নাটকে আগ্রহ কমছে অভিনয় শিল্পীদের
প্রকাশ | ১৫ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
একটা সময় ছিল শিক্ষিত শ্রেণির মানুষ নাটকের প্রতি খুব আগ্রহ দেখাতেন। নায়ক-নায়িকা হবেন, এমন বাসনা থেকেও নয়। নিখাঁদ অভিনয়ের প্রতি দুর্বলতার কারণেই অভিনয় করতে চাইতেন। সেটা যদি সাধারণ চরিত্রেও হয়, তারপরও। এখন সেই অবস্থা নেই। এমনটিই মনে করছেন অভিনয় শিল্পীদের অনেকে। এর মধ্যে অভিনেতা মাজনুন মিজান বলেন, 'আসলে আমাদের ভিতর বিষয় বাইরের অনেকেই জানেন না যে, এখানে ক্যারেক্টার আর্টিস্টদের কী চোখে দেখা হয়! শুটিংয়ে প্রধান চরিত্রের অভিনয়শিল্পীদের যে চোখে দেখা হয়, সেই তুলনায় অন্য চরিত্রাভিনয় শিল্পীদের অনেকটা তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা হয়। এমন যে তাদের মানুষ হিসেবেও গণ্য করা হয় না। এটা আসলে ভীষণ অপমানের। এগুলো আমি নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি। আমার সঙ্গে না হলেও অন্য অনেকের ক্ষেত্রে দেখেছি। একজন চরিত্রাভিনেতাকে শুটিংয়ে চা-নাশতা চেয়ে খেতে হয়, আবার আরেকজনের পেছনে খাবার ঘোরে। আমাকে হয়তো চা দিচ্ছেন, অন্যজনকে সঙ্গে ভিন্ন কিছু। কিন্তু এই সিস্টেম তরুণদের জন্য কী বার্তা দেয়? অভিনয়ে যে নতুন আসছে, সে কী শিখবে? আসলে কী সিস্টেম আমরা ডেভেলপ করছি?'
এ বিষয়ে অভিনেতা আরমান পারভেজ মুরাদ বলেন, 'এখন টিভি নাটকে নতুন একটা কাজের প্রবাহ আসছে, এটা খুবই ভালো। তবে এর নিয়ন্ত্রকরা যদি আলোর দিকে আসেন- আমিত্ব ভাবটা ছাড়তে পারেন- তাহলে ভালো হয়। সিনেমা হিরো-হিরোইন সর্বস্ব হলে একটা বৈষম্য থাকেই। তখন নায়ক-নায়িকা জুস খাবেন আর অন্যেরা চা খাবেন- এই আর কী। এমন ছোটলোকি তো ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির সঙ্গে মানানসই হয় না। এখানে পারিশ্রমিকে হিরো-হিরোইনই কোটি টাকা গ্রাস করলে অন্যেরা ১০ হাজার টাকায় কী করবেন? যেমন, একজন শিল্পী ৬০০ সিনেমা করেছেন- এখন তিনি দিন এনে দিন খান। এটা তো হতে পারে না।' তিনি আরও বলেন, এই বৈষম্য সাংগঠনিকভাবে তো দূর করার কাজ হচ্ছেই না বরং এর সঙ্গে একটা সিন্ডিকেটে সব ভরে আছে। এর সঙ্গে এমন একটা কুচক্রী জড়িত আছে যে, এই কুচক্রীরা দূর না হলে দেশের চলচ্চিত্রের শিল্পীদের ভবিষ্যৎ আমি ভালো দেখি না। এদের জন্য শিল্পীরা মানসম্মানের সঙ্গে জীবন-যাপন করতে পারছেন না। অনেকে বাধ্য হয়ে বিপথে গিয়ে অসম্মানজনক জীবন-যাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন।'
এই পরিস্থিতি আজকালেরও নয়। অনেক বছর ধরেই এটা চলে আসছে। ফলে একটা সময় নিজের মানসম্মান রক্ষার্থে অনেক অভিনয় শিল্পী এই জগৎ ছেড়ে চলে যাচ্ছেন। যাবেনই না কেন যখন দেখেন, এক ঘণ্টার একটি নাটকের জন্য যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ থাকে, তার প্রায় ৭০ শতাংশ টাকাই মাত্র দুজন তারকা নিয়ে যাচ্ছে প্রযোজকের কাছ থেকে। বাকি ৩০ শতাংশ টাকা দিয়ে যখন তারা নাটক বানান তখন সেখান থেকে বাকি অভিনয় শিল্পী এবং কলাকুশলী কতটুকুই বা পেতে পারে? ফলে নাটকের গল্পে দুজন তারকার বাইরে দু-ুএকজন সহশিল্পী নিয়ে কাজ করতে গিয়ে নাটক নির্মাণে আপস করতে হচ্ছে অনেক নির্মাতাকেও।
