সমাজ-বাস্তবতায় ফিরছে ঢাকাই সিনেমা
প্রকাশ | ১৮ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
সমাজ-বাস্তবতার বাইয়ে কোনো সিনেমাই কল্পনা করা যায় না। সারা বিশ্বেই যত সিনেমা হয়, এর বেশির ভাগই সিনেমাই হয় সমাজ-বাস্তবতার ওপর। এই সমাজ-বাস্তবতার হিসেবে সিনেমায় বহু রকম বিষয়ই আসতে পারে। আর যেসব সিনেমা সমাজ-বাস্তবতাকে ফুটিয়ে তৈরি করা হয়, সেসব সিনেমাই মূলত বিশ্বের সব ফিল্ম ফেস্টিভালে স্বীকৃতি পায়। অবাস্তব, অলৌকিক কাহিনীর সিনেমাতে সে রকম স্বীকৃতি দেওয়া হয় না। এরপরও বিশ্বের সব দেশেই সমাজ-বাস্তবতার পটভূমিতে যেমন সিনেমা হচ্ছে, তেমন অবাস্তব অলীক কাহিনীর ওপরও সিনেমা হচ্ছে। অবাস্তব-অলীক কাহিনীর সিনেমার বেশির ভাগই অবশ্য ফ্যান্টাসি, অ্যাকশন ও মারপিটধর্মী হয়।
তবে যেহেতু সিনেমা শেষ পর্যন্ত বিনোদনই কাজেই একটি সিনেমা প্রেম-প্রণয় থেকে শুরু করে লোককাহিনী, ধর্মীয় কাহিনী, অলৌকিক কাহিনী, ভ্রমণকাহিনী, ক্রীড়া, যুদ্ধ ছাড়াও প্রতিদিনের খবরের পাতায় আসা ছোট-বড় চিত্তাকর্ষক শিরোনামের ওপরও ফিচার সিনেমা হতে পারে। আবার লোকমুখে শোনা সত্য ঘটনার ওপরও হতে পারে। এগুলোকে বলা হয় ইভেন্টভিত্তিক বা বাস্তব বিষয়ভিত্তিক সিনেমা। এই বাস্তব ঘটনাভিত্তিক বিষয় নিয়ে ডকু্যফিল্ম, শর্টফিল্ম, টেলিফিল্ম, নাটক, ওয়েবসিরিজ/ফিল্ম তো হয়ই ফিচারফিল্মও হয়ে আসছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অসংখ্য। ঢাকাই ইন্ডাস্ট্রিতে ইভেন্টভিত্তিক বিষয় বা সত্য ঘটনাভিত্তিক ফিচার সিনেমা নির্মাণে এখন অনেকেই ঝুঁকছেন। এই ফিচার সিনেমা তাৎক্ষণিক সময়েরও হতে পারে, আবার শত শত বছর পরও হতে পারে। খান আতাউর রহমানের 'নবাব সিরাজউদ্দৌলা' সিনেমাটি যেমন। হলিউডে বা বলিউডে মিডিয়ায় প্রচারিত তাৎক্ষণিক সত্য ঘটনাভিত্তিক সিনেমার ব্যাপক চাহিদা আছে। আমাদের দেশে অবশ্য এ রকম সিনেমা বানানোর প্রচলন খুব বেশি নেই। যদিও আজিজুর রহমানের 'ছুটির ঘণ্টা'র মতো ব্যাপক ব্যবসাসফল সিনেমা হয়েছে। সম্প্রতি মুক্তিপ্রাপ্ত এবং ব্যাপক ব্যবসায়িক সফল রায়হান রাফীর 'পরাণ'ও বাস্তব ঘটনাভিত্তিক ফিচারফিল্ম। বরগুনার আলোচিত রিফাত হত্যার ঘটনা দেশজুড়েই আলোড়ন সৃষ্টি করে। ঘটনাটিতে সিনেমাটিক উপাদান ভালো থাকাতেও চিত্তাকর্ষক সিনেমা সম্ভব হয়েছে। মিডিয়ায় আসা সত্য ঘটনার ওপর ফিচার সিনেমা অবশ্য বাংলাদেশে খুব বেশি হয়নি। ডকু্যফিল্ম বা শর্টফিল্মই বেশি হচ্ছে। তবে হলিউডে বা বলিউডে এ রকম বাস্তব ঘটনাভিত্তিক ফিচার সিনেমা