উপরে উলেস্নখিত লাইনগুলোর প্রতিটি শব্দই যেন কুমার বিশ্বজিতের বর্তমান জীবনের প্রতিধ্বনি। প্রায় সবাই জানেন, দূর পরবাসে কিংবদন্তির একমাত্র পুত্র নিবিড় কুমার সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে মৃতু্যর সঙ্গে লড়াই করছেন প্রায় এক বছর ধরে। আর তার অসহায় পিতা শুরু থেকেই সব ফেলে পুত্রের সুস্থতার প্রহর গুনছেন হাসপাতালের করিডরে পায়চারি করে।
কিংবদন্তি কুমার বিশ্বজিতের দীর্ঘ, উজ্জ্বল আর গতিময় সঙ্গীত ক্যারিয়ারে যেন নেমে এলো হঠাৎ নীরবতা।
মূলত সেই অপেক্ষাময় কঠিন নীরবতাই কুমার বিশ্বজিতের হয়ে তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন গীতিকবি হাসানুজ্জামান মাসুম ও সঙ্গীত পরিচালক কিশোর দাশ। তাতে কণ্ঠ দিয়েছেন খোদ কুমার বিশ্বজিৎ। গানটির নাম দিলেন 'নিবিড় অপেক্ষা'।
এখনো কুমার বিশ্বজিৎ নিবিড় অপেক্ষায় আছেন কানাডার একটি হাসপাতালের করিডরে। সেখান থেকে এই গানটি প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই আবেগাক্রান্ত হলেন। গণমাধ্যমকে বললেন নিবিড়কে ঘিরে তার বেদনাময় অপেক্ষার কথা, 'প্রথমেই বলি, এটাকে আমি গান বলতে চাই না। এটা একজন পিতার আর্তি। আমি ভাবিনি নিবিড় ও তার সহপাঠীদের এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনার পর আবারও গাইব। কারণ সেই মানসিক শক্তি বা আগ্রহটাই মরে গেছে। মাসের পর মাস এই দূর পরবাসে ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে থাকি, ওর কণ্ঠ শোনার অপেক্ষায়। নিবিড়ের তিন সহপাঠীর অনুপস্থিতি আমাকে প্রতিনিয়ত পিতৃসমতুল্য বেদনায় আচ্ছন্ন করে।'
'নিবিড় অপেক্ষা' সৃষ্টি প্রসঙ্গে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, 'মাঝে আমি কয়েকদিনের জন্য ঢাকায় গিয়েছিলাম। তখন কিশোর ও মাসুম একটা গান করার জন্য বার বার অনুরোধ করছিল। আমিও বার বার ওদের ইগনোর করেছি। কারণ গানটা তো আমরা প্রাণ দিয়ে করেছি আজীবন। এখন তো আর আমার ভেতরে সেই প্রাণটা নেই। ওরা এরপরও একটা ডামি বানিয়ে আমাকে শোনালো। শুনে মনে হলো, কথাগুলো তো আমারই। সুরটাও আমার ভেতরের হাহাকারের মতো। যেগুলো আসলে প্রকাশ করতে পারছি না। পাথর হয়ে আছি। সত্যি বলতে এই গানটা গাইবার পর পাথরটা খানিক গললো বোধ হয়।'
পস্ন্যাটফর্ম এন্টারটেইনমেন্টের পরিবেশনায় সেই 'নিবিড় অপেক্ষা' নামের বিশেষ গানটি একযোগে দেশের ১৮টি ব্যানার থেকে উন্মুক্ত হতে যাচ্ছে আজ। গানটির ভিডিও নির্মাণ করেছে প্রেক্ষাগৃহ।
'নিবিড় অপেক্ষা' তৈরি প্রসঙ্গে এর সুরকার ও সঙ্গীত পরিচালক কিশোর দাশ বলেন, 'আপনারা অনেকেই জানেন স্যার (কুমার বিশ্বজিৎ) আমার কতটা আত্মিক ও শ্রদ্ধার মানুষ। সেই সুবাদে নিবিড় আমাদের কোলে-পিঠে বড় হওয়া একটা তাজা প্রাণ। ফলে নিবিড়ের এই দুর্ঘটনার পর আমাদের জীবনটাও বিষণ্নতায় ঢেকে যায়। চাইলেও আমরা ভালো থাকতে পারি না। সেই ভালো না থাকতে পারার কষ্ট থেকেই এই গানের সৃষ্টি। আমার ও মাসুম ভাইয়ের আপাতত স্বস্তি এখানেই, স্যার গানটি গেয়েছেন। আশা করছি, প্রতিটি বাবা-মা-সন্তান এই গানটিকে অনুভব করবেন।'
গীতিকবি হাসানুজ্জামান মাসুমও একই প্রতিক্রিয়া জানালেন। নতুন করে এটুকু বললেন, 'দাদার (কুমার বিশ্বজিৎ) ভেতরের সত্যিকারের কষ্টটা তো আর আমরা ছুঁতে পারছি না, তবে চেষ্টা করেছি। পৃথিবীর সকল সন্তানকে বোঝাতে চেয়েছি, ওরা ভালো না থাকলে বাবা-মায়েদের আসলে কেমন লাগে। আমরা বিশ্বাস করি, নিবিড়ও দ্রম্নত সুস্থ হয়ে এই গানটি শুনবে এবং অনুভব করবে। আমরা চেষ্টা করেছি, সন্তানকে ভালো থাকা বা সুস্থ রাখার জন্য পৃথিবীর সকল বাবা-মায়ের যে আকুতি বা অপেক্ষা, সেই বিষয়টি গানটির মাধ্যমে তুলে ধরতে।'
গত বছর ১৪ ফেব্রম্নয়ারি টরন্টোর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ১১টায় সড়ক দুর্ঘটনায় কুমার নিবিড় গুরুতর আহত হন। এরপর থেকে গত এক বছর সেখানকার একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। নিবিড় সেখানকার হাম্বার কলেজের শিক্ষার্থী।
নিবিড় কুমারের সর্বশেষ অবস্থা জানতে চাইলে কুমার বিশ্বজিৎ বলেন, 'আশার কথা হলো ও চোখ মেলে। এদিক ওদিক তাকায়। ওর মা আর আমাকে সম্ভবত চিনতে পারে। এটুকুই। সবার কাছে দোয়া চাই ওর জন্য।'