জমজমাট গল্পই ওয়েবফিল্মের প্রাণ
প্রকাশ | ১১ জানুয়ারি ২০২৪, ০০:০০
মাতিয়ার রাফায়েল
যে ওয়েবফিল্ম/ওয়েব সিরিজ ব্যাপক নিন্দা দিয়ে যাত্রা করেছিল সেই ওয়েবফিল্ম/ওয়েব সিরিজই এখন ধারাবাহিকভাবে অবারিত প্রশংসা কুড়িয়ে যাচ্ছে, এর রহস্যটি কী? শুধু তাই নয়, ওটিটি এখন টিভি তারকাদের থেকে শুরু করে বড় পর্দার অভিনয় শিল্পীদের জন্যও সুবিধাজনক মঞ্চ হয়ে উঠছে। যখন ছোট পর্দার নাটক নানারকম চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, তখন ওটিটির এই ধারাবাহিক সাফল্য শোবিজের সবার জন্য প্রধান আগ্রহের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ভিডিও স্ট্রিমিং পস্ন্যাটফর্মগুলোর মধ্যে বেশ কয়টি দর্শকের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে নিয়েছে। দর্শকদের বিনোদন চাহিদা পূরণে বিকল্প মাধ্যম হিসেবে ছোট পর্দা মানে টিভির পাশাপাশি এখন নেটফ্লিক্স, আমাজন প্রাইম ভিডিও, হটস্টার ডিজনিপস্ন্যাস, জি-ফাইভ, সনি লিভ, হইচই, চরকি'র এর মতো অনলাইন স্ট্রিমিং পস্ন্যাটফর্মের গুরুত্ব আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে। দর্শক ক্রমেই ঝুঁকছে ডিজিটাল বিনোদন মাধ্যমে। কারণ, দেশি-বিদেশি সব টিভি চ্যানেলের কন্টেন্টের বৈচিত্র্যহীনতা, একঘেয়ে পুরনো ট্র্যাকের গল্প-কাহিনী পরিবেশনা, ঘুরে ফিরে কিছু নির্দিষ্ট আলোচিত তারকা অভিনেতা-অভিনেত্রীর পারফরম্যান্স দর্শকের কাছে একঘেঁয়ে ও বিরক্তিকর হয়ে উঠেছিল। তার ওপর অনুষ্ঠান প্রচারের সময় কিছুক্ষণ পরপর বিজ্ঞাপনের মাত্রাতিরিক্ত অসহনীয় যন্ত্রণা তো আছেই। ফলে অনেকদিন ধরেই দর্শক বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের স্বেচ্ছাচারিতার কবল থেকে রেহাই পেতে বন্দিদশার মতো হাঁসফাঁস করছিলেন। সেই একঘেঁয়ে বৈচিত্র্যহীন নাটকের গল্পে বন্দি অবস্থা থেকেই যেন মুক্তির পথ দেখিয়ে দিল ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম। দর্শকদের সেই অবস্থা থেকে বিকল্প ঘরোয়া বিনোদন পস্ন্যাটফর্ম হিসেবে এখন ওটিটি (ওভার দ্য টপ) স্বস্তির সুবাতাস বয়ে এনেছে।
এ বিষয়ে ছোট ও বড় পর্দার তারকাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এর মূল কারণই হচ্ছে গল্পের শক্তি বা স্পিরিট। শক্তিমান অভিনেতা ও চিত্রনাট্যকার মাসুম আজিজ মনে করেন, গল্পের প্রাণশক্তিই ওটিটির সাফল্যের চাবিকাঠি। সেই সঙ্গে তরুণ মেধাবী নির্মাতা, যাদের প্রথম টার্গেটই থাকে দর্শককে একটি ভালো নির্মাণশৈলী উপহার দেওয়ার। আর নাটকে যেসব গল্প থাকে, এর প্রায় সবগুলোই ফরমায়েসি। এখন ওটিটি যখন এ থেকে মুক্ত, তারা সৃজনশীল গল্প দিতে পারছে। এই ভালো নির্মাণশৈলীর মধ্যে ইতোমধ্যে বেশ কিছু ওয়েব সিরিজ ও ওয়েবফিল্ম উপহার দিয়েছে ওটিটি। তাদের কাজে মেকিং, ডিরেকশন, সিনেমাটোগ্রাফি, অভিনয়, কালার টোন, সাউন্ড ডিজাইন, এডিটিংয়ের কাজ সবকিছুই বেশ ধীরেসুস্থে গুছিয়ে করা। বৈচিত্র্যপূর্ণ, নিত্যনতুন চমক লাগানো গল্প-কাহিনীর সময়োপযোগী আধুনিক নান্দনিক উপস্থাপন দর্শকদের চুম্বকের মতো আকর্ষণ করছে এগুলো। বলা চলে, সাম্প্রতিক কয়েক বছরে বিনোদনের জগতে নতুন মাত্রা যোগ করেছে এই ওয়েবফিল্ম/ওয়েব সিরিজ। এ দেশে নির্মিত এই প্রশংসিত ওয়েবফিল্ম/ওয়েব সিরিজগুলোর মধ্যে আছে নেটওয়ার্কের বাইরে, মহানগর, রেডরাম, শুক্লপক্ষ, পঁচিশ, এই পারফেক্ট মার্ডার, দ্য ব্রোকার, সিন্ডিকেট, নীল দরজা, আগস্ট ১৪, বলি প্রভৃতি।
