতিয়া বানু শুকু- তারা প্রত্যেকেই পরীক্ষিত চলচ্চিত্র নির্দেশক হিসেবে সুনাম কুড়াতে সক্ষম হয়েছেন। তারা প্রচলিত ধারার সিনেমার বাইরে নিরীক্ষাধর্মী সিনেমা বানান। নারীদের মধ্যে অফ ট্র্যাক বা নিরীক্ষাধর্মী সিনেমা অবশ্য সত্তর দশকে সর্বপ্রথম রেবেকাই বানিয়েছিলেন। সেই চলচ্চিত্রটির নাম 'বিন্দু থেকে বৃত্ত'।
উলিস্নখিত নারী নির্মাতাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন নার্গিস আক্তার- ৮টি। তার পরিচালিত 'মেঘলা আকাশ', 'মেঘের কোলে রোদ', 'চার সতীনের ঘর', 'অবুঝ বৌ', 'পৌষ মাসের পীরিত', 'পুত্র এখন পয়সা ওয়ালা', 'যৈবতি কন্যার মন'সহ তার নির্মিত নাটকও সাধারণ দর্শক থেকে শুরু করে সব মহলে প্রশংসিত হয়েছে। এ পরিচালক বহু নাটকও পরিচালনা করেছেন। দুইবার জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অনেক পুরস্কার পেয়েছেন তিনি। বাংলাদেশ থেকে তিনি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত প্রথম নারী। কোহিনূর আক্তার সুচন্দা তার প্রথম পরিচালিত 'হাজার বছর ধরে' সিনেমার জন্য পেয়েছেন শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার। এখন আছেন তিনি 'বরফ গলা নদী' সিনেমা বানানোর অপেক্ষায়।
অন্যদিকে এক সময়ের শীর্ষস্থানীয় অভিনেত্রী মৌসুমী চলচ্চিত্র নির্মাণের কাজে হাত দিয়ে দর্শককে উপহার দিলেন 'কখনো মেঘ কখনো বৃষ্টি'। এরপর নির্মাণ করেন 'মেহের নেগার'।
নার্গিস আক্তার, রুবাইয়াত হোসেন, মাতিয়া বানু শুকুদের সাফল্য থেকেই প্রমাণিত হয় সংখ্যার হিসেবে নগণ্য হলেও তাদের হাতেই এখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র, নাটক সমৃদ্ধ হচ্ছে। কারণ, তারা সিনেমা নির্মাণে অবাস্তব, অপ্রাসঙ্গিক বিষয় থেকে বিরত থাকেন। তাদের নিজস্ব ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ থেকে বানানো বেশিরভাগ ছবিই ফ্যান্টাসি, মারপিট বিমুখ জীবনমুখী। তাদের এই চলচ্চিত্র ভাবনা থেকেও বোঝা যায় তারা কী ধরনের সমাজ, রাষ্ট্র ও বিশ্ব দেখতে চান। দেখা যাচ্ছে, তাদের প্রায় সব ছবির বিষয়বস্তু নারী। যেখানে নারীর চোখে নারী- সৃষ্টি করেছে অন্য এক আবহ ও পরিবেশ পরিচিতি। দর্শকের কাছে তারা পৌঁছে দিতে চেয়েছেন রাষ্ট্র ও সমাজের নানা অসঙ্গতি বিসঙ্গতিসহ নারীর দুঃখ-কষ্ট গাঁথা, না বলা কথা, ভালো লাগা, মন্দ লাগা, অম্স্নমধুরতা, বেদনাবিধুরতার আখ্যান।
বলার অপেক্ষা রাখে না, এসব ছবির নির্মাণশৈলী, গল্প বলার আঙ্গিক, লোকেশন নির্বাচনসহ নানা কারণে নারী নির্মাতারা বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারসহ যে কোনো পুরস্কারেই এখন এগিয়ে আছেন।