শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১

জনপ্রিয়দের অভাবে কমছে টিভি দর্শক

মাতিয়ার রাফায়েল
  ০২ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
পথে হলো দেরি নাটকের একটি দৃশ্য

খোদ ছোটপর্দার অভিনেত্রীদেরই অনেকে এখন বলছেন তারা টিভি নাটক দেখেন না। তাও আবার বর্তমান প্রজন্মের অভিনেত্রী। তাদের একজন সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে বলেছেন, তিনি টিভি নাটক দেখেন না। নিজের অভিনীত নাটকও খুব একটা দেখেন না। এখন এতো টিভি চ্যানেল, একজন অভিনয় শিল্পীরই তিন-চারটি নাটক প্রায় একই সময়ে তিন-চারটি চ্যানেলে দেখানো হচ্ছে। তখন তার সব নাটক কীভাবে দেখবেন। নিজের ত্রম্নটি-বিচু্যতিগুলো কিভাবে বুঝবেন। কিন্তু দর্শকরা যে সমস্যায় পড়েন সেটা তো দিনকে দিন আরও প্রকট হয়ে উঠছে।

কারণ বছর দুয়েক ধরেই ছোটপর্দায় যারা বড় তারকা হিসেবে দর্শকপ্রিয় ছিলেন তাদের প্রায় সবাই এখন সেই আগের মতো দর্শকদের অপেক্ষায় রেখে নতুন কোনো নাটকে অভিনয় করছেন না। করলেও সেটা বড়জোর ঈদ বা ভালোবাসা দিবসকে কেন্দ্র করে। সেটাও খুব বেশি নয়। এ অবস্থায় যারা ছোটপর্দার নাটকে দর্শকপ্রিয় হয়ে উঠতে শুরু করেছেন সেটাও সেই ছেড়ে যাওয়া অভিনয় শিল্পীদের প্রতি অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দর্শকদের কাছে নয়। বরং তারা এই নতুন তারকা হয়ে ওঠার প্রচেষ্টায় থাকা শিল্পীদের মেনে নিতে পারছেন আগের দর্শকপ্রিয় অভিনয় শিল্পীদের না দেখার কারণে। ফলে ধীরে ধীরে ছোটপর্দার অভ্যস্ত দর্শকদের হারাতে শুরু করেছে ছোটপর্দা। আর সেটার জায়গা দখল করে নিচ্ছে ওটিটি পস্ন্যাটফর্মগুলো। কারণ ওই দর্শকদের প্রিয় তারকারা এখন যে সবাই ওই ওটিটিতেই আশ্রয় নিয়েছেন। তাই কিছু অর্থ খরচ করে হলেও ওটিটি পস্ন্যাটফর্মগুলোর সাবস্ক্রাইবার হয়ে তাদের কন্টেন্টগুলো দেখতে শুরু করেছেন। ওটিটি পস্ন্যাটফর্মগুলো এই টাকার বিনিময়ে তাদের কন্টেন্টগুলো দেখাতে পারছেন সেটা কিন্তু ওই অভিনয় শিল্পীদের দর্শকপ্রিয়তা থাকার মূল্যেই। অর্থাৎ ছোটপর্দার তারকা শিল্পীদের বাজার মূল্যের কারণেই আজ ওটিটি পস্ন্যাটফর্মগুলো ব্যবসা করতে পারছে নতুন নতুন কন্টেন্ট উপহার দিয়ে। সেই ফাঁকে এখন ছোটপর্দায় জেঁকে বসেছেন, তৌসিফ মাহবুবু, মুশফিক আর ফারহান, তানজিম সাইয়ারা তটিনী, সামিরা খান মাহি, ফারহান আহমেদ জোভান, ইয়াশ রোহান, জান্নাতুল সুমাইয়া হিমি প্রমুখ।

তার পরও যেখানে নিত্য পরিচয়ের অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া দর্শকের তারকা শিল্পীরা ছোটপর্দা ছাড়ছেন সেখানে যদি ছোটপর্দায় নাটক প্রদর্শনের পরিবেশটি স্বস্তিদায়ক হতো তখন এই নবাগত টিভি তারকাতেও অভ্যস্ত দর্শক হওয়ার ফুরসত পেতেন নতুনদের নাটক দেখার ক্ষেত্রে। কিন্তু যেখানে একটি নাটকও দর্শকের পক্ষে মনোযোগ দিয়ে দেখা সম্ভব হয় না সেখানে এই নতুন তারকাতে দর্শক কী করে নিয়মিত দেখার মতো অভ্যস্ত দর্শক হতে পারবেন? একে তো মাত্র পঁয়ত্রিশ থেকে চলিস্নশ মিনিটের নাটক তার ওপর বলা নেই কওয়া নেই হুটহাট করে ঘন ঘন কয়েক মিনিট পর পর আসতে থাকে বিরক্তিকর নিম্নমানের বিজ্ঞাপন। অথচ এই নিম্নমানের বিজ্ঞাপনগুলোর বদলে নামিদামি কোম্পানির রুচিসম্পন্ন বিজ্ঞাপন একটু বেশি সময় নিয়ে কম করে প্রচার করলেও দর্শক সেটা সহ্য করতে পারত। নাটকের সঙ্গে অভিনয় শিল্পীদের দেখার জন্যও অভ্যস্ত হতে পারতেন।

