'পদ্মশ্রী'তে ভূষিত হচ্ছেন রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা
প্রকাশ | ২৭ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
বিনোদন রিপোর্ট
বাংলাদেশে রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের মধ্যে এক উজ্জ্বল তারকা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। একবার যায়যায়দিনের পক্ষ থেকে তার একটি সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে প্রশ্ন করা হয়েছিল, স্বাধীনতা পদক, বঙ্গভূষণ, আজীবন সম্মাননাসহ অনেক পুরস্কার পেলেন। আর কোনো অপ্রাপ্তি আছে কিনা?
তখন তিনি এর উত্তরে সহাস্যে বলেন, 'আপনি তো নিজেই বললেন স্বাধীনতা পদক, বঙ্গভূষণ, আজীবন সম্মাননাসহ যথেষ্ট প্রাপ্তি হয়েছে আমার। আর কত। মানুষের তো চাওয়ার শেষ নেই। এমন স্বীকৃতি ও সম্মান সবসময়ই আনন্দদায়ক। প্রত্যেক শিল্পীই তার কাজের স্বীকৃতি পেতে চায়। আমি এ পর্যন্ত যে স্বীকৃতি পেয়েছি তাতে আমি অনেক হ্যাপি।'
এবার এই খ্যাতনামা রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর মুকুটে যোগ হচ্ছে আরও একটি পালক। ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মাননা 'পদ্মশ্রী' পদকের জন্য মনোনীত হয়েছেন তিনি। বৃহস্পতিবার ভারত সরকার এই ঘোষণা দিয়েছে। এর রেশে সঙ্গে সঙ্গেই বাংলাদেশে খুশির আমেজ বইছে। খুশির আমেজ বইছে বন্যার অগুনতি শিষ্যের মাঝেও।
এই পুরস্কার প্রাপ্তির খবরে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে যায়যায়দিন থেকে ফোন করা হলে তিনি বেশ উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলেন, 'এটা তো খুবই আনন্দের, খুবই ভালো লাগার। শুধু আমার জন্যই নয়, আমার দেশের জন্যও এটা একটা আনন্দের খবর। একজন অ-ভারতীয়দের মধ্যে আমাকেও এমন সম্মান দেওয়ার জন্য আমি কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।'
বরেণ্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরীর সেই 'হ্যাপি' থাকার মাত্রা এবার দেশের সীমানে পেরিয়ে আরও উজ্জ্বল হাতছানি দিচ্ছে। এবার তিনি ভারতের পদ্মশ্রী সম্মাননা পাচ্ছেন। এটা ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ পর্যায়ের সম্মাননা।
শিল্পকলা, শিক্ষা, বাণিজ্য, সাহিত্য, বিজ্ঞান, খেলাধুলা, সমাজসেবা ও সরকারি ক্ষেত্রে বিশেষ অবদানের জন্য ভারত সরকার এই সম্মান প্রদান করেন। এই সম্মাননা সাধারণত জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিকদেরই প্রদান করা হয়। তবে বিভিন্ন সময়ে অনেক অ-ভারতীয়ও এই পুরস্কার জিতেছেন। এবার অ-ভারতীয়দের মধ্যে এই পুরস্কারের সর্বশেষ পালক হিসেবে রেজওয়ানা বন্যা চৌধুরীর মাথায় শোভা পেতে যাচ্ছে। বৃহস্পতিবার নয়াদিলিস্নতে এই সম্মাননা পাওয়া ব্যক্তিদের নাম ঘোষণা করা হয়।
ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস সামনে রেখে প্রতি বছর পদকপ্রাপ্তদের নাম ঘোষণা করা হয়। সাধারণত মার্চ বা এপ্রিলে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠান করে পুরস্কারগুলো তুলে দেওয়া হয়।
পদ্মবিভূষণ, পদ্মভূষণ ও পদ্মশ্রী এই তিন ক্যাটাগরিতে এ বছর ১৩২ জন সম্মাননার জন্য মনোনীত করা হয়েছে। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের সম্মাননা স্মারক তুলে দেওয়ার কথা রয়েছে।
এ বছর পদ্মভূষণ সম্মানে ভূষিত হবেন জনপ্রিয় অভিনেতা মিঠুন চক্রবর্তী। ভারতের সাবেক উপরাষ্ট্রপতি বেঙ্কাইয়া নাইডু পাচ্ছেন পদ্মবিভূষণ।
পদক পেতে যাওয়া বিশিষ্টজনদের মধ্যে ৩০ জন নারী। তাদের মধ্যে ৮ জনকে দেওয়া হয়েছে বিদেশি, মরণোত্তরসহ তিন শ্রেণিতে।
১৯৫৪ সাল থেকে ভারতে পদ্ম সম্মান বা পুরস্কার চালু হয়েছে। এই পুরস্কারের লক্ষ্য অনন্য কাজকে স্বীকৃতি দেওয়া।
ভারতীয় সম্মাননার মর্যাদাক্রম অনুসারে, পদ্মশ্রীর স্থান ভারতরত্ন, পদ্মবিভূষণ ও পদ্মভূষণের পরে। পদকের একদিকে পদ্মফুলের উপরে ও নিচে 'পদ্ম' ও 'শ্রী' শব্দ দুটি খচিত আছে। অপর দিকে বার্নিসড ব্রোঞ্জের উপর বিভিন্ন জ্যামিতিক আকারের চিত্র রয়েছে। সব খোদাই লিপি সাদা সোনালি রঙে চিত্রিত।
