দেশের সিনেমা হলগুলো যখন একে একে বন্ধ হতে শুরু করে সেটা তারা এমনিতেই বন্ধ করে দেয়নি। একের পর এক যখন তারা নতুন সিনেমায় লোকশান গোনা শুরু করে তখন তারা বাধ্য হয়েই বিকল্প ব্যবসায়ের দিকে ঝুঁকে। অন্যদিকে পরিচালকদের ওপরও আস্থা হারিয়ে বসেন সিনেমায় অর্থ লগ্নি করা বড় থেকে মাঝারি প্রায় সব প্রযোজকরা। বড় প্রযোজকদের সবাই সটকে পড়লেও মাঝারি অর্থ লগ্নিকারকরা কোনোমতে ঢাকাই সিনেমাকে আগলে রাখছিলেন।
এরই মাঝে ধুঁকতে থাকা এই সিনেমার হাল ধরতে এগিয়ে আসেন একদল নতুন পরিচালক। যারা সিনেমা পরিচালনায় একেবারেই নবীন। তাদের কেউ শর্টফিল্ম নির্মাতা, কেউবা টেলিফিল্ম কিংবা টিভি নাটক নির্মাতা। নতুন হলেও তারা এফডিসি কেন্দ্রিক সিনেমা নির্মাতাদের চেয়েও অনেক বেশি ট্যালেন্ট, মেধাবী ও সৃজনশীল। তারা প্রেক্ষাগৃহের খরার মাঝে শুধু ভালো সিনেমাই বানালেন না- সেই সিনেমা কীভাবে বিকল্প পথে ব্যবসা করা যায় সেই রাস্তাও বাতলে দিলেন। তাদের আগেও বিচ্ছিন্নভাবে দেশের সিনেমা বিদেশে মুক্তি পেয়েছে। তার মধ্যে যেমন সবচেয়ে বেশি আলোড়ন সৃষ্টি করা জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার অর্জনকারী এস এম শফির 'দি রেইন'। ১৯৭৬ সালের এই সিনেমাটি বিশ্বের ৪৫ দেশে মুক্তি পায়।
সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ ও ভারতের বাংলাভাষী নাগরিকদের ২ কোটির মতো কর্মজীবী লোক বসবাস করে। এই কর্মজীবী বাঙালিদের জন্যও বিনোদনের দরকার আছে। সেই ভাবনা থেকেই তাদের সিনেমা নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কমিউনিটিতে দেখানোর ব্যবস্থা করলেন।
কয়েক বছর আগেই এই যাত্রা শুরু হয়। এই পরিচালকদের মধ্যে তারেক মাসুদ থেকে শুরু করে তানভীর মোকাম্মেল, মোরশেদুল ইসলাম, সারয়ার ফারুকী, অমিতাভ রেজা, গিয়াস উদ্দিন সেলিম, দীপংকর দীপন, অনন্ত জলিল, ফয়সাল আহমেদ প্রমুখসহ পরবর্তী সময়ে নতুন প্রজন্মের নির্মাতা হিসেবে যারা শামিল হলেন তানিম রহমান অংশু, আবদুলস্নাহ মোহাম্মদ সাদ, রেজওয়ান শাহরিয়ার সুমিত, আবু তওহীদ হিরণ ও যুবরাজ শামীম প্রমুখ।
বিদেশে প্রদর্শনীর এই কাজটি শুরুতে ব্যক্তি উদ্যোগে মিলনায়তন ভাড়া করে হতো। কিন্তু বর্তমানে সেই দৃশ্যপট কিছুটা বদলে গেছে। এখন বাংলাদেশি ছবি পরিবেশকের মাধ্যমেই আন্তর্জাতিকভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শিত হচ্ছে। এরই মধ্যে এখানকার বেশ কিছু ছবি ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, এশিয়ার বিভিন্ন দেশে চলছে।
২০১৬ সালের শুরুতে বাণিজ্যিক সিনেমা হিসেবে 'অস্তিত্ব', 'মুসাফির', 'সম্রাট' ছবিগুলো দেশের বাইরে মুক্তি পায়। সে সময় অবশ্য ছবিগুলো সুবিধা করতে পারেনি। পরে 'শিকারি', 'আয়নাবাজি', 'নবাব' দেশের বাইরে প্রদর্শিত হওয়ার পর আলোচনায় আসতে শুরু করে।