এ নিয়ে নাটক নির্মাতাদের সবার মধ্যেই রয়েছে অস্বস্তি ও বিরক্তি। অন্যদিকে তাতেও বর্তমান শিল্পীদেরও কী-ই বা আসে-যায়। তাদের টাকা পেলেই তো হলো। আর বিজ্ঞাপন এজেন্সিদের ভাবখানা এমন যে, নাটক যেমন-তেমন যা ইচ্ছা তা-ই হোক, আমারটা বিজ্ঞাপনটাই দেখ, আমার কোম্পানির পরিচয় সম্পর্কে পরিচিত হও।

এমনভাবে হুটহাট ঘনঘন বিজ্ঞাপন প্রচারের কাজটি যেন দর্শককে এক প্রকার 'জিম্মি' করে বা বাধ্য করেই নাটকের মাঝখানে বেরসিকের মতো 'বাঁ হাত' ঢুকিয়ে দেওয়া। ফলে টিসু্য পেপারের মতোই প্রদর্শিত নাটকগুলো দ্রম্নত হারিয়ে যাচ্ছে। কোনো নাটকই দর্শকের মনে ঠাঁই পাচ্ছে না।

জানা যায়, এখন বিজ্ঞাপন এজেন্সির কলকাঠির ওপরই চলে নাটক নির্মাণ। এজেন্সিগুলোই ঠিক করে দেয় কোন নাটক কোন নির্মাতাকে দিয়ে বানানো যাবে, কোন নাটকে কোন কোন শিল্পীরা থাকবে বা থাকবে না। এজেন্সিগুলো শিল্প-সংস্কৃতি কি, মূল্যবোধ কি- এসবের কিছুই জানে না প্রয়োজনবোধও করে না। তারা তাদেরই দেখাতে চায় বা দেখাতে বাধ্য করে।

এ সম্পর্কে নির্মাতা চয়নিকা চৌধুরী বলেন, 'চলিস্নশ মিনিটের নাটকে কী এমন দেওয়া যায়। আমাদের দু'চারটি চরিত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে নাটক বানাতে হয়।' তিনি আরও বলেন, 'আমাদের তো উপায়ও নেই চ্যানেলগুলো যেমন চায় সেভাবেই আমাদের নাটক বানাতে হবে। তারপরও আমি আমার নাটকে ভালোটা দেওয়ারই চেষ্টা করে যাচ্ছি।'

এ সম্পর্কে চিত্রনাট্যকার বৃন্দাবন দাস বলেন, 'নাটকের বিষয়বস্তু বলতে আমি সমাজের সম্পূর্ণ দিক নিয়েই কাজ করি। নাটককে আমি খন্ডিতভাবে দেখানোর পক্ষপাতী নই। আত্মীয়-স্বজন থেকে শুরু করে সমাজের সব ধরনের সদস্যকে উপস্থাপন করাতেই আমার মনোযোগ। সম্প্রদায়ের সবাইকেই রাখি। কোনো সম্প্রদায়কেই বিচ্ছিন্নভাবে দেখি না এবং দেখাইও না। মানুষের জীবনের সম্পূর্ণতাকে ফুটিয়ে তোলাই আমার নাটকের বিষয়বস্তু।'

নির্মাতা সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, 'এখন যুগটাই পরিবর্তন হয়ে গেছে। চ্যানেলগুলো দেখে কার ভিউ বেশি। তারা কোয়ালিটির দিকে নজর দেয় না। ভিউটাকেই গুরুত্ব দেয়। এর বাইরে গিয়ে আমরা তো নাটক বানাতেও পারছি না। আবার আমাদের যে ভাবমূর্তি আছে সেটা ক্ষুণ্ন করেও যেমন-তেমন কাজে হাত দিতে পারি না। সে কারণে আমাদের জেনারেশনের নির্মাতাদের কাজের সংখ্যাও কমে গেছে।'

একদিকে ভালো নির্মাতাদের কাজের সংখ্যা কমে যাওয়া অন্যদিকে যারা ছোটপর্দায় দেড়/দুই দশকের ওপর কাজ করে তিলে তিলে নিজেদের দর্শকের কাছে চাহিদাসম্পন্ন ও শক্তিমান অভিনয় শিল্পী হিসেবে গড়ে তোলার সময় পেয়েছিলেন এখন তাদের অভাবে টিভিতে নাটক দেখার দর্শক কী করে বাড়তে পারে? ফলে এভাবেই সালাহ উদ্দিন লাভলুর ভাষায় একদিকে যেমন নির্মাতাদের কাজের সংখ্যা কমছে আরেকদিকে একে একে সব দর্শকপ্রিয় অভিনয় শিল্পীরা ভিন্ন পস্ন্যাটফর্ম বেছে নেওয়ায় এই ছোটপর্দার দশকও কমছে।

  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

উপরে