গানের ভুবনে সব সময়ে সব যুগেই মৌলিক গান যেমন সৃষ্টি হয়েছে আবার পাশাপাশি অনুকরণ করেও অনেক নতুন গান হয়েছে। তারপরেও সেসব গানের ছিল মানুষের আবেগ-অনভূতিময় দারুণ সব কথার ছড়াছড়ি। এখন সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সেসব আবেদনও হারিয়ে গেছে। ফলে মৌলিক গান হলেও অন্তর ছুঁয়ে যাওয়ার মতো গান এখন আর তেমন দেখা যাচ্ছে না। মনের অজান্তেই গুনগুনিয়ে কেউ গাইছে গান কিংবা দিচ্ছে কোনো পঙক্তিতে সুর।
এখন প্রযুক্তি হাতের নাগালে এসে পড়ায় নতুন গানের ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা চললেও শ্রোতাদের প্রতি তেমন সাড়া নেই। প্রাণ না থাকায় শ্রোতারা যেমন ক'দিন পরই ভুলে যাচ্ছেন নতুন গান, তেমনই সিনিয়র শিল্পীরাও নতুন গানে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। তরুণ প্রজন্মের শিল্পী তো আছেনই, কথা ও সুরের গভীরতা না থাকায় প্রতিষ্ঠিত শিল্পীরাও নতুন গানে বাজার মাত করতে ব্যর্থ হচ্ছেন। দেখা গেছে, গত কয়েক বছরে কোনো মৌলিক গানই দীর্ঘস্থায়ী হতে পারেনি। কিছুদিন কোনো গান সহজ প্রযুক্তির সুবাদে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা থাকলেও সে গানও মাস খানেক যেতে না যেতেই হারিয়ে গেছে অতল অন্ধকারে। মনের অজান্তেও গাইছে না কেউ সেই গান।
সম্প্রতি অডিও অঙ্গনে প্রকাশ পেয়েছে বেশকিছু মৌলিক গান। এরই মধ্যে বছরের শুরুতেই নিজের প্রথম গান নিয়ে হাজির হন গায়ক-সুরকার হাবিব ওয়াহিদ। যা তার নিজের ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত হয়েছে 'মন বোঝে না' শিরোনামের গানটি। হাবিবের সঙ্গে গানটিতে কণ্ঠ দিয়েছেন দেবশ্রী অন্তরা। কথা লিখেছেন অমিতা কর্মকার।
সুর ও সঙ্গীতায়োজন করেছেন হাবিব নিজেই। গান ও সহশিল্পী প্রসঙ্গে হাবিব বলেন, 'সংবাদ উপস্থাপনার পাশাপাশি দারুণ গান করেন দেবশ্রী অন্তরা। তার সঙ্গে এটিই আমার প্রথম গান। রোমান্টিক ঘরানার গান, সঙ্গীতায়োজনও করেছি সেভাবে। আমার ইউটিউব চ্যানেলের পাশাপাশি অন্য অনলাইন পস্ন্যাটফরমেও পাওয়া যাবে গানটি।'
দুই দশক ধরে যার গানের দোলাচলে সঙ্গীতপ্রেমীদের মুগ্ধ করছেন এই সঙ্গীতশিল্পী। কিছুদিন আগে ইমরানের সুর-সঙ্গীতে 'বোকামন' শিরোনামে একটি গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি। নতুন বছরে এটিই তার প্রথম গান।
এছাড়া নতুন বছরে প্রকাশ পেয়েছে শতাব্দী রায় ও তাপস পালের 'হ্যাপী হয়ে যারে' শিরোনামের 'হ্যাপী নিউইয়ার' গান।
প্রকাশিত হয়েছে আর 'মিউজিক অব বেঙ্গল'-এর ব্যানারে শিল্পী কামাল আহমেদের ২৯তম অডিও অ্যালবাম 'স্বরলিপি'। অ্যালবামটিতে রয়েছে ১৫টি দ্বৈত গান। এর মধ্যে কামাল আহমেদের সঙ্গে সানিয়া সুলতানা লিজা গেয়েছেন সর্বাধিক ছয়টি, জানিতা আহমেদ ঝিলিক গেয়েছেন পাঁচটি, সাজিয়া সুলতানা পুতুল গেয়েছেন দু'টি, রন্টি দাশ গেয়েছেন একটি ও অবন্তী সিঁথি গেয়েছেন একটি গান।
অন্যদিকে সম্প্রতি ইউটিউবে প্রকাশিত হয়েছে কন্সট্যান্ট ব্যান্ডের নতুন গান 'সাদাকালো'। ব্যান্ডের সদস্য আহম্মদ মোস্তফা আকিক বলেন, 'আমাদের গিটার পেস্নয়ার বুশান ক্যানসারের সঙ্গে লড়াই করে অকালে প্রাণ হারিয়েছেন। শোককে শক্তিতে রূপান্তর করে গানটি তৈরি করেছি। নব্বই দশকের ব্যান্ড সঙ্গীতের মেলোরকের আবহ আছে এই গানে।'
