এক সময় এমন একটা সময় ছিল যখন যেখানেই কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো সেখানে ছেলেমেয়েদের জন্য নৃত্যানুষ্ঠান হতোই। সেই চিরচেনা চিত্রটি এখন বহু আগে থেকেই ম্স্নান হয়ে গেছে। বড়রা তো প্রায় নেই-ই ছোট-ছোট কোমলমতি শিশুদেরও এখন এই নৃত্যশিল্পের সঙ্গে সেই আগের মতো দেখা যাচ্ছে না। এখন নৃত্য বলতে যেন শিল্পকলা একাডেমির বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মধ্যেই সীমিত হয়ে পড়েছে। অন্যদিকে বিটিভিতে নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন থাকলেও বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোতে নৃত্যশিল্পকে যতটুকু গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে সেটা কিছুতেই এদেশের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে মানানসই হয় না।
অথচ বাঙালির ঐতিহ্যগত নৃত্যে শুধু সাংস্কৃতিকই নয়, ধর্মীয় ও সামাজিক- এই তিন ধারাতেই নৃত্যের প্রচলন ছিল। কীর্তননাচ, ব্রতনাচ, বাউলনাচ, গম্ভীরানাচ, জারিনাচ, ফকিরনাচ ইত্যাদির উৎসে বিভিন্ন ধর্মবোধ ও আচার-সংস্কার জড়িত আছে। ঢালিনাচ ও লাঠিনাচে সামাজিক উপযোগ এবং ছোকরানাচ, ঘাটুনাচ ও খেমটানাচে সাংস্কৃতিক বিনোদন আছে। আবার কত্থক নৃত্য সমাজের সব শ্রেণির মানুষই উপভোগ করে। কীর্তননাচে হিন্দু এবং জারিনাচে মুসলমান সম্প্রদায়ের মানুষই বেশি অংশগ্রহণ করে। তবে লাঠিনাচ ও ঢালিনাচে কোনো সাম্প্রদায়িক ভেদ নেই।
অন্যদিকে শাস্ত্রীয় নৃত্যের অন্যতম একটি শাখা মণিপুরী নৃত্য। ভারতের যুগ যুগ ধরে আমাদের চিত্ত মনোরঞ্জনের অন্যতম এক বিনোদন এ নৃত্য এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছে। কিন্তু বিশ্ব কাঁপানো করোনা মহামারির ধাক্কায় থেমে গেছে দৃশ্যকাব্য রচয়িতাদের নূপুরের ঝংকার। এই শিল্পের সঙ্গে জড়িতদের এখন চরম দুর্দিন। দেশের বিভিন্ন জাতীয় অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে মঞ্চের নানা আয়োজন কমতে থাকায় নৃত্যের ঘুঙুরের শব্দ এখন সেই আগের মতো আর শোনা যায় না। ফলে অনেকেই নাচ ছেড়ে বেছে নিয়েছেন অন্য পেশা।
নৃত্যশিল্পী সংস্থার সূত্রমতে, দেশে প্রায় ১০ হাজারের বেশি
রয়েছে নৃত্য সংগঠন। এ ছাড়া ২২৫টির বেশি নৃত্য স্কুলে নৃত্যচর্চার সঙ্গে জড়িত রয়েছে প্রায় ২৫ হাজারের মতো শিক্ষার্থী। নাচের চর্চা ও অনুষ্ঠান কমে যাওয়ায় কাজের অভাবে নাজুক হয়ে পড়েছে এই অঙ্গনের শিল্পীদের জীবন।
এ বিষয়ে কথা হয় দেশের খ্যাতিমান ও প্রতিষ্ঠিত কয়েকজন নৃত্যশিল্পীর সঙ্গে। দেশের প্রথিতযশা নৃত্যশিল্পী লায়লা হাসান বলেন, 'করোনায় নৃত্যাঙ্গনে আর্থিক সংকটটাই সবচেয়ে বেশি। যারা পেশাজীবী, তারা আর্থিকভাবে যেমন সংকটে পড়েছেন, তেমনি মানসিকভাবেও। অনেকে পেশাও বদল করতে বাধ্য হচ্ছেন। তারা নাচ কিংবা গান ছাড়তে পারবেন না, কারণ এটা আত্মার খোরাক। তাই আয়ের জন্য বিকল্প উপায়ও খুঁজে বের করতে হচ্ছে। এমনও জানি, কেউ রেস্টুরেন্ট করছেন, কেউ করছেন ক্যাটারিং, অনলাইনে অনেকে কিছু করার চেষ্টা করছেন।'