ওটিটি পস্ন্যাটফর্ম দর্শক রুচি ও চাহিদার আলোকে নিত্যনতুন বিষয় ভাবনার ওয়েব সিরিজ নিয়ে আসছে। যেখানে গল্পের নতুনত্ব, শিল্পীদের সাহসী খোলামেলা পারফরম্যান্স, আধুনিক চিন্তা-চেতনার প্রকাশ সবাইকে খুব সহজেই আকৃষ্ট এবং আলোড়িত করছে। ফলে গত কয়েক বছরে ওয়েবফিল্ম ও ওয়েব সিরিজের তুমুল জনপ্রিয়তা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এমন জনপ্রিয়তার সামনে দাঁড়িয়ে এখন বড় বড় নির্মাতারাও ওয়েব সিরিজ ও ওয়েবফিল্ম বানানোর দিকে ঝুঁকছেন।
দীর্ঘদিন ধরে টিভি ও চলচ্চিত্র নির্মাতারা একই ধারার নাটক-সিনেমা বানাতে বানাতে আসলে ভুলেই গিয়েছিলেন নাটক-সিনেমা বানানোর জন্য যে গল্প দরকার। গল্প না হলে নাটক-সিনেমা হয় না- এটা যেন তারা এতদিন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। এ জন্যই দেশের নাটক, সিনেমা ও সিরিজের গল্প ঘুরেফিরে সেই একই ঢাকা শহরের মধ্যেই আটকে রয়েছে। অথচ ঢাকার বাইরে বাংলাদেশের প্রতিটি জেলায়, উপজেলায়, জনপদে ছড়িয়ে আছে অসংখ্য গল্প-কাহিনী। কিন্তু অধিকাংশ নির্মাতার মধ্যে ঢাকার বাইরের বাংলাদেশটাকে দেখানোর তেমন আগ্রহ না থাকায় তারা তাদের নাটকে-সিনেমায় কোনো বৈচিত্র্য আনতে পারছিলেন না। যদিও ঢাকার নগরকেন্দ্রিক জীবনযাপনের বাইরেও আছে চমক লাগানো গল্প, কাহিনী আর সেই গল্পে অভিনয় করার মতো অভিনেতাও রয়েছেন প্রচুর, যাদের মেধা ও সক্ষমতা আরও ব্যাপক পরিসরে আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরা যায়।
তবে এই ওয়েবফিল্ম/ওয়েবসিরিজ সম্পর্কে ভিন্ন মত আছে টেলিভিশন শিল্পীদের সংগঠন অভিনয় শিল্পী সংঘের সভাপতি ও অভিনেতা আহসান হাবিব নাসিমের। তারমতে 'এখন টিভি নাটক ও ওটিটি একই হয়ে গেছে। যেটা টিভিতে প্রচারিত হচ্ছে, সেটাই আবার একই সঙ্গে ওটিটিতেও দেখানো হচ্ছে। কাজেই এ নিয়ে এখন টিভি ও ওটিটি আলাদাভাবে দেখানো যাবে না। যেটা চলচ্চিত্র হিসেবে বানানো হয়েছে, সেটাই আবার ওটিটিতে আসছে।' এটা অবশ্য ওটিটি মাধ্যম হিসেবে অন্যান্য মাধ্যমগুলোর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠাতেই আজ টিভি নাটক, শর্টফিল্ম, ফিচারফিল্ম সবই ওটিটিতে জায়গা করে নিচ্ছে। এটা তো ওটিটিরই বিজয় যে, অন্যান্য মাধ্যমের কন্টেন্টগুলোও ওটিটিতে আশ্রয় করে নিচ্ছে। এর মূল কারণই হচ্ছে, গল্প। যেসব নাটকে ও সিনেমায় গল্পের জোর আছে, সেগুলোই আজ ওটিটিতেও ঠাঁই করে নিচ্ছে। এখন কেন ওটিটির কন্টেন্টে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এ বিষয়ে বড় ও ছোট পর্দার শিল্পীরা বলেন, গল্প ছাড়াও ছোট পর্দায় যেরকম ধরাবাঁধা নিয়ম থাকে, ওটিটিতে সেটা থাকে না। ওটিটি ভালো করার আরেকটি কারণ এখানে পর্যাপ্ত স্বাধীনতা থাকে। এই স্বাধীনতার জন্যই শিল্পীরাও তাদের ভালোটা দিতে পারছেন। যেটা ছোট পর্দায় সম্ভব হয় না। অথচ এই স্বাধীনতার জন্য একটা সময় যখন ওটিটির কন্টেন্ট নিয়ে সেন্সর আরোপের দাবি উঠছিল বিভিন্ন মহল থেকে, এখন সেটার আর প্রয়োজনই দেখছেন কেউ। কারণ, এখন এই সেন্সরের ব্যাপারে নির্মাতারাই যথেষ্ট। তারাই বুঝে নিচ্ছেন গল্পের ভালোমন্দ। নিজেরাই হয়ে উঠছেন গল্পের বিবেক। আর এই সামিলে যেসব তরুণ তুর্কী নির্মাতা এগিয়ে যাচ্ছেন, তাদের মধ্যে আছেন মিজানুর রহমান আরিয়ান, ভিকি জাহেদ, সৈকত নাসির, আবু হায়াত মাহমুদ, শিহাব শাহিন, গোলাম সোহরাব দোদুল প্রমুখ।