এভাবেই নাটকের বাজেট কমছে। কমছে গল্পের চরিত্রও। বাড়ছে শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রের পারিশ্রমিকই। অন্যদিকে বাজেট কম হওয়ায় বেশিরভাগ নাটকের গল্পে থাকছে শোবার ঘর, অফিসকক্ষ ও পার্কের বেঞ্চি আর টুকিটাকি কিছু। নাটক হচ্ছে পরিবারহীন। এ বিষয়ে দর্শকপ্রিয় অভিনেতা ও পরিচালক সালাহউদ্দিন লাভলু বলেন, '৭ বছর আগেও যে নাটকের বাজেট ছিল তিন লাখ টাকা, সেই নাটকের বাজেট এখন কমে দাঁড়িয়েছে দেড় লাখ থেকে এক লাখ আশি হাজার টাকায়। নাটকের দাম কমলেও তারকাদের পারিশ্রমিক বেড়েছে ৩ থেকে ৪ গুণ পর্যন্ত। একটি নাটকের যে বরাদ্দ, তার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ টাকা চলে যাচ্ছে তাদের সম্মানী দিতে।'
নাটকের কেন্দ্রীয় চরিত্রের তারকাদের পারিশ্রমিক দিতে গিয়ে নাটকের আত্মীয়স্বজন, গৃহকর্মী, প্রতিবেশীর চরিত্রগুলো গল্প থেকে বাদ দিচ্ছে। যাওবা থাকে পারিশ্রমিক দিচ্ছে যৎসামান্য। দুই বরেণ্য শিল্পী আবুল হায়াত ও ডলিজহুরসহ আরো অনেকে বলেন, এভাবে যেমন বাংলা নাটক ক্রমে পরিবারকেন্দ্রিক সংস্কৃতি থেকে বের হয়ে পড়ছে তেমনি বের হয়ে পড়ছে টিভি নাটকের অনেক অভিনয় শিল্পীও।
এ প্রসঙ্গে অভিনেতা আবুল হায়াত বলেন, 'যার চাহিদা আছে, তার পারিশ্রমিক বেশি থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। সেটা অন্য সময়ও ছিল। কিন্তু মূল সমস্যা হচ্ছে, আমাদের নাটকের বাজেট অনেক কম। নাটকের বাজেট বাড়াতে হবে, তা না হলে আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতির গল্পগুলো হারিয়ে যাবে।'
অনেকেই বলছেন, টেলিভিশন চ্যানেল নাটকের বাজেট কমিয়ে দিয়েছে। অনলাইন পস্ন্যাটফর্মগুলোর কাছে নিজেদের চাংক (অনুষ্ঠান প্রচারের সময়) বিক্রি করে দিচ্ছে টেলিভিশন চ্যানেলগুলো। ক্রেতা পস্ন্যাটফর্মগুলো একই ঘরানার গল্প, চরিত্র, পোশাক, লোকেশনের বাছ-বিচার না করে 'ভিউ'-এর আশায় তাদের সুবিধামতো তারকাদের নিয়ে নাটক বানাচ্ছে। ফলে একই তারকারা ঘুরে-ফিরে বারবার পর্দায় ফিরে আসছেন। এ সমীকরণের কথা জানালেন প্রযোজক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাজু মনতাসীর। অন্যদিকে বাংলাভিশনের অনুষ্ঠান প্রধান তারেক আকন্দ বলেন, 'আমাদের টিভি নাটকের পার্টনার অনলাইন পস্ন্যাটফর্মগুলো। নাটক নির্মাণে ব্যয় করা টাকার একটি বড় অঙ্ক তাদের তুলতে হয় অনলাইন 'ভিউ' থেকে। ফলে তারা নিজেদের প্রয়োজনীয় তারকাদের নিয়ে নাটক বানালে মান যাচাই ছাড়া আমাদের আর কিছু বলার থাকে না।'
বেশি পারিশ্রমিক প্রসঙ্গে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনপ্রিয় একজন অভিনেতা বলেন, 'শিডিউল নিতে এসে প্রথমেই নির্মাতা এবং প্রযোজক বলেন, 'ভাই বাজেটের কোনো সমস্যা নেই'। আমি নিজেই ভাবি, এত টাকা তারা কোত্থেকে দিচ্ছেন? টাকাটা উঠেই বা আসছে কীভাবে!'
আরেক অভিনয়শিল্পী জানান, 'অনেক নির্মাতা ও প্রযোজক তার ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অগ্রিম টাকা পাঠিয়ে সিডিউলের জন্য অনুরোধ করেন। সিডিউলের অনুরোধ শুনতে দিনে অন্তত ৩০ জন নির্মাতার ফোন ধরতে হয়। অনেক নির্মাতা সেটে এসে বসে থাকেন। প্রযোজকরা ভিড় করেন।'
এ রকম পরিস্থিতিতে কী করতে পারেন একজন অভিনেতা? আরেক অভিনেতা বলেন, 'অনেকেই সিডিউল নেওয়ার সময় এক রকম গল্প শোনান। শুটিংয়ের আগ মুহূর্তে গিয়ে দেখা যায়, চিত্রনাট্য অন্য রকম। একটি শুটিং টিমের সবার মুখের দিকে তাকিয়ে কাজটা করতে হয়। প্রযোজকরা আমাদের চাহিদা বাড়িয়ে দিলে আমাদের কিছু করার থাকে না।'