'নতুন মঞ্চনাটকের দুর্বলতা, দুর্বল সংলাপ'
প্রকাশ | ২৯ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
একটা সময়ে ঢাকার থিয়েটার পাড়া ছিল নিত্যনতুন মঞ্চনাটক তৈরির কারখানা। এখন সেখানে দীর্ঘদিন ধরেই দেখতে হচ্ছে ঘুরে ফিরে সেই একই নাটক। তার ওপর এর বেশির ভাগই বিদেশি নাটকের ভাবানুবাদ। দেশি নাটক দেখা যাচ্ছে তবে হাতেগোনা। তাহলে এত বড় শিল্পকলা একাডেমি কীসের জন্য হলো? কী হয় এখানে? এমন কি যারা শিল্পকলায় আছেন তাদের অনেকের কাছে যদি প্রশ্ন করা হয় কবে কী অনুষ্ঠান হচ্ছে সেটাও তারা ভালো করে বলতে পারে না।
তবে কি যে ঢাকাই থিয়েটার ছিল মঞ্চ নাটকের উর্বরভূমি সেটা এখন সেই উর্বরতা হারিয়ে অনুর্বর হয়ে গেল? দেশের টিভি নাটক মানহীন হয়ে পড়ছে এ কথাটি না হয় এখন বহুল চর্চিত বিষয়। কিন্তু তার বিকল্প হিসেবে নতুন মাধ্যম হিসেবে ওটিটি পস্ন্যাটফর্মগুলোতে মাঝে মাঝে বেশ চিত্তাকর্ষক কন্টেন্ট নিয়ে আসতে পারছে- এটা দেখেও তো বলা যেতে পারে যে থিয়েটারে সবচেয়ে মেধাবীরা কাজ করে আসছিলেন সেই স্বাধীনতার পর থেকেই এখন কেন তারা আর নিজেদেরকে টেনে নিয়ে যেতে পারছেন না?
বলাই বাহুল্য বাজেট। এই বাজেটের অভাবেই আজ ঢাকাই থিয়েটার নতুন নাটকের অভাবে ধুকছে। যারা থিয়েটারের জন্য লিখে যে টাকা পাবেন সেখানে এইসব জায়গায় যদি তারা স্ক্রিপ্ট লেখার জন্য মাথা খাটান তাহলে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি টাকা পাবেন। এটা চিন্তা করেই এখন থিয়েটারের জন্য ভালো কোনো নাটক লেখার তেমন চিন্তাভাবনা করছেন না বলেই মঞ্চনাটকের একসময়ের খ্যাতিমান নাট্যজনরা বলছেন।
চলচ্চিত্রেও অভিযোগটি চালু ছিল এখানে ভালো কিছু হচ্ছে না বা হবেও না। কিন্তু হালে এখানেও অনেকটা উন্নতির ছোঁয়া লাগতে শুরু করেছে। কিন্তু অভিনয়ের যে আতুর ঘর সেই থিয়েটারের অবস্থায় জ্যেষ্ঠ অভিনয় শিল্পীরাও ঘাবড়ে যান।
এ নিয়ে যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে দেশের বিশিষ্ট নাট্যজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে দেশের থিয়েটারে এখন সবচেয়ে বেশি সংকট চলছে ভালো মানের মৌলিক নাটকের। বিশিষ্ট নাট্যজন রামেন্দু মজুমদার বলেন, 'আমরা শিল্প সাহিত্যের ক্ষেত্রে কবিতা, গল্প, উপন্যাসে অনেক এগিয়ে গেলেও শুধু এই মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রেই পিছিয়ে আছি। এখানে যেমন নতুন কোনো মৌলিক ভালো মানের নাটক হচ্ছে না, তেমনি আমাদের মধ্যে তেমন মৌলিক নতুন নাটক লেখার প্রতিও আগ্রহ কম দেখা যায়। তারপরেও নতুনরা অনেকে চেষ্টা করছেন নতুন মৌলিক নাটক লিখতে।'
বাংলাদেশে মঞ্চনাটক সত্যিকার অর্থে বিকাশ লাভ করেছিল স্বাধীনতা উত্তরকালেই। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও নতুন দেশ গড়ার স্বপ্নই মূলত মঞ্চনাটকের জন্য নতুন প্রেক্ষাপটের জন্ম দেয়। তখন ওই নতুন প্রেক্ষাপটই তাদের নিজেদের মতো করে লিখিয়ে নেয় একেকটি দলের একেকটি উচ্চমানসম্পন্ন সংলাপ সমৃদ্ধ নতুন মঞ্চনাটক।
ফলে স্বাধীনতা উত্তর যে কয়টি নাট্যদল তৈরি হয়েছিল সেগুলো এখন পর্যন্ত তাদের দাপট ধরে রেখেছে। এরপর বহু নতুন নাট্যদল হলেও এর বেশির ভাগই জ্বলে উঠতে পারেনি মূলত তাদের মঞ্চনাটককে একচেটিয়া সাফল্যে উত্তীর্ণ করতে না পারা।
