দেশের হল মালিকদের দেশের সিনেমার প্রতি বিন্দুমাত্র প্রেম আছে কিনা এ নিয়ে আবার প্রশ্ন উঠেছে। প্রশ্নটি উঠল আবার গত শুক্রবার তিনটি সিনেমা মুক্তিতে। ঢাকাই সিনেমা ঈদেই তিন-চারটি বা ততোধিক মুক্তি পায়। আর বছরের অন্য সময়ে তো দুটি সিনেমা মুক্তি দেওয়াও মালিকদের জন্য অলাভজনক হয়ে যায়। তারপরও কোনো কোনো সপ্তাহে দুটি সিনেমা মুক্তি পেয়ে আসছিল।
কিন্তু এই প্রথম ঈদের বাইরে তিনটি সিনেমা মুক্তি পেল। মেহেদী হাসানের 'শেষ বাজি', চয়নিকা চৌধুরীর 'কাগজের নৌকা' এবং ব্রাত্য বসুর 'হুব্বা'।
'হুব্বা' সিনেমাটি যদি ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি থেকে নির্মিত হতো তাহলেও এত জল ঘোলা করা হতো না, এখন যতটা জল ঘোলা করা হচ্ছে। সিনেমাটিতে বাংলাদেশের তারকা অভিনেতা মোশাররফ করিম মুখ্য ভূমিকায় অভিনয় করলেও সবাই জানেন যে, সিনেমাটি কলকাতা থেকে নির্মিত। কিন্তু এখানে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রি কর্তৃক প্রচলিত সব নিয়ম লঙ্ঘন করে বাংলাদেশ থেকে নির্মিত দুটি সিনেমার সঙ্গে মুক্তি দিয়েছেন দেশের হল মালিকরা। এখানেই থেমে নেই, অন্য দুটি সিনেমাকে বঞ্চিত করে 'হুব্বা' ছবির জন্য সর্বাধিক ৬৩টি প্রেক্ষাগৃহ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অর্থাৎ তারা প্রেক্ষাগৃহ বরাদ্দের ক্ষেত্রেও দেশীয় সিনেমাকে অগ্রাধিকার দেননি। এতেই স্পষ্ট, এখানে দেশীয় সিনেমা উপেক্ষা করছেন হল মালিকরা। এখন এই প্রবণতা যদি একটা স্বাভাবিক নিয়মে পরিণত হয়ে যায় তাহলে দেশের সিনেমা লাটে উঠতে বেশি সময় লাগবে না।
আমরা নিজেদের 'দেশপ্রেম' নিয়ে যতই গর্ব করি না কেন, কার্যত বিদেশ প্রেমই বেশি। এটা বোঝা যায় যাদের সামর্থ্য আছে তাদের ক্ষেত্রেই বেশি। বিদেশি কাপড়-চোপড়, বিদেশি পণ্য থেকে শুরু করে সবকিছুতেই এর প্রমাণ আছে। এখানে বিদেশ প্রেম এতটাই যে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস থেকে তৈরি পোশাকও ইউরোপ-আমেরিকা থেকে কিনে এনেও অনেকে বাংলাদেশের মানুষকে বোঝান এটা-ওটা আমেরিকা-ইউরোপ থেকে কেনা। অথচ স্টিকারে দেখা যাবে 'মেড ইন বাংলাদেশ'।
সিনেমার ক্ষেত্রেও তাই। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার আগেও বাংলা সিনেমার চাইতে উর্দু সিনেমারই দর্শক ছিল। আবার উর্দু সিনেমার চাইতে কলকাতার বাংলা সিনেমা বা হিন্দি সিনেমার দর্শক বেশি ছিল বলেই তখন পাকিস্তানি শাসকরা এ দেশে হিন্দি ও কলকাতার বাংলা সিনেমার আমদানি নিষিদ্ধ করে দেয়। যে দেশের মানুষের রক্তে এখনো সেই প্রবণতা রয়ে গেছে এবং সেটা আবার নতুন করে উসকে দিতে কেন দেশীয় সিনেমার সঙ্গে বাইরের সিনেমা একই সঙ্গে মুক্তি দেওয়া হবে? এরপর ফলাফল যা হওয়ার তাই হয়েছে। 'হুব্বা' সিনেমাটি বিপরীতে ঢাকাই সিনেমা দুটোর চরম ভরাডুবি ঘটেছে। এমনকি অনেক আশা ও প্রত্যাশা জাগানিয়া থ্রিলার ও অ্যাকশনধর্মী সিনেমা হলেও 'শেষ বাজি' সুপার ফ্লপ হয়েছে।
এমনিতেই গত এক দশক ধরে ঢাকাই সিনেমা ব্যবসা দূরের কথা, নিদেন দু-এক সারি আসনের দর্শকই জোটাতে পারছে না। এমন বাস্তবতায় হিন্দি, তামিল বা কলকাতার বাংলা সিনেমা ঢাকাই সিনেমার সঙ্গে মুক্তি পাওয়াটা যদি স্থায়ী নিয়ম হয়ে যায় দেশীয় সিনেমার বিলুপ্তি হতে বেশি সময় লাগবে না।