তাৎক্ষণিকভাবেই হয়ে যায়। অনেক কাজ জনপ্রিয়ও হচ্ছে। কোনোটি বিশ্বমানেরও হয়ে ওঠছে। ভারতে নির্মিত কারগিল যুদ্ধের ওপর সিনেমাটির কথা বলা যেতে পারে। ১৯৯৯ সালের কারগিল যুদ্ধের ঘটনা কারোরই অজানা নয়। একটি ইভেন্টের ওপরই সিনেমা হয়েছে বেশ কয়েকটি। শেরশাহ, এলওসি কারগিল, গুঞ্জন সাক্সেনা : দ্য কারগিল গার্ল, ধুপ, লক্ষ, মৌসমসহ বহু টেলিফিল্ম, শর্টফিল্ম, ডকু্যফিল্মের কাজ হয়েছে বিশ্বখ্যাত এই ইভেন্ট নিয়ে। এগুলোর মধ্যে 'গুঞ্জন সাক্সেনা : দ্য কারগিল গার্ল' তো বিশ্বমানের কাজ হয়ে আছে। বিশ্বখ্যাত 'পার্ল হারবার', 'টাইটানিক' 'অ্যাড্যাপ্টেশন', 'অল দ্য প্রেসিডেন্টস মেন', 'আ ট্যাক্সি ড্রাইভার', 'অক্টোবর স্কাই', 'দ্য এভিয়েটর', 'এ বিউটিফুল মাইন্ড' প্রভৃতি সিনেমাও জগদ্বিখ্যাত ইভেন্ট বা সত্য ঘটনার ওপর বানানো।
যখন কোভিড-১৯ হানা দেয় তখন তো বিশ্বজুড়েই করোনা নিয়ে সিনেমা বানানোর হিড়িক পড়ে যায়। কানাডিয়ান নির্মাতা মোস্তাফা কেশভারি বানিয়ে ফেলেন 'করোনা' নিয়ে প্রথম করোনার ঘটনা নিয়ে থ্রিলার সিনেমা। যে সিনেমাটিতে ভাইরাসের ভয়াবহতা তুলে ধরা হয়েছে। ঢাকায়ও সৈয়দ অহিদুজ্জামান ডায়মন্ড ঘোষণা দিয়েছিলেন 'কোভিড-১৯ ইন বাংলাদেশ' নামের সিনেমা বানানোর। আরও একটি ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা 'রোহিঙ্গা' বানিয়েছেন। যেটা ২১ অক্টোবর মুক্তির অপেক্ষায় রয়েছে। ঐতিহাসিক ইভেন্টের 'নাচোলের রানী' বানিয়েও প্রশংসিত হয়েছেন তিনি। দীপংকর সেনগুপ্ত দীপনের 'অপারেশন সুন্দরবন'ও নানা কল্পকাহিনীর মিশ্রণে করা ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা।
তবে মিডিয়ায় প্রচারিত বাস্তব ঘটনাভিত্তিক সিনেমা বানানোর ক্ষেত্রে অনেক জটিলতা থাকে। বিশেষ করে চলমান সময় এবং তৃতীয় বিশ্বের মতো দেশগুলোতে। এখানে এ রকম বাস্তব ঘটনাভিত্তিক সিনেমা বানাতে গেলে প্রশাসন বা সরকারের পক্ষ থেকে অনুমোদন মিলতেও পারে আবার মিলতে নাও পারে। কখনো অনুমোদন মিললেও ঘটনায় অনেক কাটছাঁট করে বানাতে হয়। কারণ, এ রকম বর্তমান ইভেন্টের সঙ্গে বর্তমান সরকার বা প্রশাসনেরও ইমেজ জড়িত থাকে। যে কারণে আরেকটি ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা নজরুল ইসলাম খানের 'রানাপস্নাজা' বারবার কাটছাঁট করেও শেষ পর্যন্ত এটা মুক্তিই পেল না।
ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা একটি জাতির জন্য ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে থাকতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। চাষী নজরুল ইসলামের 'ওরা ১১ জন' তো জ্বলন্ত সাক্ষী। মহান ১৯৭১-এর ইভেন্টের ওপর আরও অনেক সিনেমা হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে। এ রকম একটি সিনেমা শুদ্ধমান চৈতন্যর 'দামপাড়া'র নির্মাণ শেষপর্যায়ে রয়েছে। চলমান বা সমসাময়িক ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা হলো সময়ের দর্পণ। তবে আমাদের দেশে এই সিনেমা সেন্সরের কঠোর নিয়ন্ত্রণে নির্মিত হওয়ায় অনেক মূল বিষয়টিই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে এতে বাস্তব সত্যের পরিচয় কম থাকে। কোনো সরকারের সময় এই সিনেমা বানানো সম্ভব হয় না আবার কোনো সরকারের সময় সহযোগিতাও মেলে। যেমন
একসময় বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে সিনেমা বানানো কল্পনাই করা যেত না।
তবে সুযোগ পেলে আমাদের দেশেও ইভেন্টভিত্তিক সিনেমা ভালো হতে পারে রায়হান রাফী তার 'পরাণ' সিনেমাটিতে প্রমাণ দিলেন। সিনেমায় সাধারণত নায়িকাকে মহিমান্বিত, মহিয়সীরূপে দেখানো হয়ে থাকে। কিন্তু এখানে ঘটনার কারণেই নায়িকাকে দ্বিচারিনীরূপে দেখানো হয়েছে। বাস্তবের সঙ্গে মিল থাকাতেই দর্শকও এটা লুফে নিয়েছেন। এটা যদি হতো কাল্পনিক দ্বিচারিনী তাহলে হয়ত এটা দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা থাকতো না। কাল্পনিক হওয়াতেই ইভেন্টভিত্তিক হয়েও 'খুনি শিকদার' দর্শকের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। অথচ এই ইভেন্টে যে গল্পকাহিনী প্রচলিত ছিল, সে রকম সিনেমা হলে একটি ভালো বাণিজ্যিক সিনেমা হতে পারত। কিন্তু আমাদের নির্মাতাদের মধ্যে খুব কমই এটা বুঝেন, কাকে দিয়ে কোন চরিত্র 'খাপে খাপ' মিলে যাবে।
কারণ, ঢাকাই সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে বেশির ভাগ সিনেমাই হয়েছে কাল্পনিক বিষয়ের ওপর। ইভেন্টভিত্তিক বা বাস্তব ঘটনাভিত্তিক সিনেমা বানাতে গেলেও তারা অতিমাত্রায় কল্পনার আশ্রয় নিতে গিয়ে মূল ঘটনা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যান। তবে মিডিয়ায় শিরোনাম হয়ে আসা বাস্তব ঘটনার ওপর ফিচার সিনেমার ওপর ইদানীং গুরুত্বারোপ করছেন তরুণ প্রজন্মের নির্মাতারা। এটা নিঃসন্দেহে দেশের সিনেমার জন্য একটা শুভ লক্ষণ। এর মাধ্যমে নির্মাতাদের মেধা ও সৃষ্টিশীলতার পরিচয় প্রকাশেরও একটি উপায় হয়ে ওঠতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে নির্মাতাদের জন্য উদার ও অনুকূল পরিবেশও জরুরি।