গেল বছরের শেষ এবং বছরের শুরুটাতে নির্বাচনী ঝামেলা থাকাতে ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে মাসখানেক সিনেমার মুক্তি আটকে গিয়েছিল। বছরের প্রথম ১৯ জানুয়ারি শুক্রবার একযোগে তিনটি সিনেমা মুক্তি পেয়েছে। এদিন একযোগে দুটি ঢাকাই সিনেমা দিয়ে বছরের হালখাতা খোলা হয় দেশের বিভিন্ন প্রেক্ষাগৃহে। এর একটি মেহেদী হাসানের 'শেষ বাজি' অপরটি চয়নিকা চৌধুরীর 'কাগজের বউ'। তবে শেষদিকে এসে একই দিনে 'হুব্বা' মুক্তি দেওয়ার ঘোষণায় কিছুটা জটিলতার সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে 'কাগজের বউ' মুক্তি পায় কিনা এ নিয়ে। অনেকটা ধোঁয়াশা তৈরি হয়। তবে এ নিয়ে পরিচালক চয়নিকা চৌধুরী তার সিনেমাটি মুক্তি দেওয়া নিয়ে নিজের সিদ্ধান্তের ওপর অটল থাকেন এবং তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, 'আমার ছবির মুক্তি স্থগিত করার সাধ্য কারও নেই। আগেও আনুষ্ঠানিকভাবে মুক্তির তারিখ জানিয়েছি, ফেসবুকে জানিয়ে দিয়েছি ১৯ জানুয়ারি কাগজের বউ প্রেক্ষাগৃহে আসছে। তারপরও কেন বলা হচ্ছে ছবিটি মুক্তি পাবে না? কোন কারণে মুক্তি স্থগিত করব? এটা প্রশ্নই ওঠে না।'
প্রসঙ্গত, নিয়ম অনুযায়ী একই দিনে সর্বোচ্চ দুটি সিনেমা প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পাওয়ার কথা। কিন্তু এবার কোন আইনে একই সঙ্গে ৩টি সিনেমা মুক্তি দেওয়া হলো এ নিয়ে কারও কোনো সদুত্তর নেই।
তবে সাফটা চুক্তি অনুযায়ী বাংলাদেশে বছরে ১০টি উপমহাদেশীয় সিনেমা মুক্তি দেওয়ার কথা রয়েছে। সেই অনুযায়ী এবার বছরের প্রথম ১৯ তারিখ শুক্রবার কলকাতার সিনেমা 'হুব্বা' মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সাফটা চুক্তি অনুযায়ী উপমহাদেশীয় কোনো সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমার সঙ্গে মুক্তি দেওয়ার নিয়ম আছে কিনা এবং সেখানে দুটির বেশি সিনেমা মুক্তি দেওয়ার নিয়ম আছে কিনা এ বিষয়ে কারও জানা নেই। তাহলে এবার এমন ব্যতিক্রম হলো কী করে?
তাই চয়নিকা চৌধুরী আরও বলেন, 'নিয়ম অনুযায়ী দেশের দুই সিনেমা মুক্তি পাবে। সেখানে কোন নিয়মে 'হুব্বা' মুক্তি পাবে তা আমার জানা নেই। যেখানে দেশের দুটি সিনেমা মুক্তির দিন-তারিখ চূড়ান্ত হয়ে গেছে সেখানে বিদেশি সিনেমার মুক্তি পিছিয়ে দিলেই পারত।'
শেষ পর্যন্ত 'কাগজের বউ'কে সঙ্গে করেই একযোগে ৩টি সিনেমা মুক্তি দেওয়া হয়েছে শুক্রবার। এর মধ্য দিয়ে হয়তো নীতিনির্ধারকরা একটু ঝালিয়ে নিতে চেয়েছেন যে, ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে ঢাকাই সিনেমা কতটা টেক্কা দিতে পারে সেটার ওপর।
এরই মধ্যে প্রথম দু'দিনে যেটা দেখা গেছে, তাতে 'হুব্বা' সিনেমাটি দর্শকপ্রিয়তার দিক থেকে মুক্তি পাওয়া অন্য দুটি ঢাকাই সিনেমা থেকে বেশ এগিয়ে আছে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সামনে 'হুব্বা' সিনেমাটি দর্শক মাতাবে আরও বেশি। মেহেদী হাসানের 'শেষ বাজি' সিনেমাটিও থ্রিলার ও অ্যাকশনধর্মী। দেখার বিষয় ছিল এই সিনেমাটি 'হুব্বা' সিনেমাটিকে কতটা টেক্কা দিতে পারে। কিন্তু 'হুব্বা' সিনেমাটি শুধু কলকাতার বাংলা সিনেমা বলেই নয়, এদেশের তারকা ইমেজের অভিনেতা মোশাররফ করিম এই ছবিটির কেন্দ্রীয় পারফর্মার। এ দেশে তার বিপুল দর্শকপ্রিয়তা রয়েছে, এটা অস্বীকার উপায় নেই। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, এদিন যদি শাকিব খানের সিনেমাও মুক্তি দেওয়া হতো তাহলে মোশাররফ করিমের 'হুব্বা'ই এগিয়ে থাকত প্রেক্ষাগৃহে দর্শক সংখ্যার দিক থেকে।