এরপরই 'ঢাকা অ্যাটাক' দেশের বাইরে বাঙালি দর্শকদের মাঝে দারুণ একটা হইচই ফেলে দেয়। এ পর্যন্ত দেশের বাইরে যতগুলো সিনেমা মুক্তি পেয়েছে তার মধ্যে 'দি রেইন' ছাড়া 'ঢাকা অ্যাটাক'ই সবচেয়ে বেশি দেশে ও প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েছে। বাংলাদেশের পর পর্যায়ক্রমে আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, আরব আমিরাত, ওমান, ইতালি, ফ্রান্স, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুরে মুক্তি পায় ছবিটি। বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে এরপর আরও অনেক সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। কিন্তু 'ঢাকা অ্যাটাক'-এর মতো এত বেশি দেশে কোনো সিনেমাই মুক্তি যেমন পায়নি আলোড়নও তুলতে পারেনি আর।
তাই বলে বিদেশে বাংলাদেশের সিনেমার মুক্তি থেমে থাকেনি। 'ঢাকা অ্যাটাক' যেমন আগে দেশের প্রেক্ষাগৃহে হইচই বাধিয়ে বিদেশের প্রেক্ষাগৃহেও হইচই ফেলে, তেমন না হলেও সেই প্রদর্শনীর ধারাটি এখনো অব্যাহত রয়েছে। তাতে বাণিজ্যিক সিনেমা যেমন আছে আর্টফিল্ম বা অফট্র্যাক ও সামাজিক জীবনঘনিষ্ঠ সিনেমাও আছে।
বিভিন্ন পরিবেশক সংস্থার মাধ্যমে বিদেশে মুক্তি দেওয়া এই সিনেমার ক্যাটাগরি ও চাহিদা আবার এক নয়। কোনো সিনেমার চাহিদা বেশি ইউরোপ-আমেরিকায় কোনো কোনো সিনেমা মধ্যপ্রাচ্যের বাজারগুলোতে। দেশের বাইরে এসব ছবির পরিবেশনা প্রতিষ্ঠানের একটি 'স্বপ্ন স্কেয়ারক্রো'। এই চাহিদা বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির বাংলাদেশি প্রধান নির্বাহী সৈকত সালাউদ্দিন বলেন, 'একদিকে কানাডায় যেমন 'আয়নাবাজি' দারুণ সফল হয়েছে, অন্যদিকে 'নবাব' মধ্যপ্রাচ্যে সাড়া ফেলেছে। 'ঢাকা অ্যাটাক' আমেরিকা, কানাডা, ওমান, আরব আমিরাতসহ আরও বিভিন্ন দেশে সফল হয়েছে।' অর্থাৎ যে সিনেমা যত বেশি বাণিজ্যিকভাবে সফল সে সিনেমা ততে বেশি বিদেশের প্রেক্ষাগৃহে বাজার সৃষ্টি করতে পারছে।
কিন্তু এরমধ্যে অনেক সিনেমাই আছে যেগুলো দেশে বাজার সৃষ্টি করতে পারছে না অথচ খবর হচ্ছে এই সিনেমাগুলোই আবার বিদেশে ভালো বাজার পাচ্ছে বলে। এর কারণ কী? সিনেমাগুলো কি আসলেই বাজার সৃষ্টির মতো নাকি প্রবাসী বাঙালিরা বছরের পর বছর বিদেশে পড়ে থাকেন বলেই দেশের সিনেমার প্রতি একটু ভালোবাসা দেখাতেই তারা সেখানে হলমুখী হচ্ছেন? অনেকে মনে করেন এটাই। বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেসব সিনেমা প্রদর্শিত হচ্ছে সেগুলোর দর্শক মূলত বাঙালিরাই। আমেরিকান, ইউরোপীয়ান, অস্ট্রেলিয়ানরা নয়। হয়তো ভীনদেশী সংস্কৃতিকে জানা ও বোঝার জন্য অনেকে দেখতে যান কিন্তু সেটার সংখ্যাও খুব বেশি নয়। তবে তারপরেও এটাও স্বীকার করতে হবে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে বাংলাদেশের সিনেমা আগের প্রজন্মের সিনেমার চেয়ে বেশি ভালো মনে হচ্ছে বলেই তারা এসব সিনেমা দেখতে আগ্রহী এবং তারা দেখছেনও বেশ। কিন্তু যেখানে বিদেশে থাকা বাঙালিরা ঢাকাই সিনেমা দেখতে ভিড় করছেন সেখানে দেশে থাকা এই বাঙালিই কেন হলমুখী হচ্ছেন না এটা বেশ চিন্তার বিষয়। চিন্তার বিষয় আরও এদিক থেকে যে, এই দর্শক সিনেমা দেখাই ছেড়ে দিয়েছে এমনও নয়। এই দর্শকই কিন্তু এখানে প্রদর্শিত বলিউড ও কলকাতার সিনেমা দেখছে। প্রেক্ষাগৃহের মালিকরাও তাদের সিনেমা প্রদর্শনের জন্য মুখিয়ে থাকেন। এসব দেখে-শুনে বোঝাই যাচ্ছে ঢাকাই সিনেমা বর্তমানে এক জটিল সমীকরণের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।