এ নিয়ে টিভি, চলচ্চিত্র ও মঞ্চনাটকের অভিনেতা নাদের চৌধুরী বলেন, 'আসলে যারা নাটক করেন তাদের সবাই তো সচ্ছল নয়। অনেকেরই অবস্থা দিন আনে দিন খায় মতো। উপার্জনের আলাদা কোনো সোর্সও নেই। এক্ষেত্রে তাদের জন্য পৃষ্ঠপোষকতা না থাকলে নাটকের দলগুলোই বা টিকে থাকে কী করে আর তারাই বা কী করে কী করবে। পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়া সবসময়ই নিজের পকেটের টাকা খরচ করে এটা তো সবার পক্ষে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়।'
তবে যেমনই হোক, থিয়েটার কিন্তু থেমে নেই। এখনো নতুন নতুন নাটক লেখা ও মঞ্চায়িত হচ্ছে। তবে এগুলোর অধিকাংশের সংলাপই দুর্বল মনে করেন 'একুশে পদক' এ ভূষিত হতে যাওয়া 'মঞ্চকুসুম'খ্যাত শিমূল ইউসুফ তিনি বলেন, 'এটা ঠিক আমরা সেলিম আল দীনের যেসব নাটকে অভিনয় করেছি সেই স্ট্যান্ডার্ডের দিক থেকে এখন যা হচ্ছে তার বেশির ভাগই সাধারণ মানের ডায়ালগ নির্ভর নাটক। তবে আমি জানি না এখন হয়তো অনেকে নতুন নতুন নাটক লেখার চেষ্টা করছেন।'
গত বছর ৭০টির বেশি নতুন নাটক মঞ্চে এসেছে। নতুন বছরে সংখ্যাটা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করেছিলেন মঞ্চকর্মীরা। বছরের প্রথম মাসটা সে ধারণাকে আরও বেশি জোরালো করেছে। একের পর এক নতুন নাটক আসছে। এরই মধ্যে ২৩ জানুয়ারি সন্ধ্যায় শিল্পকলায় দুটি নতুন নাটক প্রদর্শিত হয়েছে। ঢাকার থিয়েটারে একদিনে দুটি নতুন নাটক দেখার অভিজ্ঞতাকে বিরলই বলতে হয়।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির স্টুডিও থিয়েটার মিলনায়তনে ছিল দেশ নাটক- এর নতুন প্রযোজনা 'পারো'র উদ্বোধনী মঞ্চায়ন। নাটকটি লিখেছেন মাসুম রেজা, নির্দেশনাও তার। দেশ নাটকের ২৫তম এই প্রযোজনায় মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন বন্যা মির্জা। আর এর মধ্যদিয়ে দীর্ঘদিন বন্যা মির্জা মঞ্চে ফিরলেন। পোশাক পরিকল্পনায়ও আছেন তিনি। অভিনেত্রী বন্যা মির্জা এখন থাকেন নিউইয়র্কে। মাঝেমধ্যে দেশে এলে মঞ্চনাটকে অভিনয় করেন। অভিনেত্রী জানিয়েছেন, এবার নিয়ম করে প্রতিদিন এ নাটকের মহড়ায় অংশ নিয়েছেন। নিউইয়র্কে ফিরে যাওয়ার আগে 'পারো'র কয়েকটি শোতে অভিনয় করবেন। তার অনুপস্থিতিতে এ চরিত্রে অভিনয় করবেন সুষমা সরকার।
২০১৮ সালে যাত্রা শুরু করে নৃত্য ও নাট্যদল নবরস। দলটি এ বছর ওই একই তারিখে মঞ্চে এনেছে তাদের প্রথম প্রযোজনা। রাজধানীর মহিলা সমিতির নীলিমা ইব্রাহিম মিলনায়তনে মঞ্চস্থ হয় তাদের 'ঊনপুরুষ' নাটকটি।
এর আগে মঞ্চে এসেছে শূন্যন রেপার্টরি থিয়েটারের নতুন নাটক 'রঙিন চরকি'। এটি শূন্যনের তৃতীয় প্রযোজনা। এটিই প্রয়াত নাট্যকার মান্নান হীরার লেখা শেষ নাটক। নাটকটির নির্দেশনা দিয়েছেন সাজিদুর রহমান।
এখন মঞ্চস্থ হওয়া নতুন এই নাটকগুলোর কোনটি অভিনয় ও ডায়ালগের আকর্ষণে আর মঞ্চায়নের নৈপুণ্যে টিকে থাকবে এবং যুগে যুগে বারবার মঞ্চস্থ হয়ে দর্শকের ক্ষুধা আরও বাড়িয়ে দিতে পারবে সেটা সময়ই বলে দেবে।