শিল্প, সাহিত্য ও শিক্ষা, খেলাধুলো, চিকিৎসা, সমাজসেবা, বিজ্ঞান ও কারিগরি, জনপরিসর, নাগরিক পরিষেবা, শিল্প ও বাণিজ্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে অসামান্য ও ব্যতিক্রমী কাজের জন্য এই পুরস্কার দেওয়া হয়। জাতি, পেশা- সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ নির্বিশেষে যে কেউ এই পুরস্কার পেতে পারেন।
প্রসঙ্গত, সর্বশেষ রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ভারতের এই সম্মানজনক 'পদ্ম পুরস্কার' লাভের আগে ভারতের 'পদ্ম পুরস্কার' পেয়েছেন চার বাংলাদেশি নাগরিক। তাদের মধ্যে একজন পেয়েছেন 'পদ্মভূষণ' আর বাকি তিনজন পেয়েছেন 'পদ্মশ্রী' পুরস্কার। সর্বশেষ তাতে রেজওয়ানা বন্যা চৌধুরী এই পুরস্কাল লাভের মধ্যে দিয়ে এটা চারে উন্নীত হয়ে মোট পাঁচটি হলো। এই পুরস্কার পাওয়া অন্য চার বাংলাদেশি হলেন- প্রয়াত রাষ্ট্রদূত সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী (পদ্মভূষণ), লেফটেন্যান্ট কর্নেল কাজী সাজ্জাদ আলী জহির (অব.) (পদ্মশ্রী), প্রত্নতত্ত্বের অধ্যাপক ডক্টর এনামুল হক (পদ্মশ্রী) ও শিল্পকলার জন্য সনজিদা খাতুন (পদ্মশ্রী)। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী হিসেবে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা হলেন সনজিদা খাতুনের পর দ্বিতীয় রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী।
১৯৫৭ সালের ১৩ জানুয়ারি রংপুর জেলায় জন্ম নেওয়া বন্যা প্রথমে ছায়ানট এবং পরে ভারতের বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। সেখানে শান্তিদেব ঘোষ, কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়, নীলিমা সেন ও আশীষ বন্দ্যোপাধায়ের মত সংগীতজ্ঞদের সান্নিধ্যে আসেন তিনি। তিনি তার গুণানুরাগীদের কাছে শুধুমাত্র 'বন্যা' নামেও পরিচিত। কণিকা বন্দ্যোপাধ্যায়ের শিষ্যদের মধ্যে তাকেই সবচেয়ে জনপ্রিয় গণ্য করা হয়।
সেই হিসেবে পদ্মশ্রীর জন্য মনোনীত রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা শুধু বাংলাদেশ নয়, ভারতের পশ্চিমবঙ্গেও ব্যাপকভাবে সমাদৃত। তিনি রবীন্দ্র সংগীত ছাড়াও ধ্রম্নপদী, টপ্পা ও কীর্তন গানের ওপর শিক্ষা লাভ করেছেন।
সঙ্গীতে অসামান্য অবদান রাখায় ২০১৬ সালে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা লাভ করেছেন দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক। এছাড়া তিনি ফিরোজা বেগম স্মৃতি স্বর্ণপদক, সিটিসেল-চ্যানেল আই মিউজিক অ্যাওয়ার্ড, আনন্দ সংগীত পুরস্কারসহ বহু পুরস্কার পেয়েছেন। ভারতেও তিনি বেশ কিছু পদক পেয়েছেন। এর মধ্যে উলেস্নখযোগ্য হচ্ছে 'বঙ্গভূষণ'।
২০১৭ সালে কলকাতার নজরুল মঞ্চে এই রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীর হাতে 'বঙ্গভূষণ' পুরস্কার তুলে দেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। ২০১৩ সালে পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি দপ্তর প্রদত্ত 'সংগীত সম্মান পুরস্কার' পেয়েছেন বন্যা।
সঙ্গীত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান 'সুরের ধারার' প্রতিষ্ঠাতা বন্যা রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে কয়েকটি বইও লিখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা ও সঙ্গীত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও নৃত্যকলা বিভাগের চেয়ারপারসন হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
এ পর্যন্ত অনেক অ্যালবাম প্রকাশিত হয়েছে রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যার। এর মধ্যে রয়েছে 'স্বপ্নের আবেশে', 'সকাল সাঁঝে', 'ভোরের আকাশে', 'লাগুক হাওয়া', 'আপন পানে চাহি', 'প্রাণ খোলা গান', 'এলাম নতুন দেশে', 'মাটির ডাক', 'গেঁথেছিনু অঞ্জলি', 'মোর দরদিয়া', 'শ্রাবণ তুমি' এবং 'ছিন্নপত্র'।