গেল বছরের শেষদিক থেকে শুরু করে কয়েক মাস এমনিতেই ঢাকাই সিনেমা মুক্তি পায়নি। দু-একটি পেলেও ব্যবসা দূরে থাক খরচের টাকাও তুলে আনতে পারেনি। এখন নির্বাচনোত্তর একটা সুন্দর পরিবেশে যখন দেশীয় নির্মাতারা তাদের সিনেমা মুক্তি দিতে যাচ্ছেন তখন এমন উটকো আপদে তারা একেবারেই সিঁটিয়ে যাবেন সেটাই স্বাভাবিক। অভিজ্ঞতা থেকে তারা ভালোই জানেন, এ দেশের সিনেমা কখনোই ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে তাল মিলিয়ে ব্যবসা করতে পারেনি।
এ ব্যাপারে প্রযোজক সমিতির সাবেক সভাপতি এবং দেশের অগ্রগণ্য চলচ্চিত্র পরিচালক খোরশেদ আলম খসরু বলেন, 'বর্তমান সময়টা আসলে খুবই খারাপ যাচ্ছে। ইচ্ছে আছে মান্নার অসংখ্য ভক্তদের জন্য তার সর্বশেষ অভিনীত সিনেমা 'জীবন যন্ত্রণা' মুক্তি দেওয়ার। এখন এটা কোন মাসে মুক্তি দিতে পারব বলতে পারছি না।'
বছরের প্রথম মাস শেষের পথে। মার্চে মুসলমানদের ধর্মীয় আনুষ্ঠানিকতার মাস, রমজান। সেক্ষেত্রে সিনেমা মুক্তি দেওয়ার মতো উপযুক্ত পরিবেশ বলতে রমজানের আগে আছে দুই মাস। ইতোমধ্যে বেশকিছু সিনেমা ছাড়পত্রও পেয়েছে। কয়টি সিনেমা মুক্তি দিতে প্রস্তুত। এর মধ্যে 'পাহাড়ি মেয়ে', 'দুনিয়া' নামে দুটি সিনেমা ১২ জানুয়ারি মুক্তির তারিখ ছিল। মুক্তি দেওয়া হয়নি। বাকি আছে 'কাজল রেখা', 'ছায়াবৃক্ষ' এবং 'রুখে দাঁড়াও' প্রভৃতি।
একদিকে মুক্তি প্রতীক্ষিত সিনেমা আরেকদিকে মুক্তি আসন্ন সিনেমা- সব মিলিয়ে এমনিতেই এক কঠিন সিনেমা মুক্তির সেশনজটে পড়তে যাচ্ছে ঢাকাই ছবি। এ অবস্থায় কোনো সিনেমা শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলোও দেখতে পাবে কিনা সংশয় রয়েছে। কারণ এভাবেই ঢাকাই সিনেমার ইতিহাসে অনেক ভালো ভালো সিনেমাও আছে, যেগুলো শেষ পর্যন্ত মুক্তির আলো দেখতে পায়নি।
সেখানে যদি এ রকম 'হুব্বা' সিনেমার মতো ভাগ বসায় ঢাকাই সিনেমার কী দশা হবে!
'হুব্বা' সিনেমাটি ঢাকায় মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করেছে জাজ মাল্টিমিডিয়া। এই চলচ্চিত্র ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। অনেকেরই অভিযোগ, ঢাকাই সিনেমা জনপ্রিয়তার তুঙ্গে থেকে যেখানে একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে এজন্য সম্পূর্ণ দায়ী জাজ মাল্টি মিডিয়াই। তারাই 'হুব্বা' সিনেমাটির আমদানিকারক। আমদানি করেছে ভালো কথা, কিন্তু সেটা একই সঙ্গে দেশীয় দুটি সিনেমার মুক্তির তারিখে কেন?
অন্যদিকে দেশীয় সিনেমাগুলোর মুক্তি তারিখ মেলাতে যেখানে মাসের পর মাস চলে যায় সেখানে জাজ মাল্টিমিডিয়া কী করে এত দ্রম্নততম সময়ের মধ্যে ঢাকাই দুটি সিনেমার সঙ্গেই মুক্তির তারিখ পেয়ে গেল? এতেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে জাজ মাল্টিমিডিয়া এ দেশের সিনেমায় কতটা প্রবলরূপে শাসন করছে। কিন্তু এটা যদি ইতিবাচকও হতো, তাহলেও বোঝা যেত তারা ঢাকাই সিনেমার উন্নতিতে কাজ করছে। কিন্তু এই প্রতিষ্ঠানের জন্মকাল থেকেই এমন একটা পলিসি হাতে নিয়েছে যেটার উদ্দেশ্যই হচ্ছে, ঢাকাই সিনেমাকে নিজেদের একচেটিয়া করার মধ্যদিয়ে বাকি সব সিনেমাকে পথে বসানো। এভাবেই তারা যেন 'ঘরের শত্রম্ন বিভীষণ' হয়ে উঠছে!