নৃত্যশিল্পী সংস্থার সভাপতি মিনু হক বলেন, 'এখন চরম দুর্দিন চলছে আমাদের নৃত্যশিল্পীদের। অথচ করোনা শুরুর আগেও আমরা প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম জাতির জনকের জন্মশতবর্ষের অনুষ্ঠানের। কিন্তু করোনা সব ভেস্তে দিল। আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে দেশের ৩০ জেলায় ১০ হাজার টাকা করে অর্থ সহায়তা দিয়েছি।'
নতুন যারা নৃত্যশিল্পী তারা এখন নৃত্য ছেড়ে শোবিজের অন্য মাধ্যমে কাজ করছেন। যেমন নৃত্যশিল্প থেকে এখন বড়পর্দায় ঝুঁকে পড়া মন্দিরা চক্রবর্তী বলেন, 'আমি জানি না, কেন নাচকে আগের মতো মূল্য দেওয়া হচ্ছে না। কেন সে রকম স্পেস নেই। স্পেস দিলে অবশ্যই নাচের ওপর নিয়মিত প্রোগ্রাম থাকত, যে কোনো অ্যাওয়ার্ড লেভেলে নাচ হতো। তখন আমাদের নাচও পার্শ্ববর্তী দেশের মতো এগিয়ে থাকত। ধরেন আমি যতই দুর্দান্ত ড্যান্সার হই না কেন আমার জন্য যদি সে রকম স্পেস না থাকে, প্রোগ্রাম না থাকে, তাহলে আমি ওই পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারব না এবং মানুষ জানতেও পারবে না। আমার তো ছোটবেলা থেকেই নাচ নিয়েই ধ্যান-জ্ঞান ছিল। কিন্তু যখন দেখলাম নাচ নিয়ে কোনো ক্যারিয়ার হবে না তখন তো আমাদের অন্যদিক নিয়েই ভাবতে হবে। ব্যাপারটা এ রকমই।'
নৃত্য সংগঠন নৃত্যাঞ্চলের অন্যতম পরিচালক শিবলী মোহাম্মদ বলেন, বাংলাদেশে শাস্ত্রীয় ও সুস্থধারার নাচে পৃষ্ঠপোষকতা এমনিতেই কমছে। তার ওপর করোনা এসে নৃত্যশিল্পীদের আনন্দ কেড়ে নিয়েছে। আমার নিজেরই সংগঠনের শতাধিকের মতো নৃত্যশিল্পী বেকার হয়ে গেছে। যারা আমার চেয়ে ভালো নাচ করে এমন অনেক ছেলেমেয়ে আছে, যারা নিরুপায় হয়ে ঘরে বসে আছে। যাদের এই পেশার ওপর নির্ভর করেই পরিবার-পরিজন নিয়ে টিকে আছে, তাদের কেউ কেউ অসুস্থ বাবা-মায়ের ওষুধ পর্যন্ত কেনার সামর্থ্য হারিয়ে ফেলেছে। তারা সরকার থেকেও কোনো প্রণোদনা পায়নি। ব্যক্তিগতভাবে আমি আর নীপা তাদের সহযোগিতা দিয়েছি। এটা দিয়ে কতদিন চলবে?'
বাংলাদেশে নৃত্যশিল্পীদের মধ্যে নিজের নৃত্য প্রতিভাকে যে ক'জন অন্য রকম উচ্চতায় নিয়ে গেছেন তাদের মধ্যে শামীম আরা নীপা অন্যতম। তিনি বলেন, 'প্রায় দু'বছর ধরে মহামারির জন্য আমাদের নৃত্যশিল্পীদের অসুবিধার মধ্য দিয়েই যেতে হয়েছে। সেটা আর্থিক ও স্বাস্থ্যগত। আমি ঘরের বাইরে প্রয়োজন ছাড়া বের হচ্ছি না। আমাদের নৃত্যাঞ্চলে যেসব নবীন ছাত্রছাত্রী রয়েছেন তাদের অনেকেই এখন অনিয়মিত হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে আমাদের নৃত্যশিল্প হুমকির মুখে পড়বে।'
সাংস্কৃতিক সংগঠন সাধনার শিল্পনির্দেশক লুবনা মারিয়াম বলেন, সরকার যে একটা ভাতা দিয়েছে সেটা নিয়েও গন্ডগোল আছে। কে যে ভাতা পেল কিছুই জানি না। শিল্পকলা একাডেমির পক্ষ থেকে অনলাইনে নৃত্যশিল্পীদের দিয়ে কোরিওগ্রাফির কাজ করাচ্ছে। তাও সিনিয়রদের এবং মধ্যম মানের শিল্পীদের। কিন্তু এরা মুষ্টিমেয় কিছু শিল্পী। বেশিরভাগ যারা নানা অনুষ্ঠান করে জীবিকা নির্বাহ করত তারা তো একদমই বসে পড়েছে।
অভিনেত্রী ও নৃত্যশিল্পী মুনমুন আহমেদ বলেন, 'এখন আমি নিজেই বেকার হয়ে গেছি। সোর্স অব ইনকাম বলতে যেটা বোঝায় আমার জায়গা থেকে সেটা করতে পারছি না। এমনকি যারা নাচের ড্রেস বানায়, ফুলের অর্নামেন্টস বানায়, ঘুঙুর বানায় তারাও বেকার হয়ে গেছে। আমাদের সঙ্গে ওরাও জড়িত। ওরা একেবারেই অসহায়। পরিস্থিতি এতটাই ভয়াবহ।'