এবার নতুন বছরে মুন্না খান মাল্টিমিডিয়ার ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে জিসান খান শুভর কথা, সুর ও কণ্ঠে নতুন গান অন্তর্যামী'। সঙ্গীতায়োজনে আদিব কবির। গানটির ভিডিওতে মডেল হয়েছেন মুন্না খান ও নিপা রোজ। জিসান খান শুভ জানান, এটি সফট রোমান্টিক ঘরানার গান।
সোহান আলীর কথা ও সুরে মারুফ মৃন্ময় ও সোহান আলী গেয়েছেন 'কাঁটা'। গতকাল সোহান আলীর ইউটিউব চ্যানেলে প্রকাশিত হয়েছে গানটি। সোহান আলী বলেন, 'উত্তরবঙ্গে বিয়েতে নাচার গানের অভাব, এই গান কিছুটা হলেও সেই অভাব পূরণ করবে।
অন্যদিকে আরাফাতুল হাসান শান্তর কথা, সুর ও সঙ্গীতে নিজের চ্যানেলে প্রকাশ করেছেন 'ও মেঘ' গত বছর ডিসেম্বরের শেষে।
গত বছর দেশের জনপ্রিয় ব্যান্ড দল 'সোলস' তাদের ৫০ বছর পূরণ করেছে। এ উপলক্ষে পার্থ বড়ুয়া ৫০টি নতুন গান তৈরি এবং প্রকাশ করার ঘোষণাও দেয়। এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি গান প্রকাশিত হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় ২ জানুয়ারি প্রকাশিত হয় 'সোলস'-এর আরেকটি গান 'নতুন শহর'।
শেখ রানার লেখা গানটির কম্পোজিশন ও রেকর্ডিং হয়েছে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামের একটি স্টুডিওতে। পার্থ বড়ুয়া বলেন, 'বার্মিংহামে আমাদের ৫০ বছর পূর্তি কনসার্ট দেখতে এসেছিল কার্ডিফপ্রবাসী গীতিকার শেখ রানা। সেখানেই পরিকল্পনা করা হয় নতুন একটি গানের।
গায়ক-সুরকার আরফিন রুমি আবার গানে নিয়মিত হয়েছেন। পড়শীর সঙ্গে তার গাওয়া 'ওরে মন' গানটি হিট তকমা পেয়েছে এরই মধ্যে, পাশাপাশি 'ওমর' চলচ্চিত্রে পাওয়া যাবে সঙ্গীত পরিচালক হিসেবে। এরই মধ্যে বেশ কিছু অডিওর গান প্রস্তুত করেন তিনি। সিডি চয়েজ নামের অডিও প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩০টি গানের চুক্তি হয়েছে তার।
কণ্ঠশিল্পী ডলি সায়ন্তনী বলেন, 'আগে গানের যে পরিবেশ ছিল এখন তা নেই। ঘরে ঘরে স্টুডিও, জনে জনে শিল্পী। অনেকে এক গানেই ভাইরাল হচ্ছে। গানের প্রতি ভালোবাসা-সাধনা কমে গেছে। ভালো লাগার মতো গান খুব কম হচ্ছে। গান নিয়ে তেমন একটা ভাবা হচ্ছে না। আগে আমরা একটা নতুন গানের জন্য যে শ্রম দিতাম এখন সেটা হচ্ছে না। আমরা একটি গান নিয়ে গীতিকার, সুরকার ও শিল্পীরা বসতাম। কোথাও কারও পরামর্শ থাকলে সেটা গুরুত্ব দিয়ে ভাবা হতো। সংশোধন হতো। এখন তা কি হয়? তখন অনেক সময় নিয়ে তৈরি হতো একটি নতুন গান। এখন খুব কম সময়ে গান হচ্ছে। যে কেউ শিল্পী, সুরকার, গীতিকার হচ্ছেন। গান এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে। আসলে সহজে যেটা পাওয়া যায় সেটার গুরুত্ব ও স্থায়িত্ব হয় না।'
তবে তরুণ প্রজন্মের কণ্ঠশিল্পীরা এটা মানতে চান না। তাদের মতে গানের পরিবেশ উন্নতির দিকে যাচ্ছে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে এ সময়ের সঙ্গীতও এগিয়ে যাচ্ছে। কোম্পানিগুলো ভালো গানে বিনিয়োগ করছে। পৃষ্ঠপোষকতা বাড়ছে। ডিজিটালি গান প্রকাশিত হচ্ছে। যে কেউ ইউটিউবে গান প্রকাশ করতে পারছেন। এর নেতিবাচক ও ইতিবাচক দু'টি দিকই আছে। ইতিবাচক দিকটাকে গ্রহণ করেই এগিয়ে যেতে হবে।