চয়নিকা চৌধুরী বললেন, 'কোন নিয়মে ''হুব্বা'' মুক্তি পাবে তা আমার জানা নেই। যেখানে দেশের দুটি সিনেমা মুক্তির দিন-তারিখ চূড়ান্ত হয়ে গেছে সেখানে বিদেশি সিনেমার মুক্তি পিছিয়ে দিলেই পারত।' এমন কথাতেও পরিষ্কার হয় এ দেশের নির্মাতারা ভারতীয় সিনেমার সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে ভয় পায়। তারা চায় ভারতীয় সিনেমা বাংলাদেশের সিনেমার মুক্তির সময়ে যেন অন্তত মুক্তি দেওয়া না হয়।
এখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দেশীয় সিনেমার সঙ্গে ভারতীয় সিনেমাও একযোগে মুক্তি দেওয়া হবে কিনা সেটা নির্ভর করছে সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর। নিয়ম অনুযায়ী বছরে ১০টি উপমহাদেশীয় সিনেমা বাংলাদেশে চলতেই পারে। দেশের প্রেক্ষাগৃহগুলোকে আবার চাঙ্গা করার জন্য এটার দরকার আছে। সেটা এরই মধ্যে বোঝা গেছে 'হুব্বা' সিনেমার মধ্য দিয়েও। এর আগে পাঠান, জওয়ান প্রভৃতি সিনেমাতেও দেখা গেছে দর্শকের আগ্রহের বিষয়টি। তবে তখন ঢাকাই সিনেমা সেগুলোর সঙ্গে এভাবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়নি। এমনিতেই ভারতীয় সিনেমা নিয়ে দেশের সিনেমা সংশ্লিষ্ট নানাজনে নানা মত দিয়ে আসছেন। কেউ বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমার পক্ষে নানা যুক্তি দিয়ে কথা বলছেন আবার কেউ অনুরূপ নানা যুক্তি দেখিয়েই বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা চালানোর বিপক্ষে কথা বলছেন। কেউ কেউ এমন উদাহরণও দিচ্ছেন, 'পাকিস্তানের সিনেমাও খাদের কিনারায় চলে গিয়েছিল। সেখানে সিনেমা হল কমতে কমতে ৩০/৩৫টিতে এসে কবরের পাশে এসে দাঁড়ায়। পাকিস্তানের সিনেমাও সেই মৃতু্যর মুখ থেকে ফিরেই শুধু আসেনি- আজ সেখানে বারোশটি সিনেমা হলে উত্তীর্ণ হয়েছে। সেখানেও আজ একটি সিনেমা একশ' কোটি রুপির ওপর ব্যবসা করছে। আজকে পাকিস্তানের সিনেমার যে সাফল্যগাঁথা এর সিংহভাগ কৃতিত্বই ভারতীয় সিনেমার। দেশটিতে যদি ভারতীয় সিনেমা প্রবেশের অনুমতি না মিলত তাহলে পাকিস্তানের সিনেমা আজকের জায়গায় এসে দাঁড়াতে পারত না।' তবে এর বিপরীতেও যুক্তি আছে, 'পাকিস্তানের ধর্ম আলাদা হলেও দেশটির সব প্রদেশের ভাষা প্রায় একই এবং তাদের ভাষার সঙ্গে হিন্দি ভাষার সঙ্গেও প্রায় হুবহু মিল রয়েছে। সেজন্য পাকিস্তানের মানুষ যত সহজে হিন্দি সিনেমা ও তার ভাষা বুঝতে পারে বাংলাভাষী বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে হিন্দি অতটা সহজে বোঝা সম্ভব নয়। নয়তো তারা উর্দু ভাষাও বুঝত।'
বাংলাদেশে ভারতীয় সিনেমা মুক্তি নিয়ে যায়যায়দিনের সঙ্গে কথা হয় দেশের বরেণ্য চলচ্চিত্র অভিনেতা সোহেল রানার সঙ্গে। তিনি বলেন, 'যখন আমাদের চলচ্চিত্র টিমটিম করে একটু জ্বলতে শুরু করছে তখনই তারা এই আত্মহননের মতো চিন্তা-ভাবনা করছে। সরকার বুঝে হোক না বুঝে হোক সেটার জন্য মধ্যস্থতা করছে। তবে বাংলাদেশে ভারতীয় ছবি আসতে পারে; কিন্তু আমাদের ছবিও তো সেখানে যেতে পারে। এখন আমাদের হলগুলো বাঁচাতে ওদের দশটা ছবি আনলে আমাদের পাঁচটি তো চলতে পারে সেখানে। নয়তো আমাদের সিনেমা তো 'কিলড' হয়ে যাবে। আরেকটা কথা, আমাদের প্রেক্ষাগৃহে অন্য সময়ে সিনেমা না চললেও পর্বে তো মোটামুটি চলে। পর্ব মানে, ঈদ, দুর্গাপূজা এসব। এখন ভারতীয় সিনেমা যদি আসেই তাহলে অন্তত পর্বতে যেন তাদের ছবি না থাকে।'